ছবি ও গান – রবীন্দ্রনাথ ও কাদম্বরী দেবী

আমার রবীন্দ্রনাথ - ১১



গত বৎসরকার বসন্তের ফুল লইয়া এ বৎসরকার বসন্তে মালা গাঁথিলাম। যাঁহার নয়ন-কিরণে প্রতিদিন বসন্তের এই ফুলগুলি একটি একটি করিয়া ফুটিয়া উঠিত, তাঁহারি চরণে ইহাদিগকে উৎসর্গ করিলাম।

রবীন্দ্রনাথ লিখছেন, উৎসর্গপত্রে। ‘ছবি ও গান’ - কাব্যগ্রন্থের নামকার উদ্দেশ্যে এই ‘মালা’ সেটা সহজবোধ্যকাদম্বরী দেবী। বৌদিদিকে নিয়ে যত না কবিতা রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, তার থেকেও অনেক বেশি কাঁটাছেড়া করেছেন বর্তমানের বিশেষজ্ঞরা। তাদের অনেকেই নিজেদের রোমান্টিকতার চশমা দিয়ে যা দেখেছেন, তাই লিখেছেন বটে, কিন্তু ‘চরণে’ উৎসর্গ করার ব্যাপারটা কি তারা খেয়াল করেছেন?

চরণে উৎসর্গ তাকেই করা যায় যিনি অসীম শ্রদ্ধার পাত্র। শ্রদ্ধামিশ্রিত ভক্তিমাখা ভাষায় যাকে অর্পণ করা হল, তার ওপর কোনরূপ কোন মুখচুম্বনের দাবী উঠতে পারে কি? পারে। সে মমতামিশ্রিত প্রশ্রয়ের চুম্বনের মধ্যে যৌনতার ঘোলাটে স্বাদ পাওয়ার লোভ আর যারই থাকুক না কেন, রবীন্দ্রনাথ কিম্বা কাদম্বরী দেবীর ছিল না

এই কাব্যগ্রন্থটি আমার কাছে সেতুর মতো মনে হয়। এর পরবর্তী কাব্যগ্রন্থ থেকেই দেখা যায়, রাবীন্দ্রিক সিগনেচার পড়তে শুরু করেছে। কবির মতে, “ভাষায় আছে ছেলেমানুষি, ভাবে এসেছে কৈশোর” ছবি ও গানের মধ্যে সেই সিগনেচারের আভাস আছে। শুধু তাই নয়, রবীন্দ্রনাথ পুর্বোক্ত কাব্যগ্রন্থগুলোতে কেবলমাত্র নিজেকে নিয়ে যতটা আবিষ্ট ছিলেন, এখানে তা আস্তে আস্তে লোপ পাচ্ছে। শুধু তাই নয়, আশেপাশের মানুষজনের আনন্দ-বেদনার পরশ পাচ্ছেন। যার প্রথম সোপান অবশ্যই কাদম্বরী দেবী।

রবীন্দ্রনাথের মা যখন চলে যান, তখন তার বয়স মাত্র ১৪। এই মানুষটি তার পূর্ববর্তী কাল কাটাচ্ছেন জোড়াসাঁকোর ভৃত্যসন্নিধানে। সেখানে শাষনের বাঁধন আছে বটে, কিন্তু মাতৃকোমলতা নেইসেইকালে শিশুমাত্রই যে ধরণের আশ্রয় এবং প্রশ্রয় আশা করে, তা কেবল তার মায়ের কাছ থেকেই পেতে পারে, রবীন্দ্রনাথ তা থেকে বঞ্চিত। আমার মনে হয়, পরবর্তীকালে এই মাতৃস্নেহের অভাবের প্রভাব তার সমগ্র জীবন এবং লেখাতে পড়েছে। তার লেখায় মাতৃ-আবেগ অনেক বেশি মাত্রায় সংযত। ব্যতিক্রম – গল্পগুচ্ছ। এমতাবস্থায় সেই অভাবের পূরণকারী হতেই পারতেন জ্ঞানদানন্দিনী দেবী, কিন্তু তা হয় নি; রবীন্দ্রনাথ সেই প্রশ্রয় ও আশ্রয় পেয়েছিলেন কাদম্বরী দেবীর কাছ থেকে। আর পাওয়া মাত্রই তাকে আঁকড়ে ধরতে চেয়েছেন। বহুদিনের স্নেহের যে বুভুক্ষা তার বুকের ভেতরে ছিল, তা কাদম্বরী দেবীর মধ্যে দিয়ে পেয়েছিলেন। এর আরেকটা বড়ো কারণ বয়স। জ্ঞানদানন্দিনী দেবী আর জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর সমবয়সী ছিলেন, এবং রবীন্দ্রনাথ ও কাদম্বরী দেবী। ফলে তাদের নিজেদের মধ্যে বন্ধুত্ব তৈরী হওয়াটা অনেক বেশি স্বাভাবিকী ক্রিয়ার মধ্যেই পড়ে।

আমার মনে হয়, যখন এই সময়টা এল, তখন তার যৌবন কাল। এর কিছুদিনের মধ্যেই তার বিবাহ হবে। পরবর্তীকালে প্রমথ চৌধুরীকে লেখা এক চিঠিতে পড়ি, “আমার ‘ছবি ও গান’ আমি যে কি মাতাল হয়ে লিখেছিলুম তোমার চিঠি পড়ে বোঝা গেল তুমি সেটা সম্পূর্ণ বুঝতে পেরেছ এবং মনের মধ্যে অনুভবও করচ। তাই তখন দিনরাত পাগল হয়ে ছিলুম। আমার সমস্ত বাহ্যলক্ষণে এমন-সকল মনোবিকার প্রকাশ পেত যে তখন যদি তোমরা দেখতে তো মনে করতে এ ব্যক্তি কবিত্বের ক্ষ্যাপামি দেখিয়ে বেড়াচ্চে। আমার সমস্ত শরীরে নবযৌবন যেন হঠাৎ বন্যার মতো এসে পরেছিল। আমি জানতুম না আমি কোথায় যাচ্ছি আমাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে। একটা বাতাসের হিল্লোলে একরাত্রির মধ্যে কতকগুলো ফুল মায়ামন্ত্রবলে ফুতে উথেছিল, তার মধ্যে ফলের লক্ষণ কিছু ছিল না।

‘মনোবিকার’ কিম্বা ‘নবযৌবন’ বলতে তিনি কি বলতে চাইছেন তা দিনের আলোর মতো স্পষ্ট। এখন এই মনোবিকলনের প্রথম প্রকাশ কার ওপর হতে পারে? যে সবচেয়ে কাছে আছে তারএতএব রবীন্দ্রনাথের নবযৌবনের ঢেউ সেই স্নেহকাতরতা পুরণকারী নারীকেই সামলাতে হবে - “কেহ কি আমারে চাহিবে না? / কাছে এসে গান গাহিবে না? /  পিপাসিত প্রাণে চাহি মুখপানে / কবে না প্রাণের আশা?” (জাগ্রত স্বপ্ন)

অন্যদিকে কাদম্বরী দেবীও একা। তার স্বামী থেকেও যেন নেই। জোঁড়াসাকোর ঠাকুর পরিবারের অন্যান্যদের কাছ থেকে কোন নৈকট্য পান না। তাদের ধারণা, তিনি অহংকারী, নাকউঁচু। একাকী এই নারীর বয়সও বেশি নয়, তার ওপর সদ্য বিবাহিত। নবযৌবনের বেগ তার শরীরে, মনে। রবীন্দ্রনাথের কি তা চোখে পড়ে নি? “ওই জানালার কাছে বসে আছে / করতলে রাখি মাথা / তার কোলে ফুল পড়ে রয়েছে, / সে যে ভুলে গেছে মালা গাঁথা” (সুখসপ্ন) ফলে একজনের কৌতুহল এবং আরেকজনের একাকীত্ব দুজন দুজনের পরিপূরক করে তুলল। তার সাথে যুক্ত হল দুজনেরই সাহিত্যের প্রতি টান। একজন সাহিত্য সৃষ্টি করেন, আরেকজন হন তার প্রকৃত সমঝদার। রবীন্দ্রনাথের রবীন্দ্রনাথ হয়ে ওঠার সময় এমন সমঝদার আর দুটি পেয়েছিলেন কি?

কিন্তু একটা সীমা পর্যন্তইদুজনেরই সেই সীমা অতিক্রম করার চেষ্টামাত্র করেন নি। কাদম্বরী দেবী স্নেহাতুরা হয়ে বন্ধুর মতো মিশেছেন, রবীন্দ্রনাথ তার স্বকীয়তা দিয়ে কাব্যে নিজেকে বাঁধ দিয়েছেন। ফলে দুজনের সেতুবন্ধনে একের পর এক সৃষ্টি হয়েছে ছবি ও গানের কবিতা।

প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়ের মতেএই অসামান্য নারী ছিলেন যেমন অভিমানিনী, তেমনি সেন্টিমেন্টাল এবং আরো বলিব ইন্ট্রোভার্ট, স্কিজোফ্রেনিক[রবীন্দ্রজীবনী ১/১১৯] শেষ দুটো বিশেষণই আমাকে ভাবিয়েছে বেশি এই ধরণের মানুষের মনের গহীনে যে কি পরিমাণ উথাল পাথাল চলে, কত বিভিন্ন বিষয়ে গভীর অণুসন্ধিৎসুপ্রবণ মন হয়, তা গবেষণার বিষয় রবীন্দ্রনাথের মনের সঙ্গে ঠিক এই জায়গাতেই তার সংযোগ হয়েছিল এবং বাকি জীবন অন্যান্য মানুষের মধ্যে এমন গভীর ভাবপ্রবণ মন এবং স্বতঃপ্রণোদিত হৃদয়কে তিনি আর পাননি সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে দেখতে গেলে হওয়ার কথাও নয়

কাদম্বরী দেবী এবং রবীন্দ্রনাথের মধ্যে কি সম্পর্ক ছিল তা নিয়ে ভাবতে গেলে তাদের সম্পর্কের দিনগুলোতে ঠিক কি কি রচনা রবীন্দ্রনাথ করেছিলেন সেদিকেই বেশি জোর দিতে হবে কিম্বা পরবর্তীকালে চিথিপত্রের মধ্যেও তার আভাস মেলে ‘ছবি ও গান’ কাব্যগ্রন্থই, আমার মনে হয়, তার প্রথম সোপান

প্রমথ চৌধুরীকে লিখছেন, “আমার বোধ হয় মেয়েরা আপনার পূর্ণতা অধিক অনুভব করে (এইজন্যে তারা যাকে তাকে ভালোবেসে সন্তুষ্ট থাকতে পারে) পুরুষরা আপনার অপূর্ণতা অধিক অনুভব করে এইজন্যে জ্ঞান বল, প্রেম বল কিছুতেই তাদের অষন্তোষ ঘোচে নাএই কারণেই কি রবীন্দ্রনাথ আজীবন নিজেকে তাড়িয়ে নিয়ে বেরিয়েছেন অপুর্ণতা থেকে পূর্ণতার দিকে? আর কাদম্বরী দেবী রবীন্দ্রনাথের মধ্যে নিজের আত্মিক পূর্ণতা পেয়েছিলেন? দেহগত অসম্পূর্ণতা সেই আত্মিক সম্পূর্ণতার পরিপূরক হওয়াতেই কি তিনি রবীন্দ্রনাথের বিবাহের পর মনে করলেন, তার জীবনের এখানেই ইতি টানা উচিৎ? কারণ, এরপর আর কিছু নেই কিছু থাকতে পারে না যদিও আরও অনেক কারণ কানাঘুষোয় শোনা যায়, কিন্তু কাদম্বরী দেবীর ক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথের বিবাহ পুণরায় যে অসম্পূর্ণতার দিকে তাকে ঠেলে দিয়েছিল, তার থেকে পরিত্রাণের অন্য কোন পথ না পাওয়ার কারণেই কি এই সিদ্ধান্ত? অথবা, স্কিজোফ্রেনিক এক মানুষ সঠিক চিকিৎসা এভং যত্নের অভাব তাকে এই পথ বেছে নিতে তরান্বিত করে?

আর সেই ইঙ্গিতই কি রবীন্দ্রনাথ দিয়েছেন ‘তারকার আত্মহত্যা’ নামক কবিতায়? এর উত্তর খুঁজতে যাওয়ার কোন মানে আজ আর হয় না কারণ, উত্তর দেওয়ার মতো কোন তথ্য আমাদের হাতেই নেই কেবলমাত্র কতকগুলি কল্পনা পচা ডোবার বিষাক্ত জলের মতো আমাদের মনকে বিষাক্ত করবে, আর বিকৃত কিছু মানুষের আমোদের কারণ হবে, যার কোনটাই আমাদের ক্ষেত্রেও যেমন মানায় না, তেমন রবীন্দ্ররনাথেরও প্রাপ্য নয়

 

==========================

ছবি কৃতজ্ঞতাঃ সমর্পিতা

Comments

Popular posts from this blog

যে বুকে আগুন জ্বলে

জেরক্স কপির উন্নত ভার্সানে ‘আবার প্রলয়’ এসেছে

শারদীয়া আনন্দবাজার পত্রিকা সম্পর্কে