ছবি ও গান – অভিযোজনের পথে

আমার রবীন্দ্রনাথ - ১২




‘ছবি ও গান’ কাব্যগ্রন্থটা আমার কাছে কেমন যেন সেতুবন্ধনের মতো লাগে। এর পূর্ববর্তী কবিতাগুলো কেমন যেন খাপছাড়া। অন্তরের তাগিদ স্পষ্ট, বহির্মুখী দৃষ্টিশক্তি ক্ষীণ। ‘ছবি ও গান’-এর রবীন্দ্রনাথ আস্তে আস্তে আমাদের চিরপরিচিত রবীন্দ্রনাথ হয়ে ওঠার দিকে যেন যাচ্ছেন। তার যে ‘সিগনেচার’ ছন্দে, বাক্যে এবং লেখার মর্মবোধে --- যেন মনে হয়, উক্ত কাব্যগ্রন্থটা সেই হয়ে ওঠার দিকনির্দেশ করছে

এই কাব্যগ্রন্থের প্রথম কবিতাটাই ধরা যাক। “আমার প্রাণের পড়ে চলে গেল কে / বসন্তের বাতাসটুকুর মতো’ --- এখনও রোমান্টিক গানগুলোর মধ্যে অগ্রগণ্য একটা গান, যার রচনা কবিতা হিসাবে এই কাব্যগ্রন্থে! অথচ এটি উক্ত কাব্যগ্রন্থের প্রথম কবিতা। ‘কে?’ শীর্ষক এই কবিতার সুরটিও চমৎকার। সমগ্র গানটাতে সুর কিন্তু ফেরে না। স্রোতের মতো গানটা চলতেই থাকে। একেবারে শেষে এসে প্রথম চরণটিকে পুণরায় গেয়ে গানটির উপসংহার টানা হয়। এমন গান বিরল। অন্তত রবীন্দ্রসঙ্গীতে।

প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, ছবি ও গানের প্রথম সংস্করণ ঘাটলে দেখা যায়, প্রথম কবিতা ছিল ‘আজু সখি মুহু মুহু’, যা পরবর্তীকালে ‘ভানুসিংহের পদাবলী’তে স্থান পায়। একই অবস্থা হয় শেষ গানটির ক্ষেত্রেও, দ্বিতীয় সংস্করণে ‘মরণ রে তুঁহু মুম শ্যামসমান’ কবিতাটি বাদ দেওয়া হয়, এবং ওটিরও স্থান হয় পুর্বোক্ত কাব্যগ্রন্থে।

“আমার সমস্ত বাহ্যলক্ষণে এমন-সকল মনোবিকার প্রকাশ পেত যে তখন যদি তোমরা আমাকে প্রথম দেখতে তো মনে করতে এ ব্যক্তি কবিত্বের ক্ষ্যাপামি দেখিয়ে বেড়াচ্ছে।” ক্ষেপামিগুলো কীরকম? “কেহ কি আমারে চাহিবে না? / কাছে এসে গান গাহিবে না? / পিপাসিত প্রাণে চাহি মুখপানে / কবে না প্রাণের আশা? / চাঁদের আলোতে দখিন বাতাসে / কুসুমকাননে বাঁধি বাহুপাশে / শরমে সোহাগে মৃদুমধুহাসে / জানাবে না ভালোবাসা?” এমনকি কবিতা লেখার আবেগে এমন সমস্ত শব্দ ব্যবহার করছেন, হয়তো বা তার মানেও হচ্ছে না, কিন্তু তবুও ছন্দের অভিঘাতে অর্থটা বুঝতে অসুবিধা হচ্ছে না – “ওর মুখেতে পড়েছে সাঁঝের আভা, / চুলেতে করিছে ঝিকিমিকি / কে জানে কী ভাবে মনে মনে / আনমনে চলে ধিকিধিকি।” ধিকিধিকি করে চলে যাওয়া যায়? কে জানে রে বাবা সে কিরকম চলা! স্খলিত পদে চলার কথাই কি ছন্দের প্রয়োজনে এমনভাবে এসে গেছে? এমনকি কবি সানন্দেই তার ব্যবহার করেছেনপরবর্তীকালে এডিট করার প্রয়োজন বোধ করেননি। অন্যদিকে “আমারে বাসিস কেন পর” কিম্বা “শয্যার পায়ের কাছে খেলেনা ছড়ানো আছে,” এমন লাইন কিম্বা শব্দ একটু কানে লাগে, কিন্তু সমগ্র কবিতার ছন্দের প্রয়োজনে খুব সুন্দরভাবে সহাবস্থানও করে।

‘সুখস্বপ্ন’, ‘জাগ্রত স্বপ্ন’, ‘দোলা’, ‘আদরিণী’, ‘বিদায়’, ‘আবছায়া’, ‘স্নেহময়ী’, ‘অভিমানিনী’ ইত্যাদি কবিতাগুলোর মধ্যে যে চরিত্রটি ফুটে উঠছে তা কিন্তু রবীন্দ্রনাথের আপন মনের মাধুরী মিশানো এক নারী, যাকে তিনি চাইছেন আন্তরিকসেই সঙ্গে তার রূপ তিনি দেখতে চাইছেন আশেপাশের কোন চরিত্রের মধ্যে দিয়ে। বলা বাহুল্য, এই সময় তার ঘনিষ্ঠ ছিলেন একমাত্র কাদম্বরী দেবী। ফলে সমগ্র ব্যক্তিগত চাহিদার রূপরেখা তাকে ঘিরেই তৈরী হয়েছে, এবং, খুব ভালো করে দেখলে বোঝা যাবে চরিত্রগুলোতে কাদম্বরী দেবীর ছাপ স্পষ্ট। সেই কারণেই কি কাব্যগ্রন্থের উৎসর্গপত্রে তাকে ছাড়া আর কারো কথা মনে আসে নি?

তবে শুধুমাত্র তার নিজের এই প্রেমের জোয়ার নয়, তার চোখে আশেপাশের মানুষজনও পড়ছে প্রকৃতি ও মানুষ --- এই দুই বিষয়ই যে তার ভবিষ্যৎ রচনার ভিত্তিভূমি হবে, তার আভাস পাওয়া যায়। ‘একাকিনী’, ‘গ্রামে’, ‘খেলা’, ‘ঘুম’, ‘যোগী’ ইত্যাদি কবিতাগুলো সেই সমস্ত কিছুরই ব্যক্তরূপ।

এই ক্ষ্যাপামিটা সম্ভবত চোখে পড়েছিল সকলেরই। এমনটা বললে অত্যুক্তি হবে না যে, পরিবারের প্রায় সর্বক্ষেত্রেই তার বিবাহের কথা আলোচনা হতে শুরু করে। পাত্রী দেখা শুরু হয়, এবং অবশেষে মৃণালিনী দেবীকে তার পছন্দ হয়, যদিও এ ব্যাপারে কোন তথ্যপ্রমাণ মেলে না। রবীন্দ্রনাথ নিজেও তার সমগ্র জীবনে কোথাও এ কথা স্বীকার করে যান নি। যদি সেটাও সত্য বলে ধরে নেওয়া যায়, তাহলে কি একথা বলতে হবে যে, কাদম্বরী দেবীর সাথে যে গভীর মানসিক নৈকট্যের সম্পর্ক ছিল, তা উনি মৃণালিনী দেবীর কাছে আশাও করেছিলেন, কিন্তু পরবর্তীকালে পান নি; আবার মৃণালিনী দেবীর কাছে যে শারীরগত নৈকট্য পেয়েছিলেন, তা কাদম্বরী দেবীর কাছ থেকে পাওয়ার কোন সম্ভবনা ছিল না বলে বিবাহে অসন্মতিও জানান নি; এমনকি, হয়তো এই দ্বন্দ্বের চুড়ান্ত যন্ত্রণাময় রূপ চোখে পড়েছিল মহর্ষির কিম্বা জ্ঞানন্দানন্দিনী দেবীর, কিম্বা অন্যান্য অনেকের; ফলে পরবর্তীকালে আমরা দেখতে পাই, কাদম্বরী দেবীর মৃত্যুর সাথে সাথে একসাথে তিনজন একাকী দ্বীপের মতো হয়ে পড়েন। জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রায় বিচ্ছিন্ন জীবন যাপন করেন রাঁচীর পাহাড়েরবীন্দ্রনাথ সমগ্র জীবনে এমন কাউকেই আর পেলেন না, যে তার কবিসত্ত্বাকে অনুভব করতে পারবে। সারাজীবনে তার কোন স্নেহময় বন্ধুবৃত্ত তৈরীই হল না। মানবিক এই মনোবিকলনের কথা অনেকের সাথে সাথে মৃণালিনী দেবীও টের পেয়েছিলেন। কোন সময়েই রবীন্দ্রনাথের শৈল্পিক সহায়ক হিসাবে তাকে দেখতে পাওয়া যায় না।

রবীন্দ্রনাথের বিয়ে হয় ১২৯০ সালের ২৪শে অগ্রহায়ন। ‘ছবি ও গান’ প্রকাশিত হয় একই বছরের ফাল্গুনে। বিবাহ পরবর্তী এই কাব্যগ্রন্থ, যেখানে রবীন্দ্রনাথের কবিহৃদয়ের নির্মান হচ্ছিল, সেই সময়েও তার স্ত্রী-কে মনে পড়ছে না। মনে পড়ছে কাদম্বরী দেবীকে। যিনি প্রকৃত অর্থে রবীন্দ্রনাথের রবীন্দ্রনাথ হয়ে ওঠার সময়ে তার লেখার পেছনের গভীর বোধের কট্টর সমালোচক ছিলেন, তার অনুভূতির উথাল পাথাল টানাপোড়েনে সংযমের বাঁধ হয়েছিলেন, এমনকি কোথাও কোথাও মানবিক ও শারীরিক প্রবল আবেগের উচ্ছ্বাসের নিয়ন্ত্রকও ছিলেন।

‘ছবি ও গান’ সব মিলিয়ে রবীন্দ্রনাথের এমন এক অদ্ভুত সময়ের দলিল, যে সময় সম্ভবত তার নিজেরও এক জটিল টানাপোড়েনের আবর্তে থাকার সময়। সে সময়ে তিনি এতটাই অসহায় ছিলেন তা কহতব্য নয়। তার কাব্যগ্রন্থে সেই ছাপ থাকলেও, ছন্দে, সুরে ও রচনায় কখনই মনে হয় না যে, এ পাঠকের কবিতা নয়, কবির ব্যক্তিগত আলেখ্য। এখানেই কাব্যগ্রন্থটি তৎসময়ের দাবীকেও ছাপিয়ে গিয়ে আজও একইভাবে আদরণীয় হওয়া উচিৎ ছিল। দুর্ভাগ্য, পরবর্তীকালে তার অসংখ্য স্মরণীয় লেখার মাঝে এই কবিতার অনেকগুলোই বিরলে রয়ে গেছে।

একটা কারণ, তার পুরাতনী ভাষা; একটা কারণ, কিছু লেখা পরবর্তীতে গীতবিতানে স্থান পাওয়া; আর একটা কারণ, তার উদাসীনতা।

======================

ছবি কৃতজ্ঞতাঃ সমর্পিতা

Comments

Popular posts from this blog

যে বুকে আগুন জ্বলে

শারদীয়া আনন্দবাজার পত্রিকা সম্পর্কে

জেরক্স কপির উন্নত ভার্সানে ‘আবার প্রলয়’ এসেছে