জেরক্স কপির উন্নত ভার্সানে ‘আবার প্রলয়’ এসেছে

 


জেরক্স করতে করতে, জেরক্স করতে করতে, জেরক্স করতে করতে একটা-দুটো ঝকঝকে ভালো প্রিন্ট বের হয়ে আসে। রাজ চক্রবর্তীর ‘প্রলয়’ পর্ব তেমনই একটা উদাহরণ। টিভি সিরিয়াল ‘প্রলয় আসছে’, কিম্বা ‘প্রলয়’ সিনেমার পরে, ওয়েব সিরিজ ‘আবার প্রলয়’ তার একটা বড়ো উদাহরণ।

বিষয়ঃ সুন্দরবনে Human Trafficking - বড় মর্মস্পর্শী বিষয়, এমনিই দর্শক টানবেকিন্তু কলকাত্তাইয়া ভাষা দিয়ে কি সোঁদরবনের ভাষা চালানো যায়? কানে বড়ো লাগে যে! এ যেন একতারাতে বেথোভেনের নবম সিম্ফনি। ফলে যা হওয়ার তাই হল। ঋত্বিক, গৌরব কিম্বা কৌশানীর বাচনভঙ্গি ‘ঘেটে ঘ’ হয়ে গেল। নাট্যব্যক্তিত্ব হওয়ার সুবাদে সোহিনী যাও বা একটু আধটু চালাচ্ছিল, কিন্তু থানার মধ্যে কিম্বা শেষের দিকে যখন সব চরিত্রেরা মুখোমুখি হতে থাকল, তখন কথ্যভাষা হাস্যকর হয়ে দেখা দিল।

যেটা বলছিলাম। মেয়েদের চুরি করা হচ্ছে সুন্দরবনেসেখানকার মেয়েদের প্রেমের ফাঁদে জড়িয়ে রাতারাতি কলকাতা বা অন্যত্র দিয়ে অন্য জায়গায় মেয়েদের পাচার করে দেওয়ার যে ভয়ঙ্কর র‍্যাকেট, তারই শেষ করতে ক্রাইম ব্রাঞ্চের অনিমেষ দত্ত ওরফে শাশ্বত-র সুন্দরবনের আগমন। টিটাগড়ের ভগ্ন কারখানায় হোক, কিম্বা নৌকার ওপর, শাশ্বত যে ঠিক কার স্টাইলে মার দেন বোঝা যায় না। কেবল একটা কথাই বোঝা যায়, ভদ্রলোকের একটা মারও মাটিতে পড়ে না, এবং সব সময়েই ধোপদুরস্থ থেকেই মারামারির অবসান ঘটান।

অ্যাকশন ফিল্ম বাঙালীদের দ্বারা কোনদিনই হবে না। উত্তম কুমারও পারেন নি, দেব কিম্বা জিৎ-ও পারেন না, ভবিষ্যতেও পারবে বলে মনে হয় নামাঝখান থেকে সাউথ ইন্ডিয়ান স্টাইল নিয়ে এসে রাজ চক্রবর্তী এই অক্ষমতাটা চোখে আরও বেশি করে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছেন আর লোক হাসাচ্ছেন। অতিবড়ো সাউথ ইন্ডিয়ান পরিচালকও ভাবতে পারবেন না যে, যেখানে একগাদা পুলিশ ফোর্স ভেতরে ঢুকতে ভয় পাচ্ছে সেখানে, শাশ্বত তো ঢুকছেনই, উপরন্তু মার দেওয়ার সময় গুন্ডারা রাম দা নিয়ে তেড়ে আসছেন, অথচ দলের চাঁই মেয়েদের মাথায় বন্দুকের নল ঠেকিয়ে রঙ্গ দেখছেন! কোন দেশে এতোবড়ো গাম্বাট গুন্ডা থাকে? এমন গুন্ডা দলের সর্দারই বা হয় কি করে? রাজ চক্রবর্তী জানেন, তারা বাংলাতে থাকেন

গত দুবার পরাণ বন্দ্যোপাধ্যায় প্রায় পার্শ্বচরিত্র থেকে কেন্দ্রীয় চরিত্রে চলে এসেছিলেন, যেটা ছিল প্রলয় সিরিজের একটা বড়ো আকর্ষণ এখানে শাশ্বত-কৌশানী-গৌরবকে গুরুত্ব দিতে গিয়ে পরাণের চরিত্রটাকেই মাটি করেছেন। অনায়াসে ওনাকে বাদ দিয়ে অন্য কাউকে রাখা যেতেই পারতো। অন্তত দর্শকের দিক থেকে এতবড়ো মোহভঙ্গ হত না।

তবে, রাজ চক্রবর্তীর সিনেমায় একটা জিনিস বড়ো ভালো লাগে, সেটা হল, নবাগতদের দিয়ে অনেকটাই স্বাভাবিক অভিনয় করিয়ে নেওয়া। মোহিনী মা, শম্ভু বাবা এবং কানুর ছোটবেলাকার চরিত্রেরা, কিম্বা র‍্যাকেটের ছেলেদের, পাশাপাশি কিশোরী মেয়েদের অভিনয় বিশ্বাসযোগ্য লাগে। ভালো লাগে। সুন্দরবনের জলকাদার ভয়াবহতায় বড়ো সুন্দরভাবে তারা মানিয়ে যায়।

পার্থ ভৌমিককে মাইক হাতে চিল্লাতে দেখেছি, এবার অভিনয় করতে দেখলাম। বেশ ভালো। ভালো লাগল সায়নীকেও। যদিও তার কিছুই করার ছিল না। এরা দুজন এবং সোহিনী --- এই তিনজনেরই আসলেই সাপোর্ট দেওয়া ছাড়া আর কিছুই বিশেষ করার ছিল না। অথচ এদের ব্যবহার করা যেতে পারত আরেকটু অন্যরকমভাবেএই সিনেমায় নয়, অন্য অনেক সিনেমায়। দুর্ভাগ্য। তেমন সাহসী পরিচালক বোধহয় এই মুহূর্তে টলিউডে নেই।

ডায়ালগ রাজ চক্রবর্তীর একটা বড়ো অস্ত্র। এখানেও তাই। সৌভিক চক্রবর্তীর ডায়ালগ চমকে দেওয়ার মতো। মজাও লাগে, ভালোও লাগে। যখন অনিমেষ ওই শত্রুব্যুহে ঢুকতে চলেছেন তিনি বলছেন, “দুটো অ্যাম্বুলেন্স বাদে আর সকলের ছুটি, যাও বাড়ী যাও।” কিম্বা পাজামা-পাঞ্জাবী পরে বসেদের সাথে দেখা করতে গিয়ে বলছেন, “ভাগ্যিস আপনাদের ডিউটি আর অ্যানিভার্সারি একদিনে পড়ে নি।” মজা লাগার মতো কিছু কিছু ডায়লগই এই ওয়েব সিরিজের খোলা জানলা। আবার ততটাই হাস্যকর এর VFX–এর কাজগুলো। এত বাজে VFX যে জাস্ট কিচ্ছু বলার নেই। আমার দেখতে দেখতে হতাশ লাগছিল। আমরা টেকনিক্যালি কতটা পিছিয়ে রয়েছি! এবং সেইসাথে বিশেষ করে বলতে হয় পুলিশের মিটিং-এ ‘হিউম্যান ট্রাফিকিং’ নিয়ে প্রদর্শিত স্লাইডগুলো। ও দেখে মনে হয় যেন ক্লাস ফোরের বাচ্চাদের জন্য বানানো হয়েছে। তবে যদি স্বাক্ষর ও নিরক্ষর সকল সম্প্রদায় ও সকল ইকোনমিকাল ক্লাসের কথা ভেবে বানানো হয়, তাহলে মন্দ নয়।

গল্পে যেখানে অতীত-বর্তমানের টাইম শিফটিং হয়েছে সেখানেও কোথাও খুব স্মার্ট, কোথাও বা আবার চরম আনস্মার্ট। বারো বছরের সময়ের পার্থক্যে কিছুই কি আশাপাশের জনজীবনে পার্থক্য চোখে পড়বে না! এমনকি মণিকে নিয়ে হারু পালিয়ে যখন সাঁতরে তীরে উঠল, তখন ঝকঝকে দিনের আলোকে খানিকটা ফেইন্ট করে ‘গ্যাটিস্‌’ দিতে পারলেও দূরে বনের জায়গায় ফ্ল্যাটের জঙ্গল বড়ো সহজেই ধরা পড়ে যায়। এমন অনেক একগাদা ত্রুটিতে ভর্তি এই সিরিজ তবুও দেখতে ভালো লাগে।

আবার চরিত্রের কপিগুলোও কেমন যেন ধরা পড়ে যায়। ঋত্বিক বেশ কিছু জায়গায় পরিস্কার কপি করছেন ‘Oh My God’-এর মিঠুন চক্রবর্তীকে। এমনকি গৌরব ও নুসরত ফারিয়ার ‘খেলা হবে’ নাচটা ‘পুষ্পা’র অল্লু অর্জুন ও সামান্থা রাউতের নাচের ব্যর্থ অনুকরণ মাত্র, দেখতে গেলে হাসিই পায় বেশি

ওয়েব সিরিজটা ভালো লাগে শাশ্বতর জন্য, খারাপ লাগে পরাণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের জন্য।

=======================

আবার প্রলয়

অভিনয়েঃ শাশ্বত চট্টোপাধ্যায়, পরাণ বন্দ্যোপাধ্যায়, ঋত্বিক চক্রবর্তী, কৌশানী মুখার্জী, সোহিনী সেনগুপ্ত, সায়নী ঘোষ, পার্থ ভৌমিক

পরিচালনাঃ রাজ চক্রবর্তী

OTT: ZEE5

 

Comments

  1. Ami free te akta episode youtube dekhechi..otai ses..dorkar porle abar purono tai dekhbo..jemon dekhi majhe majhe tao oei okhadhho dekhbo na.

    ReplyDelete

Post a Comment

Popular posts from this blog

যে বুকে আগুন জ্বলে

শারদীয়া আনন্দবাজার পত্রিকা সম্পর্কে