তুঙ্গা-র এক গণ্ডূষ শরদিন্দু পান

 


সলমন রুশদী আমাকে টেনে এনে ফেললেন তুঙ্গভদ্রার তীরে। তুঙ্গার জল পান করে উঠে দেখলাম আমি শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের সামনে দাঁড়িয়ে আছি। আর তার পেছনে মহারাজ দ্বিতীয় দেবরায়, অর্জুনবর্মা আর বলরাম

শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায় এবং সলমন রুশদী --- দুজনেই সোজামাটা গল্প বলেছেন। দুজনেই জানেন কীভাবে গল্প পরিবেশন করতে হয়। সেদিক থেকে দুটো লেখাই একদম ফ্ল্যাট লেখা, চড়াই উতরাই যতটুকু আছে তা রাস্তার বাম্পারের মতো, জটিলতায় যাওয়ার আগেই মিলিয়ে যায়। দুটো উপন্যাসের মধ্যেই গভীর ভাবোদ্দীপক কিছু খুঁজতে যাওয়া বৃথা। দুই লেখকের লেখনী এই পর্যায়ে সেই স্তরের নয়। কিন্তু তবুও, তুলনায় সলমন রুশদীর লেখা সমসাময়িক। তার কারণ, তিনি উপন্যাসটা লিখছেন ২০২৩ সালে। তাকে শারদীয়া সংখ্যার নির্দিষ্ট শব্দসংখ্যায় সীমাবদ্ধ কোন উপন্যাস লিখতে হচ্ছে না, কিম্বা তার কেবলমাত্র বাঙালী পাঠকের কাছে লেখাটা পৌছানোর দায় নেই। তার লেখার মূল ভিত্তি Magic Reality। শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের অস্ত্র Historical Fiction

কিছু লেখক আছেন, যারা তাদের বাক্যবিন্যাসে একেবারে মিছরি-মাখন লাগিয়ে পরিবেশন করেন। এত সুন্দরভাবে যে গল্প বলা যায়, এত সুচিন্তিত অথচ অমোঘ কিছু শব্দ, বিশেষত বিশেষণ এবং সর্বনাম, তা জাস্ট ভাবা যায় না। রাজকুমারী বিদ্যুন্মালার বর্ণনার কথাই ধরা যাক না --- “আঠারো বছর বয়সের বিদ্যুন্মালার আকৃতির বর্ণনা করিতে হইলে প্রাচীন উপমার শরণ লইতে হয়। তন্বী, তপ্তকাঞ্চনবর্ণা, পক্কবিম্বাধরোষ্ঠী, কিন্তু হরিণীর ন্যায় চঞ্চলনয়না নয়। নিবিড় কালো চোখ দু’টি শান্ত অপ্রগল্‌ভ; সর্বাঙ্গের উচ্ছলিত যৌবন যেন চোখ দু’টিতে আসিয়া স্থির নিস্তরঙ্গ হইয়া গিয়াছে। তাঁহার প্রকৃতিতেও একটি মধুর ভাবমন্থর গভীরতা আছে যাহা সহজে বিচলিত হয় না। অন্তসলিলা প্রকৃতি, বাহির হইতে অন্তরের পরিচয় অল্পই পাওয়া যায়।” পড়তে পড়তে আমার ঘাড় আপনা থেকেই ড্রেসিং টেবিলের আয়নার দিকে ঘুরে গেল। একটা মোটা হতকুচ্ছিত অবয়ব চোখে পড়ল, যার চোখের প্রগলভ্‌তা চশমার মোটা কাঁচ ভেদ করেও দেখা যায়। একটা সুবিশাল দীর্ঘনিঃশ্বাস পড়ল। আর যাই হোক, এ জন্মে আমার কোনভাবেই শরদিন্দু-র নায়িকা হওয়া হবে না। শরদিন্দুর নায়িকা হতে গেলে অন্তত দশ বছর ‘কিটো ডায়েট’ করতে হবে। ততদিনে বয়স থাবা মেরে রবীন্দ্রনাথের ‘সাধারণ মেয়ে’ বানিয়ে ছেড়ে দেবে, তখন --- “আমি অত্যন্ত সাধারণ মেয়ে। / মূল্যবানকে পুরো মূল্য চুকিয়ে দিই / এমন ধন নেই আমার হাতে।

অদ্ভুতভাবে আমার সাথে মন্দোদরীর কি মিল! “...মন্দোদরী ওড্রদেশের মেয়ে। বয়স অনুমান চল্লিশ, গায়ের রঙ গব্য ঘৃতের মতো; নিটোল নিভাঁজ কলেবরটি দেখিয়া মনে হয় একটি মেদপূর্ণ অলিঞ্জর।” আহা! সাধারণ মোটা মেয়েকেও কত সুন্দরভাবে বর্ণনা করা যায় রে ভাই! আবার আমি তাকালাম, আয়নার দিকে... তাকিয়ে মনে হল কি মিল কি মিল! বঙ্গদেশের অধিকাংশ কবি-লেখকদের নায়িকারা একই রকম। কিন্তু অপর মেয়েদের, বিশেষ করে স্থূলকায়া নারীদের নিয়ে চটুল রসিকতাটা পাঠক এমনকি পাঠিকাদের বেশ উপভোগ করতে দেখেছি, এমনকি সিরিয়াল-সিনেমাতেও। যাক গে, মনের কথা মনেই থাক। আমাকে আবার এই মওকায় কেউ ধুমসী নারীবাদী বলে দেগে দিক আর কি!

‘তুঙ্গভদ্রার তীরে’ অধিকাংশ বাঙালী বইপ্রেমিকের পড়া। অধিকাংশ বাংলা বইয়ের গ্রুপে শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের জনপ্রিয়তা আকাশছোঁয়া। বেঁচে থাকলে লেখকের নিজেরই পিলে চমকে যেত। এমন বেড সাইড স্টোরি তার মতো কয়জন লেখক লিখতে পেরেছেন?

তবে জনপ্রিয়তা তো আর এমনি এমনি হয় না। আমি দুপুরে তুঙ্গভদ্রার তীরে নিয়ে বসলাম। টানা পড়ে মাঝরাত্রে শেষ করলাম। পাঠককে ঠায় বসিয়ে রাখা, মুগ্ধ করে রাখা, তার আবেগকে নিজের শব্দের মায়াময় সুরে আটকে রাখা, কটা লেখক পারেন? শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায় পারেন। মূল চরিত্রগুলো একে একে জীবন্ত তো হয়ে ওঠেনই, এমনকি, তাদের পাশের ছোট ছোট চরিত্রগুলোকেও ভোলা যায় না। ভোলা কি যায় দাসী পিঙ্গলা, অনিরুদ্ধ কিম্বা মঞ্জীরাকে? দেবী পদ্মালয়াম্বিকা, চিপিটকমামা, বেঙ্কটাপ্পা বা চতুর্ভুজ নায়ককে? এরাই বরং সশব্দ উপস্থিত থেকে উপন্যাসকে সম্পূর্ণ করার কাজ করেছেন। এরাই সর্বাঙ্গসুন্দর করেছেন অর্জুনবর্মা, বিদ্যুন্মালা, মণিকঙ্কনা, মহারাজ দেবরায় কিম্বা বলরাম কর্মকারকে। দুই বৃদ্ধ দামোদর স্বামী এবং রসরাজ বৈদ্য বেঁচে থাকুন চিরকাল। এরা প্রত্যেকেই পার্শ্বচরিত্র, কিন্তু মূল চরিত্রগুলোর ‘শেড’ হিসাবে এসেছেন। আর তাতেই তাদের কি মহিমা! মাত্র কয়েকটা বাক্যের কাঠামোয় নিখুঁত চিত্রায়ণ! তারা মূল চরিত্রগুলোকে ছায়ায় মায়ায় সম্পূর্ণ করেছেন।

আর যে চরিত্রগুলো ছিলই না। তাদের উপস্থিতিও কি মধুর বেদনাময়! আমি ভুলতে পারি না সেই বাক্যটাকে --- “দেবদাসী তনুশ্রী গৌড়নিবাসী শিল্পী মীনকেতুকে কামনা করিয়াছিল।” আর তারপরের সেই একটা স্তবক। যেন পারিজাত ফুলের গুচ্ছ। যে বাতাসে ভেসে চলেছে অবহেলে, কিন্তু তার সুগন্ধ ছড়িয়ে গেছে এমনভাবে, যে, উপন্যাস শেষ হওয়ার পরেও, আমি যখন এই লেখাটা লিখছি, তার গন্ধ সুতীব্র মর্মবিদারক --- “দেবদাসী তনুশ্রীকে কেহ মনে রাখে নাই, কিন্তু তাহার ব্যর্থ কামনা পাষাণফলকে কালজয়ী হইয়া আছে। ইহাই কি সকল ব্যর্থ কামনার অন্তিম নিয়তি।

আহা!

আমি কতবার যে ‘আহা আহা’ করেছি গুনি নি। আমার চোখের সামনে সমস্ত কিছুর অভিনয় হয়ে গেল, নাটকের মতো, সিনেমার মতো। শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা এই চরিত্রগুলো রামায়ণের মতো। অহেতুক জটিল আবর্তের মধ্যে তাদের কেউ-ই পড়ে নি। যদিও বা পড়েছেন, চট্‌ করেই সমাধান যেন লেখকের কলমের জোরে আপনিই এসে পথ করে নিয়ে তাদের এগিয়ে নিয়ে গেছে। ফলে সুপাঠ্য হয়ে উঠেছে। বারবার পড়ার মতো হয়ে উঠেছে। আমাকে এ উপন্যাস আবার পড়তে বললে আবার পড়তে পারি। এমন মধুর ভাববিন্যাস খুব লেখায় পাওয়া যায়। গল্পের চোরাটানে আমি বই ছাড়তে পারি না। কফির কাপ শুকিয়ে যায়। সন্ধ্যা নেমে আসে, অর্জুনবর্মা অন্ধকারে তুঙ্গভদ্রার জলে ঝাঁপ দেন। আমিও ঝাঁপ দিই...

ইতিহাসকেও সময়মতো আনছেন তিনি। তবে রুশদীর মতো ইতিহাসকে ছায়ায় মায়ায় মিশিয়ে মহাকব্যিক দ্যোতনার ম্যাজিকে পেশ তিনি করেননি। ১৪৩০ খ্রীষ্টাব্দের আশেপাশের সময়কালকে এঁকেছেন, যখন রুশদীর রাষ্ট্রমাতা এক জঙ্গলে নিদ্রাতুর হয়ে অজ্ঞাতবাস করছিলেন। হুক্ক-বুক্ক-র রাজ্যপ্রতিষ্ঠার প্রায় সোয়াশো বছর পরের কাহিনী, যার অধিকাংশেরই কোন তথ্য নেই। দ্বিতীয় দেবরায়ের সময়ে বিজয়নগরের সুবর্ণ যুগ শুরু হয় নি। কিন্তু সে তার প্রতিষ্ঠা পেয়ে গিয়েছিল। ঠেকিয়ে রেখেছিল বাহমনী সাম্রাজ্যকে নদীর পরপারে।

ইতিহাস যেখানে পা রাখতে অক্ষম শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের চেতনা সেখানে উড়ান দেয়। তৈরী করে মায়ামোহন রোমান্স। সেখানে রাজকন্যা সাধারণ সেনাকে বিয়ে করে। রাজা যেন রামায়ণের যুগ থেকে উঠে আসা দয়াশীল পূণ্যবান সম্রাট। সেখানে নতুন করে আবিস্কার হয় রণ-পা আর বন্দুকের সুবৃহৎ সংষ্করণ। রাজা আর রাজদূতের পাশাপাশি রোমান্টিকতার জাল সঞ্চারিত হয় বলরাম-মঞ্জীরার মধ্যেও। না হলে কি রাজবিবাহের পাশাপাশি আরোও দুটো বিয়ে হওয়া সম্ভব, একই মঞ্চে? বাস্তবে সম্ভব না। কিন্তু শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায় সম্ভব করেছেন। আমার কাছে অসম্ভব বলে মনে হয় না। মনে হয়, বাঃ বেশ তো --- তিন-তিনটে বিয়ে! এ কি চাট্টিখানি কথা!

এ উপন্যাস তুঙ্গভদ্রার স্মৃতিকথা। “যেখানে স্মৃতি নাই, সেখানে ইতিহাস নাই। আমরা আজ তুঙ্গভদ্রার স্মৃতিপ্রবাহ হইতে এক গণ্ডূষ তুলিয়া লইয়া পান করিব।

আমি পান করলাম। আমার হৃদয় জুড়াল। আমার মন তৃপ্ত হল। আমার ভাষা সমৃদ্ধ হল...

বিঃ দ্রঃ – ১৩৬ পৃষ্ঠা হার্ডকভার বইয়ের বর্তমান মূল্য ৩৫০ টাকা! মনে হল যেন কুমার কম্পনদেব আনন্দের ট্যাঁকশালে উপস্থিত আছেন। আমার কাছে যে পুরাতন কীটদ্রষ্ট বইটা আছে, একসময় তার মূল্য ছিল ৫০টাকা। আনন্দের বই আমার কাছে এখন বিষামৃতের মতো লাগে...

===================================

তুঙ্গভদ্রার তীরে

শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়

আনন্দ পাবলিশার্স

মুদ্রিত মূল্যঃ 350/-

কবি কৃতজ্ঞতাঃ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

ছবি কৃতজ্ঞতাঃ সমর্পিতা

Comments

Popular posts from this blog

যে বুকে আগুন জ্বলে

জেরক্স কপির উন্নত ভার্সানে ‘আবার প্রলয়’ এসেছে

শারদীয়া আনন্দবাজার পত্রিকা সম্পর্কে