না রাধা না রুক্মিণী

 

অমৃতা প্রীতমকে চিনি তার কবিতা দিয়ে। আহা! কি সমস্ত তার কবিতা! একটা যেমন---

तुम मिले
तो कई जन्म
मेरी नब्ज़ में धड़के
तो मेरी साँसों ने तुम्हारी साँसों का घूँट पिया
तब मस्तक में कई काल पलट गए

কেমন যেন ‘বাজিল বুকে সুখের মতো ব্যথা’, আমার মনে হয় এমনভাবে কোন মেয়ে যখন বলে ওঠে তখন পুরুষের বুকের ভেতরে কি এমনি রকমই উথাল-পাথাল চলে? কি জানি, আমি মেয়ে নই, আমি জানি না। অমৃতা মেয়ে, অমৃতা কবি, অমৃতা জানে, অমৃতা শব্দগুলোর মধ্যে দিয়ে কেমন ছন্দে ছন্দে অনুভূতিগুলোকে সাজায়, রঙের পরতে পরতে যেমন একজন চিত্রকর চিত্রনির্মাণ করে, ঠিক তেমনিভাবেই। অমৃতার জীবন কবিতা, অমৃতার কথা কবিতা, এমনকি অমৃতার উপন্যাসও কবিতা...

না রাধা না রুক্মিণী — উপন্যাসটি আদতে উপন্যাস নয়। এক কাব্যোপন্যাস। অমৃতা এখানে কোন মেয়ের কথা লেখেননি, লিখেছেন একজন পুরুষের কথা — কৃষ্ণ (হরেকৃষ্ণ), একজন চিত্রকর, যার জীবনে না রইল রাধা, না পেল রুক্মিণীকে।

কিন্তু শুধু এই কি গল্প? না তো! অমৃতা এমন সহজ-সরল গল্প লেখেন না। অমৃতা যার গল্প লিখছেন তিনি একজন চিত্রকর, যার ছবি দেশে-বিদেশে সমাদৃত। ফ্রান্স, রাশিয়া, আমেরিকা — কোথায় না কোথায় তার এক্সিবিশন হয়েছে, এমন একজন চিত্রকরের জীবনের জটিলতা কি শুধুমাত্র দুটি নারীচরিত্র বা তার টানাপোড়েন দিয়ে শেষ হবে? কদাপি নয়। একজন কবি বহুদর্শী, আর এই বহুদর্শিতাই তাকে নিয়ে গেছে রাধা বা রুক্মিণীর পাশাপাশি অনেক অনেক সহজীবনে। যারা ছিল, আজ আর নেই, হারিয়ে গেছে, ফুরিয়ে গেছে।

অমৃতার কাগজের ক্যানভাসে হরেকৃষ্ণ যেন এক পোর্ট্রেট। তাকে এঁকেছেন শব্দবন্ধে। নিয়েছেন কেবল একটি রাত্রি। আর সেই রাত্রি শুরু হচ্ছে কেমনভাবে?

“...সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে হঠাৎ পঞ্চম সিঁড়িতে এসে পা থেমে যায় হরেকৃষ্ণের...
      না থামে না, থমকে যায়...
      সামনে আকাশের হাতে দুধে টইটম্বুর একটা বাটি... বাটি থেকে উপচে উপচে পড়ছে দুধ... সিঁড়ি ভেসে যাচ্ছে...”

এক পূর্ণিমার রাত্রি। চাঁদের আলো এসে পড়েছে ঠিক পাঁচ নম্বর সিঁড়ির পর থেকে, ভাসিয়ে দিচ্ছে বাকি সিঁড়িগুলো। এক চিত্রকর দেখছেন, পূর্ণিমা... চাঁদের আলো... শুভ্র জ্যোৎস্না... এক বালতি দুধ... সিদ্ধির সরবত... তারা তিন বন্ধু...

চিত্রকর এমনভাবেই ধাপে ধাপে পৌঁছে যায় তার অতীতে, আর এক অসামান্য উপন্যাস জন্ম নিতে থাকে। উপন্যাসের এক-একটা লাইন অনেক কথা বলে। অমৃতা তার শব্দবন্ধে যে গদ্য রচনা করছেন, তাতে ভরে দিয়েছেন কবিতার মূল উপপাদ্য — সীমার মাঝে অসীম অনুভূতি। চিত্রকর সিঁড়ি দিয়ে উঠতে থাকে, কুড়ি নম্বর সিঁড়িতে এসে মনে পড়ে, ঘটনাটা কুড়ি বছর আগের। আর তার সাথে সাথেই “পূর্ণিমার রাতে হরেকৃষ্ণের মন লাগামছাড়া হয়ে যায়...”

অমৃতা অনেক লাইন এক লাইনে লিখে ফেলেন। এখানেও তাই... এক-একটা পর্ব খুব বড়ো নয়, অথচ ভেতরের প্রতিটা লাইন অনেক অনেক বড়ো... পড়তে পড়তে একজন নিঃসঙ্গ চিত্রকরের জীবনের ছন্দটাকে খুঁজে পেতে থাকি অনেক চড়াই-উতরাইয়ের মধ্যে দিয়ে। প্রতিবেশী যে মুসলমান দম্পতি একদিন হারিয়ে যায় দেশভাগের রাজনীতিতে সেই বাড়ির উঠোনটা নেমে আসে হরেকৃষ্ণর ঘরের মেঝেতে। সে মেঝেতে বাচ্চা হরেকৃষ্ণ সায়নী চাচীর সুরের তালে তালে নাচতে থাকে, আল্লারাখি তাকে বুকে জড়িয়ে নাতের বোলের রেওয়াজ করে, বিব্বো তার রুক্মিণী হতে অপারগ হয়, সাহির একের পর এক নজ়্ম বলতে বলতে চুপ করে যায়, আফতাব তাকে শায়েরি শুনিয়ে যায় একটার পর একটা অক্লান্তভাবে, বিমল এসে তাকে কাঁধে তুলে নেয় — এমন আরো কত কি ঘটে যেতে থাকে... আল্লারাখি, ঈশ্বর কৌর, বিব্বো, ইলা, মিন্নি... বারে বারে আসে, বারে বারে যায় ফিরে... হরেকৃষ্ণর হৃদয়ঘট ভরে দিয়ে যায়, হরেকৃষ্ণকে শূন্য করে দিয়ে যায়...

অনেক ধন্যবাদ মুকুল বন্দ্যোপাধ্যায়কে, অনুবাদে উপন্যাসের এই কাব্যধারাকে একই রকমভাবে বজায় রাখার জন্য। শ্রীমতী বন্দ্যোপাধ্যায় অধ্যাপিকা, দীর্ঘদিন অনুবাদের কাজে যুক্ত আছেন শুধু তাই নয়, উচ্চপ্রশংসিত এবং বহুবার সম্মানিতও। এই অনুবাদ পড়তে পড়তে বুঝতে পারছিলাম তার কারণটা। একসময় পড়তে পড়তে মনে হয়, মুকুলই অমৃতা, অমৃতাই মুকুল, আবার কোথাও দু’জনেই হরেকৃষ্ণ।

=========

না রাধা না রুক্মিণী
অমৃতা প্রীতম
অনুবাদিকাঃ মুকুল বন্দ্যোপাধ্যায়
ন্যাশনাল বুক ট্রাস্ট (NBT)
মুদ্রিত মূল্যঃ ৩৫.০০

 

Comments

Popular posts from this blog

যে বুকে আগুন জ্বলে

শারদীয়া আনন্দবাজার পত্রিকা সম্পর্কে

জেরক্স কপির উন্নত ভার্সানে ‘আবার প্রলয়’ এসেছে