আমার মা, বুড়োর মা আর সঞ্জীবের মা

 


একটা গন্ধ আমাকে ঘিরে থাকে, মায়ের গায়ের গন্ধসে গন্ধ আমি চোখ বুজলেও টের পাই। যেখানেই থাকি না কেন, যে অবস্থাতেই থাকি না কেন, একবার মনে করলেই গন্ধটা তার অস্তিত্ব নিয়ে আমাকে ঘিরে ধরে। আমাকে আদরে আদরে ভরিয়ে দেয়।

কিছুকাল আগের ঘটনা। আমার তখন ধুম জ্বর। গা পুড়ে যাচ্ছে। মাথায় অসহ্য যন্ত্রণা। বড়ো অস্থিরতা। ঘুমহীন রাতসকালে মা আমার মাথার কাছে এসে বসল। সদ্য স্নান করে পুজো দিয়ে এসেছে। আমাকে দেখতে এসেছে। মায়ের গায়ে আমার গা ঠেকল। কি ঠান্ডা তার শরীরটা! আমি হাঁচোড় পাঁচোড় করে মা-কে জড়িয়ে ধরলাম। মায়ের বুকের মধ্যে আমার মুখ গুঁজে দিলাম। আমার কপাল তার বুকে ঠেকল। আঃ! কি শান্তি। আমাকে মা ঠেলে সরিয়ে দিল না। আমাকে একটু জড়িয়ে ধরল। তার ভেজা হাত দুটো দিয়ে পরম মমতায় আমার মুখে, গলায় বুলিয়ে দিল। শান্তি শান্তি শান্তি...

আমার কান মায়ের ঠিক বাম বুকে। আমার মুখ ডুবে গেছে বর্ষাকালের নরম কচি ঘাসের নিবিড় কবুতর উষ্ণতায়আর সেখান থেকে আমি শুনতে পাচ্ছি একটা ছন্দ --- “কানের কাছে মায়ের হৃৎপিন্ড ধুকধুক করছে।” আমার হৃৎপিন্ড মায়ের হৃৎপিন্ডের সাথে তাল মেলাতে থাকেসে ছন্দের এক মাধুর্য আমাকে নিমেষে টেনে নিয়ে গেল সব জ্বালা যন্ত্রণার পাড়েআমি ঘুমিয়ে পড়লাম। যতক্ষণ ঘুমিয়েছিলাম, মা স্থির হয়ে বসেছিল। একটুও নড়াচড়া করে নি।

মায়েরা কি এমনই হয়? আমি মা হলে কি এমনই হব? মনে হয় না। আমার বুকের মধ্যে এমন মমতা ভগবান দেন নি। মায়ের কাছে ধার চাইলে তিনি কি একটু দেবেন না? ২৫%...???

সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায় আজীবন অনেক লেখা লিখেছেন। অধিকাংশই লোকে মনে রাখবে না। যে কয়টা মনে রাখবে তাও কয়েক দশক বাদে হয়তো বা বিস্মৃতির অতলে হারিয়ে যাওয়ার উপক্রম করবে। কেবল একটা উপন্যাসের হারিয়ে যাওয়া উচিৎ না।

ইতি তোমার মা

কারণ ওটা সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায় নিজে লেখেন নি। দেবী সরস্বতী তার কলমে নিজের নখাগ্র ঠেকিয়েছিলেন। মানুষের পক্ষে এ লেখা সম্ভব নয়। সেই সময় সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায় মানুষ ছিলেন না। তিনি সরস্বতীর বরপুত্র হয়ে গিয়েছিলেন।

কিশোর উপন্যাস প্রচুর লেখা হচ্ছে। কিশোর উপন্যাস একটাও লেখা হচ্ছে না।

ইতি তোমার মা সেই কিশোর উপন্যাস, যা আমাকে আমার মায়ের স্পর্শ দিতে পারে। এ উপন্যাস আমি দরজা-জানলা বন্ধ করে পড়েছি, আমি চাইছিলাম না, আমার চোখের জল কেউ দেখুক; এ উপন্যাস পড়ার সময় আমার ফোন বন্ধ করে রেখেছি, আমি চাইছিলাম না, আমার কান্নাভেজা গলা অন্য কারো কানে যাক; এ উপন্যাস আমি গভীর রাত্রে পড়েছি, আমি চাই নি মা-কে চেনবার সময় সময় আমার বিরুদ্ধে চলে যাক। মা-কে চিনতে গভীর রাতই তো উপযুক্ত সময়। মা, তুমিই রাত্রি, তুমিই নিশা, তমশা, তমস্বিনী, তমিস্রা তুমিই শুদ্ধ, বুদ্ধ, নির্মোহ তুমিই এক, আবার তুমি-ই বহু হয়েছ তুমিই আমি, আমি-ই তুমি।

আমার মা সব জানে। আমার মা সব পারে।

এর মানে এই নয় যে, বইটায় শুধুমাত্র মা-ছেলের সম্পর্ক আছে। একটা পরিবার, যে কিনা নিজগুণে সমৃদ্ধ, সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায় তাকে আদর্শ রূপ দান করতে চেষ্টা করেছেন। আছেন আদর্শ বাবা, ঠাকুর্দা, পাড়ার ছেলে এবং ডাক্তারবাবু কিম্বা জেলে থাকা এক ইংরাজী বলা-কওয়া পুরাতন ভৃত্য। কিন্তু, বাস্তব এমন নয়। না হোক। এক কিশোরের প্রকৃত মানুষ হয়ে ওঠার পথে এমন আদর্শ চরিত্রগুলো যদি মনের মধ্যে ছাপ না ফেলা যায়, কোন কিশোর প্রকৃত মানুষ হয়ে উঠতে পারে কি?

মা যখন অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে, মুখটা এত সুন্দর দেখায়! আমার মুখটা যদি মায়ের মতো হত। টানা-টানা দুটো ভুরু। সেই ভুরু দুটো এখন ধনুকের মতো বেঁকে গেছে। চোখ দুটো মা দুর্গার মতো। চাঁপাফুলের মতো গায়ের রঙ। ... আমার মাকে আমি কখনও নোংরা জামাকাপড় পড়তে দেখিনি। সব সময় পরিস্কার। কোন কিছু নোংরা অপরিস্কার দেখলে মা ভীষণ রেগে যায়। ... আমার মায়ের পা দুটো কী সুন্দর। ফর্সা ধপধপে। পাতলা। যেন মাটির সঙ্গে মিশে আছে। ... আমার চুলে মায়ের হাত খলবল করছে। কানে চুড়ির টিংটিং... মায়ের মাথায় কী সুন্দর চুল! কালো কুচকুচে। একটু কোঁকড়া-কোঁকড়া। সব দিক থেকে আমার মা এত ভাল! এমন মা আর কারো নেই।” --- এ কোন মায়ের কথা বলছেন সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়? এ তো বুড়োর মা নয়, এ তো আমার মা!

মা কালী, আমার এই সুন্দর মা কে একশো বছর বাঁচিয়ে রাখো মা।

আমার মা আর বুড়োর মা --- এক হয়ে যাচ্ছে। আবার আলাদা হয়ে যাচ্ছে। একে সবাই। সবাইতে এক।

সব সময় সোজা পথে চলবে। সমস্ত ব্যাপার বুদ্ধি দিয়ে নয় হৃদয় দিয়ে বোঝার চেষ্টা করবে। রোজ আয়নার সামনে কিছুক্ষণ দাঁড়াবে। ... চিন্তাই মানুষ। একা থাকবে না। কাজকে সঙ্গী করবে। ... সবুজের ঘরে থাকলে মানুষ চির সবুজ থাকে। দিতে শিখবে, নিতে নয়। ‘আমি আমি’ করবে না। ‘আমি’ বলে কিছু নেই। সবই  ‘তুমি’। ভেতরটাকে বড়ো করলে বাইরেটা বড়ো হয়। নকল থেকে আসল বেছে নিতে শেখো। ... প্রতিষ্ঠা মানে সত্যের প্রতিষ্ঠা। ঐশ্বর্য হল চরিত্র। যুদ্ধ হল নিজের সঙ্গে। জয় হল নিজেকে জয়। ...

বিদায়। অনেক ভালোবাসা। জল নয়, আগুন। --- ইতি তোমার মা।

আমার কি চিঠিটা মনে থাকবে? আজ থেকে এক মাস পরে?

হয়তো বা, হয়তো না।

কিন্তু আমি মনে ঠিক জানি...

আমার একটা মা আছে।

সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায় আমাকে আর সে সত্যটা ভুলতে দেবেন না।

==========================

ইতি তোমার মা

সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়

আনন্দ পাবলিশার্স

মুদ্রিত মূল্যঃ ২৫০/-

ছবি কৃতজ্ঞতাঃ সুমন দাস, সমর্পিতা

Comments

Popular posts from this blog

যে বুকে আগুন জ্বলে

জেরক্স কপির উন্নত ভার্সানে ‘আবার প্রলয়’ এসেছে

শারদীয়া আনন্দবাজার পত্রিকা সম্পর্কে