Posts

Showing posts from June, 2023

আমার মা, বুড়োর মা আর সঞ্জীবের মা

Image
  একটা গন্ধ আমাকে ঘিরে থাকে, মায়ের গায়ের গন্ধ । সে গন্ধ আমি চোখ বুজলেও টের পাই। যেখানেই থাকি না কেন, যে অবস্থাতেই থাকি না কেন, একবার মনে করলেই গন্ধটা তার অস্তিত্ব নিয়ে আমাকে ঘিরে ধরে। আমাকে আদরে আদরে ভরিয়ে দেয়। কিছুকাল আগের ঘটনা। আমার তখন ধুম জ্বর। গা পুড়ে যাচ্ছে। মাথায় অসহ্য যন্ত্রণা। বড়ো অস্থিরতা। ঘুমহীন রাত । সকালে মা আমার মাথার কাছে এসে বসল। সদ্য স্নান করে পুজো দিয়ে এসেছে। আমাকে দেখতে এসেছে। মায়ের গায়ে আমার গা ঠেকল। কি ঠান্ডা তার শরীরটা! আমি হাঁচোড় পাঁচোড় করে মা-কে জড়িয়ে ধরলাম। মায়ের বুকের মধ্যে আমার মুখ গুঁজে দিলাম। আমার কপাল তার বুকে ঠেকল। আঃ! কি শান্তি। আমাকে মা ঠেলে সরিয়ে দিল না। আমাকে একটু জড়িয়ে ধরল। তার ভেজা হাত দুটো দিয়ে পরম মমতায় আমার মুখে, গলায় বুলিয়ে দিল। শান্তি শান্তি শান্তি... আমার কান মায়ের ঠিক বাম বুকে। আমার মুখ ডুবে গেছে বর্ষাকালের নরম কচি ঘাসের নিবিড় কবুতর উষ্ণতায় । আর সেখান থেকে আমি শুনতে পাচ্ছি একটা ছন্দ --- “ কানের কাছে মায়ের হৃৎপিন্ড ধুকধুক করছে। ” আমার হৃৎপিন্ড মায়ের হৃৎপিন্ডের সাথে তাল মেলাতে থাকে । সে ছন্দের এক মাধুর্য আমাকে নিমেষে টেনে নিয়ে গেল সব জ্বালা

তুঙ্গা-র এক গণ্ডূষ শরদিন্দু পান

Image
  সলমন রুশদী আমাকে টেনে এনে ফেললেন তুঙ্গভদ্রার তীরে। তুঙ্গার জল পান করে উঠে দেখলাম আমি শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের সামনে দাঁড়িয়ে আছি। আর তার পেছনে মহারাজ দ্বিতীয় দেবরায়, অর্জুনবর্মা আর বলরাম । শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায় এবং সলমন রুশদী --- দুজনেই সোজামাটা গল্প বলেছেন। দুজনেই জানেন কীভাবে গল্প পরিবেশন করতে হয়। সেদিক থেকে দুটো লেখাই একদম ফ্ল্যাট লেখা, চড়াই উতরাই যতটুকু আছে তা রাস্তার বাম্পারের মতো, জটিলতায় যাওয়ার আগেই মিলিয়ে যায়। দুটো উপন্যাসের মধ্যেই গভীর ভাবোদ্দীপক কিছু খুঁজতে যাওয়া বৃথা। দুই লেখকের লেখনী এই পর্যায়ে সেই স্তরের নয়। কিন্তু তবুও, তুলনায় সলমন রুশদীর লেখা সমসাময়িক। তার কারণ, তিনি উপন্যাসটা লিখছেন ২০২৩ সালে। তাকে শারদীয়া সংখ্যার নির্দিষ্ট শব্দসংখ্যায় সীমাবদ্ধ কোন উপন্যাস লিখতে হচ্ছে না, কিম্বা তার কেবলমাত্র বাঙালী পাঠকের কাছে লেখাটা পৌছানোর দায় নেই। তার লেখার মূল ভিত্তি Magic Reality । শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের অস্ত্র Historical Fiction । কিছু লেখক আছেন, যারা তাদের বাক্যবিন্যাসে একেবারে মিছরি-মাখন লাগিয়ে পরিবেশন করেন। এত সুন্দরভাবে যে গল্প বলা যায়, এত সুচিন্তিত অথচ অমোঘ কিছু শ

জয়পরাজয় - সম্রাট, সাম্রাজ্য ও সুন্দরী

Image
  “Nothing endures, but nothing is meaningless either. We rise, we fall, we rise again, and again we fall. We go on. I too have succeeded and I have also failed. Death is close now. In death do triumph and failure humbly meet. We learn far less from victory than from defeat.”       রুশদী-র লেখা উপন্যাসের একদম শেষ পর্যায়ের লাইনগুলো আমি যখন পড়ছি, মনের মধ্যে তখন বড়ো উথাল পাথাল। পড়তে পড়তে আমিও যে কখন পম্পা কম্পানা-র সহমর্মি হয়ে পড়েছি, টের পাই নি। টের পাই নি, কীভাবে আস্তে আস্তে আমার বয়সও আড়াইশো বছর পার করল। নয় বছর বয়সে যে মেয়ের জীবন শুরু হল মা-র অগ্নিপ্রবেশের সাথে সাথে, সেই মেয়ে কখন যেন রাণী হল, কখন যেন অজ্ঞাতবাসে গেল, কখন যেন রাজমাতা হল, কখন যেন দৃষ্টিহীন হয়েও দৃষ্টিমতী রয়ে গেল --- ইতিহাস তারও কোনও চিহ্ন রাখল না।       ইতিহাস কারোরই চিহ্ন রাখে না। মার্কেজ কি এমন গল্পই লিখেছিলেন তার নিঃসঙ্গতার শতবর্ষে? সাম্রাজ্যের উত্থান আর পতন --- কয়েকশো যুগ তার সময়কাল হলেও, তার চিহ্ন কি থাকে অবশেষে ? --- “ সে চিহ্ন যাবে মিলিয়ে / যে রাত্রে সকল চিহ্ন পরম অচিনের মধ্যে যায় মিশে।। ”       সলমন রুশদী তা

আষাঢ়স্য পঞ্চম দিবসে

Image
  আষাঢ়ের পঞ্চম দিবসের সকালে ঘ ন কালো অবিচ্ছিন্ন মৃদুমন্দ মেঘ ভেদ করে আশ্বিন বলল, আমি এসেছি। পৃথিবী চমকে উঠল। শ্যামল কোমল রূপের বদলে এ কোন তীব্ররূপ ! আমিও চমকালাম। রাস্তার পিচের ভ্যাপসা গন্ধ ছাপিয়ে তখন দুপাশের বেঁচে থাকার লড়াইয়ে যুদ্ধরত ঘাসের মধ্যে থেকে সোঁদা মাটির গন্ধ ম ম করছে। তারাও গেছে থমকে। রসসিক্ত মাটিতে এ কোন উপদ্রব? এ কেমন গন্ধ? এখন ডুবে যাওয়ার সময়। কোথায় আকাশপারে থাকবে উতল হাওয়া, তার বদলে সূর্যদীঘল রুদ্ররূপ! ফাঁকা রাস্তার মাঝখানে দাঁড়িয়ে, তারের জালে বন্দী আকাশটাকে দেখতে দেখতে আমি বুঝতে পারছি না, আমি কেন? আমি কেন? এ খানে আমি কেন? আমার কি কোন প্রয়োজন আছে? মৃত্যু এসে যদি আমায় এখন এক ঝটকায় টেনে নিয়ে যায়, কোথায় নিয়ে যাবে? আমার থাকা আর না থাকাতে কি কোন পার্থক্য হবে? আমি না থাকলে কি জগতের কোন অস্তিত্ব থাকবে? না কি আমার অস্তিত্ব না থাকলে জগতের একবিন্দু আসবে যাবে না? দুটোই ঠিক। দুটোই ভুল। যেমন করে এই আশ্বিন জানে না, একটু পরেই আষাঢ় পিছন থেকে মন্দমন্থর পায়ে এসে ঝাঁপিয়ে পড়ে জাপটে ধরে হাপিস করে দেবে তাকে , নিজের বুকের মাঝে, চিহ্নমাত্র থাকবে না আ র। স্মৃতিতেও আসব

যদিও সন্ধ্যা

Image
  যদিও সন্ধ্যা নেমেছে, যদিও এখানে ঘন মেঘ আকাশ জুড়ে, যদিও এখানে ঘাসের ডগায় বিন্দু বিন্দু জল আটকে আছে, যদিও পথচারী কম, যদি লোডশেডিং-এ ঘর অন্ধকার, যদিও তুমি আমার পাশে নেই, তবুও, এমন সন্ধ্যায় আমি তোমাকে ডাকব না। তুমি দূরেই থাকো। কাছে এসো না। কখনো কখনো তুমি দূরে থাকলেই বরং ভালো। কারন, যখন আমি তোমাতে মগ্ন তখন তুমি আমার সামনে থাকলেও আমার তোমাতে মগ্নতা ছিন্ন হয়। এই কি অলখ টান? অস্তিত্ব আছে, ব্যক্তিত্ব নেই। আর নেই বলেই এ অনেকটা ম্যাজিকের মতন। বর্ষা এই ম্যাজিককে আরোও মোহময় করে তোলে। আমি মোহাবিষ্ট হয়ে থাকি। আমি মোহাবিষ্ট হয়ে থাকতে চাই। এমন মোহাবিষ্ট খানিকটা আফিং-এর মতন। যেন কেমন একটা ঝিমধরা ভাব। ভাবনাগুলোও কেমন ঝিমধরা। বাইরে তখন আষাঢ়ে ঝুমবৃষ্টি এই নেশাকে জ্বালাধরা নেশায় নিয়ে যায়। আমি জ্বলতে থাকি। তোমার শরীরের স্পর্শের জন্যে। কিন্তু জানি, নিবিড়ভাবে শরীরে শরীর মিলিয়ে দিলে এই টান হয়তো থাকবে না। তখন সব জানা হয়ে যাবে। তখন মনে হবে, বেশ তো! এই-ই তাহলে সব? এই তাহলে চরম পাওয়া? যে দূরত্বে প্রেম এমন নেশাতুর করে তোলে, সেই প্রেমই নিবিড় ঘনিষ্ঠতায় যেন কত চিরকালের নিত্যপরিচিত! আমি কোন প্রেমে মজব? নিকটে

ছবি ও গান – অভিযোজনের পথে

Image
আমার রবীন্দ্রনাথ - ১২ ‘ছবি ও গান’ কাব্যগ্রন্থটা আমার কাছে কেমন যেন সেতুবন্ধনের মতো লাগে। এর পূর্ববর্তী কবিতাগুলো কেমন যেন খাপছাড়া। অন্তরের তাগিদ স্পষ্ট, বহির্মুখী দৃষ্টিশক্তি ক্ষীণ। ‘ছবি ও গান’-এর রবীন্দ্রনাথ আস্তে আস্তে আমাদের চিরপরিচিত রবীন্দ্রনাথ হয়ে ওঠার দিকে যেন যাচ্ছেন। তার যে ‘সিগনেচার’ ছন্দে, বাক্যে এবং লেখার মর্মবোধে --- যেন মনে হয়, উক্ত কাব্যগ্রন্থটা সেই হয়ে ওঠার দিকনির্দেশ করছে । এই কাব্যগ্রন্থের প্রথম কবিতাটাই ধরা যাক। “আমার প্রাণের পড়ে চলে গেল কে / বসন্তের বাতাসটুকুর মতো’ --- এখনও রোমান্টিক গানগুলোর মধ্যে অগ্রগণ্য একটা গান, যার রচনা কবিতা হিসাবে এই কাব্যগ্রন্থে! অথচ এটি উক্ত কাব্যগ্রন্থের প্রথম কবিতা। ‘কে?’ শীর্ষক এই কবিতার সুরটিও চমৎকার। সমগ্র গানটাতে সুর কিন্তু ফেরে না। স্রোতের মতো গানটা চলতেই থাকে। একেবারে শেষে এসে প্রথম চরণটিকে পুণরায় গেয়ে গানটির উপসংহার টানা হয়। এমন গান বিরল। অন্তত রবীন্দ্রসঙ্গীতে। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, ছবি ও গানের প্রথম সংস্করণ ঘাটলে দেখা যায়, প্রথম কবিতা ছিল ‘আজু সখি মুহু মুহু’, যা পরবর্তীকালে ‘ভানুসিংহের পদাবলী’তে স্থান পায়। একই অবস্থা হয় শেষ গা

ছবি ও গান – রবীন্দ্রনাথ ও কাদম্বরী দেবী

Image
আমার রবীন্দ্রনাথ - ১১ “ গত বৎসরকার বসন্তের ফুল লইয়া এ বৎসরকার বসন্তে মালা গাঁথিলাম। যাঁহার নয়ন-কিরণে প্রতিদিন বসন্তের এই ফুলগুলি একটি একটি করিয়া ফুটিয়া উঠিত, তাঁহারি চরণে ইহাদিগকে উৎসর্গ করিলাম। ” রবীন্দ্রনাথ লিখছেন, উৎসর্গপত্রে। ‘ছবি ও গান’ - কাব্যগ্রন্থের নাম । কার উদ্দেশ্যে এই ‘মালা’ সেটা সহজবোধ্য । কাদম্বরী দেবী। বৌদিদিকে নিয়ে যত না কবিতা রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, তার থেকেও অনেক বেশি কাঁটাছেড়া করেছেন বর্তমানের বিশেষজ্ঞরা। তাদের অনেকেই নিজেদের রোমান্টিকতার চশমা দিয়ে যা দেখেছেন, তাই লিখেছেন বটে, কিন্তু ‘চরণে’ উৎসর্গ করার ব্যাপারটা কি তারা খেয়াল করেছেন? চরণে উৎসর্গ তাকেই করা যায় যিনি অসীম শ্রদ্ধার পাত্র। শ্রদ্ধামিশ্রিত ভক্তিমাখা ভাষায় যাকে অর্পণ করা হল, তার ওপর কোনরূপ কোন মুখচুম্বনের দাবী উঠতে পারে কি? পারে। সে মমতামিশ্রিত প্রশ্রয়ের চুম্বনের মধ্যে যৌনতার ঘোলাটে স্বাদ পাওয়ার লোভ আর যারই থাকুক না কেন, রবীন্দ্রনাথ কিম্বা কাদম্বরী দেবীর ছিল না । এই কাব্যগ্রন্থটি আমার কাছে সেতুর মতো মনে হয়। এর পরবর্তী কাব্যগ্রন্থ থেকেই দেখা যায়, রাবীন্দ্রিক সিগনেচার পড়তে শুরু করেছে। কবির মতে, “ ভাষা

ঘনিয়ে এল ঘুমের ঘোর...

Image
  “ রাত কত হল ? উত্তর মেলে না । কেননা , অন্ধ কাল যুগ - যুগান্তরের গোলকধাঁধায় ঘোরে , পথ অজানা , পথের শেষ কোথায় খেয়াল নেই । ”   অনেক রাতে আমার ঘুম ভেঙে যায়। আমার চারপাশ রহস্যময়ী তামসী তপস্বিনী রাত্রি ঘিরে রেখেছে । নিশীথিনীর রঙ কালো । এই কালরাত্রির কোন রূপ নেই। রাত্রিনাম্নী এই কালভৈরবিনী নীরব, নিস্তব্ধ। আস্তে আস্তে আমার চেতনায় দ্যুতি ফিরে আসে। নিশাচরের সকরুণ ডাকে আমি তন্দ্রাবিলাস থেকে জাগ্রত চেতনার দ্যোতনায় ফিরে আসি। আমি জেগে উঠি। আধো ঘুম আধো জাগরণে আমার শরীর শান্ত, মন সজাগ, আত্মা ধীর, স্থির, সদাসর্বদার মতো জাগ্রত। আমি শুয়ে শুয়েই চোখ নামাই আমার পায়ের কাছে। নাইটির আবরণে ঢাকা সুউচ্চ দুই চূড়ার মধ্যবর্তী উপত্যকার ফাঁক দিয়ে আমার পা-দুটো দেখা যায়। কি করে? জানালার ফাঁক দিয়ে ঢুকেছে আলো, এসে লুটিয়ে পড়ছে আমার অনাবৃত পায়ের আঙ্গুলের ফাঁকে ফাঁকে। রূপার আঙট ঝলসে উঠছে মাঝে মাঝে, আমার পদঙ্গুলিহেলনে । তন্দ্রাজড়িত মায়ানেশায় আমি তাকাই আমার চারদিকে। কালো আর তত কালো নয় এখন। অন্ধকারেরও আলো আছে। আমার মাথার কাছে কে? আমার আলুলায়িত চুলের গোছার ফাঁক দিয়ে আলতো করে টেনে টেনে হাত বুলিয়ে