ঘনিয়ে এল ঘুমের ঘোর...
“রাত কত হল?
উত্তর মেলে না।
কেননা, অন্ধ কাল যুগ-যুগান্তরের গোলকধাঁধায় ঘোরে, পথ অজানা,
পথের শেষ কোথায় খেয়াল নেই।”
অনেক রাতে
আমার ঘুম ভেঙে যায়। আমার চারপাশ রহস্যময়ী তামসী তপস্বিনী রাত্রি ঘিরে রেখেছে। নিশীথিনীর
রঙ কালো। এই কালরাত্রির কোন রূপ নেই। রাত্রিনাম্নী এই কালভৈরবিনী
নীরব, নিস্তব্ধ। আস্তে আস্তে আমার চেতনায় দ্যুতি ফিরে আসে। নিশাচরের সকরুণ ডাকে
আমি তন্দ্রাবিলাস থেকে জাগ্রত চেতনার দ্যোতনায় ফিরে আসি। আমি জেগে উঠি। আধো ঘুম
আধো জাগরণে আমার শরীর শান্ত, মন সজাগ, আত্মা ধীর, স্থির, সদাসর্বদার মতো জাগ্রত।
আমি শুয়ে
শুয়েই চোখ নামাই আমার পায়ের কাছে। নাইটির আবরণে ঢাকা সুউচ্চ দুই চূড়ার মধ্যবর্তী
উপত্যকার ফাঁক দিয়ে আমার পা-দুটো দেখা যায়। কি করে? জানালার ফাঁক দিয়ে ঢুকেছে আলো,
এসে লুটিয়ে পড়ছে আমার অনাবৃত পায়ের আঙ্গুলের ফাঁকে ফাঁকে। রূপার আঙট ঝলসে উঠছে মাঝে
মাঝে, আমার পদঙ্গুলিহেলনে। তন্দ্রাজড়িত মায়ানেশায় আমি তাকাই
আমার চারদিকে। কালো আর তত কালো নয় এখন। অন্ধকারেরও আলো আছে।
আমার মাথার
কাছে কে? আমার আলুলায়িত চুলের গোছার ফাঁক দিয়ে আলতো করে টেনে টেনে হাত বুলিয়ে
দিচ্ছে কে? তার স্নেহের পরশ পাই, তাকে পাই না। সে আমায় জাগাতে চায়। সে চায়, আমিও
তার মতো আমার ঘুমের দরজা ঠেলে ঢুকে পড়ি তার জগতে। যে জগত দেখা-অদেখার, জানা-অজানার
এক অতীত শিলালিপি। হারিয়ে গেছে সে জগতের বাসিন্দারা...
তাই কি? না
তো!
আমার পায়ের
কাছে বিছানা ঘেসে তারা এক এক করে আসে, দাঁড়ায়, চলে যায়। মাথার কাছের মানুষটা আমার
কানের কাছে ঠোঁট রাখে। তার উষ্ণ নিঃশ্বাস আমার গলায়, ঘাড়ে। ফিসফিসিয়ে সে বলে চলে
সামনে এক এক করে চলে যাওয়া আগন্তুকের নাম, ধাম, আর পরিচয়...
রব গ্রিয়ে,
ভলতেয়ার, ইয়েট্স, বঙ্কিমচন্দ্র, ক্রিস্টোফার মার্লো, পল এল্যুয়ার, শেলী, এডগার
এলান পো, অরুণ মিত্র, রোমাঁ রোল্যাঁ ও মাদলেন, মপাসাঁ, ভার্জিনিয়া উলফ্... আরও
আরও কত মানুষ... তারা জীবনের চিহ্ন রেখে গেছেন তাদের সৃষ্টিতে। তারা আছেন। তারাই
আছেন।
আমার মাথার
কাছে তুমি কে? কে তুমি আমায় চিনিয়ে দিচ্ছ এইসব কালাতীত মহামানবদের? কালের গন্ডী
ছাড়িয়ে জ্যোতিভূষণ চাকী তোমায় যাদের চিনিয়েছিলেন এককালে, কালের দরজা ঠেলে অনেক পথ
উজিয়ে এসে কি পরম মমতায় তুমিও আবার আমায় চিনিয়ে দিতে চাইছ সেইসব কালপুরুষদের? আর
তাই সেইসব সিংহরাশির জাতকেরা, সময়ের দরজা ঠেলে, চন্দ্রিমার পথ বেয়ে নেমে আসে আমার
পায়ের কাছে। কে তুমি? আমাকে বারবার ফিসফিসিয়ে বলে চলো, এদের ভুলো না। এদের না
চিনলে তুমি নিজেকে চিনবে কি করে?
তুমি চিন্ময়
গুহ। চিনেছি তোমায়।
তুমি নিজের
ঘুমের দরজা ঠেলে একের পর এক ঘর খুলে দিচ্ছ। প্রত্যেক ঘরে এক-এক জ্যোতিষ্ক। কোথাও
বা জ্যোতিষ্কমণ্ডলী। তুমি প্রত্যেক অধ্যায়ে এক-একজন করে চিনিয়ে দাও আমাকে। তারা
কে, কি বা সেই জ্যোতি; কোন তারকাই বা আত্মহত্যা করেছিল, আর কাকেই বা হত্যা করা
হয়েছিল; কে কবিতায় মুড়ে দিয়েছে গোটা পৃথিবী, আর কারই বা মহাউপন্যাস জীবৎকালে কল্কে
পায় নি; কোন ধুমকেতু হাতের নাগালে এসেও চলে গিয়েছিল চেতনসীমার বাইরে; কিম্বা কোন
উল্কা আছড়ে পড়ে নড়িয়ে দিয়েছিল তাবৎ মহাপৃথিবীকে।
ঘুমের দরজা
ঠেলে তুমি আমাকে নিয়ে চলেছ অতীতে। যেখানে বালক মায়াকোভস্কি উচ্চৈস্বরে কবিতা
আওড়ায়। প্যারিসের সমাধিক্ষেত্রের মধ্যে আমাকে নিয়ে হাটতে হাটতে এক এক করে তুমি
চেনাও সার্ত্রে, সিমোন দ্য বোয়াভেরা, মার্সেল প্রুস্ত, শার্ল বোদল্যের, মাজারিনকে।
কখনও কখনও অন্ধকার রাত্রি বেয়ে নেমে আসেন আঁরি মিশো, নীৎসে, শোপেনহাওয়ার, ফিলিপ
সিডনি। তোমার হাত ধরে তারা এসে দাঁড়ায় আমার সামনে। অবন
ঠাকুর ছবি আঁকেন। জাক প্রেভের কবিতা বলেন। সিলভিয়া প্লাথ তার ফেটে যাওয়া
চূর্ণ-বিচুর্ণ মাথা নিয়ে নীরবে শুয়ে থাকেন আমার দিকে বিষন্নভার মায়াদৃষ্টি নিয়ে।
আর সত্যজিৎ রায় সখেদে বলে ওঠেন, “এই না হলে সভ্যতা... একটি সুইচ টিপে...”। সভ্যতার
এই মহাসংকটে দেখি রবীন্দ্রনাথকে, দেখি গ্যোয়েটেকে, তলস্তয়কে, শেক্সপীয়রকে। তুমি
চিনিয়ে দাও তাদের, একে একে, সবাইকে।
তাদের সামনে
এসে নতজানু হই আমি। চিন্ময় গুহ আমাকে নিয়ে আসেন এক টুকরো অতীতের সামনে। যারা একদিন
বেঁচেছিল। যাদের জন্য আজ আমরা বেঁচে আছি। ভবিষ্যতেও বেঁচে থাকব।
তারা নীরবে
আমার চোখের দিকে চেয়ে থাকেন। তাদের প্রত্যেকের চোখে একটাই কথা --- কিন্তু তবুও,
মানুষের ওপর বিশ্বাস হারানো পাপ।
একটা আলোর
প্রদীপ, ক্ষীণকায়, কিন্তু জ্বলে। তারা চান, আমি সেই ক্ষীণকায়াকে আলোকবর্তিকাকে
আমার নগ্ন হাতে ধরে পথ চলতে থাকি। চলতে থাকি তাদের পথ বেয়ে, যে পথ সমুখে, যে পথ
শান্তি পারাবারের পথ, শিশুতীর্থের পথ...
=============================
ঘুমের দরজা ঠেলে
চিন্ময় গুহ
সিগনেট প্রেস
মুদ্রিত মূল্যঃ ৩০০টাকা
[কবিতা কৃতজ্ঞতাঃ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর]
[ছবি কৃতজ্ঞতাঃ সমর্পিতা]
দরজার ওপারে কি ঘুম আছে ? door-bell নেই বোধহয়।
ReplyDeleteআপনি কোনদিন দরজা দেখেছেন? না মনে হয়
Deleteদু-পয়সার সস্তা দরের প্রচারের জন্য শিল্পের নামে যা কিছু একটা করে দিলেই হল। নাকি ? কাগজে হিজিবিজি কেটে দিলেই সেটা শিল্প হয়ে যায় না, কোন art-gallery তে স্থান পাওয়া যায় না। আচ্ছা, আপনারা বই পড়ে গবেষণা করে একটা ভাল প্রবন্ধ তো ছাপতে পারেন। আসলে বই পড়ে কি হবে তাঁর চেয়ে ভাল বইয়ের ছবি দিয়ে পোচার করি। এই blogspot-এই তো তা অত্যন্ত ভালভাবে করা যায়।
ReplyDeleteএসো পোচার করি, এসো পোচার করি ! যত্তসব
এককথায় 'আপনি ফালতু বকছেন'
Deleteএককথায় 'কাটা ঘায়ে নুনের ছিটে'
Delete