শারদীয়া আনন্দবাজার পত্রিকা সম্পর্কে

 



ন্যাঃ! শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের কোন পরিবর্তন হয় নি। এমন এক জায়গায় এসে কোপ বসালেন, ঠিক কি হল ঠাহর করতে না করতেই উপন্যাসটা শেষ হয়ে গেল। বেকুবের মতন কেমন যেন ঝিমধরা মাথা নিয়ে বসে রইলাম। তবে শেষ করেছেন বড়ই সুন্দরভাবে। আগেরগুলোর মতন হাবজি গাবজি একতাড়া অমীমাংসিত প্রশ্ন রেখে নয়। তবুও শেষ পাতায় এসে মুখ থেকে বেরিয়ে গেল, যাঃ **...!

 

“আমি এখন এক অন্ধকার প্রকোষ্ঠ। পা দুটো বুকের কাছে জড়ো করা, হাত দুটো মুষ্টিবদ্ধ হয়ে থুতনীর নীচে। আমার চোখদুটো বোজা, আমি কিছু দেখতে পাচ্ছি না। দেখার কিছু নেইও। তবে আমি শব্দ শুনতে পাই। ধুকপুক ধুকপুক।”

 

            শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের  লেখা পড়লে মনে হয় তার যেন বৃত্তের মতন উপন্যাস সম্পূর্ণ করার বাসনা থাকে না। কেবল থাকে বৃত্তপথের মাঝে মাঝে বেশ কিছু চোরাপথের বাঁক। আর সেই বাঁকে এসে পাওয়া যায় মণিমুক্তো। যেমনভাবে হঠাৎ করে পর্বশেষে এক নিরীহ গোবেচারারূপে ঈশ্বর আসেন আর নহুষের সাথে কথোপকথনের মাঝে পর্ব শেষ করেন।

 

“আহা, ভাল করে একটু খুঁজে দেখ না! আঁতিপাঁতি করে খুঁজে দেখ, নিজের ভিতর কিছু পাস কি না। খুব ডুব দিয়ে খোঁজ, তলিয়ে গিয়ে খোঁজ।”

 

তার উপন্যাসে পার্শ্বচরিত্রেরা আসে, যায়। মিনু, কামুদাদা, ব্রজবাবু বা তপন স্যারের মতন চরিত্রেরা কিম্বা ললিতা ঘোষ, সুপর্ণেরা আর ফিরে আসে না উপন্যাসের জাল আষ্টেপৃষ্ঠে বুনোট করে অহেতুক জটিলতার সৃষ্টি করার জন্য। বরং তারা উদাসীনের মতন একটু দেখা দিয়েই চলে যায়। রেখে যায় মূল চরিত্রের ওপর তাদের ছাপ। আর সেই ছাপের মধ্যে থেকে রূপ নেয় নহুষ ব্যানার্জি, রূপ নেয় ময়না রায়।

 

“চানাচুর খেয়েছিস তো! ... কত রকম লাগে বল তো! ডালমুট, ঝুড়িভাজা, বাদাম, গাঠিয়া। অনেক ভ্যারিয়েশন নিয়ে তবে না ফিউশন। একঢালা হলে কি হত ও রকম! রোজ যদি মিষ্টি খাস তবে জিভ অসাড় হয়ে যাবে। একটু টক ঝাল তেতোও তো লাগে। নাকি ভুল বললুম! আমাকে আর মানছে কে বল!”

 

শীর্ষেন্দুর গল্পে একটা আটপৌরে ভাব থাকে। ময়না তাই এত আটপৌরে। নহুষ আটপৌরে। তাদের চাওয়া পাওয়া সবটাই আটপৌরে। আর তাই জয়কে বা নীতাকে সরে যেতে হয়। ঈশ্বরের সামনে দাঁড়িয়ে থাকে কেবল ওরা দুজন।

 

সুব্রত চৌধুরী স্যার এই অবলাকে ক্ষমা করবেন। ছবিগুলো দেখিয়ে যেন বলতে চাইছেন, পড় উপন্যাসটা। এই দ্যাখ এসব আছে এতে। কিন্তু প্রচ্ছদে বা অলংকরণে এরকম লোভ দেখিয়ে পড়ানোর মতন উপন্যাস এটা নয়। শীর্ষেন্দুর উপন্যাসে পাঠক-পাঠিকাকে এমনভাবে টানা হ্যাঁচড়া করার প্রয়োজন পড়ে না।

তা বলে গপ্পোটা দারুন? ন্যাঃ! ধুম-ধাই-ধপাস --- শেষ। তবুও... ওই বলে না --- মরা হাতি লাখ টাকা।

 



“জীবন হল দীর্ঘ, নির্জন আর সাপের দেহের মতো শীতল এক নভেল।”


       ছোটবেলা থেকে যে ব্যপারটা আমাকে সবচেয়ে বেশি বিড়ম্বনায় ফেলেছে, তা হল আমার নাম। নামের প্রকৃত মানে জানার পর থেকে নামটাকে বেশ লজ্জাসহকারেই বহন করি। অপাত্রে দান হয়ে গেছে ভেবে কুন্ঠিত হয়ে খুঁজি এ নামের দোসর কি কেউ আছে?

না। আজ অবধি পাই নি।

নামের এই বিড়ম্বনা আমার প্রথম ঘোচালেন স্মরণজিৎ চক্রবর্তী। ওনার লেখা যখন হাতে এল, আর সেই সাথে ঊনিশ-কুড়ির পুরোনো ম্যাগাজিনগুলোতে চোখ বোলাতে লাগলাম, তখন মনে হল কোথায় লাগে আমার নাম! এ তো নামের এক অন্য ভুবন। আর কি সব নাম! ‘বোতামঘর’ নামক এই উপন্যাসেও তো জম্পেশ সব নাম ব্যবহার করেছেন --- মুসাফির, জুলু, অঞ্জল, সৌরসেন, বুচা, ওপালিনা, ফুটি। যদিও তার উদ্ভুত নামের জটাজালে আমরা এখন এতই অভ্যস্ত যে, স্বাভাবিক নাম দিলে বরং পাতা উলটে প্রথম পাতায় গিয়ে লেখকের নামটা একবার দেখে নেব, এটা স্মরণজিৎ চক্রবর্তীর লেখা তো?

কিন্তু, তবুও, এই উপন্যাসের চরিত্রদের জন্মসময়টা সত্তরের দশকের আশেপাশে। কলকাতা যতই কল্লোলিনী হয়ে থাকুক না কেন, ওই সময়ে দাঁড়িয়ে এই নামগুলো কি একটু বেমানান নয়?

নয় বোধহয়, স্মরণজিৎ চক্রবর্তী বলেই নয়।

 

আমার কিশোরী বয়সের খানিকটা স্মরণজিৎ চক্রবর্তীর কাছে গচ্ছিত আছে। তার লেখায় নামের বাইরেও স্কুল-কলেজ রোমান্স বা অফিস রোমান্স, বলা ভাল টিন-টুইন্স এজ রোমান্স, মানসিক টানাপোড়েন আর তাদের পরষ্পরের মধ্যেকার কথ্যভাষার অদ্ভুত ব্যবহার এমন সুন্দর করে আগে তো কেউ লিখতে পারে নি! মনে আছে সেই সময় চেয়ে চিন্তে তার অনেক উপন্যাস গোগ্রাসে পড়েছি। পড়তে পড়তে মনে হয়েছে, এ তো আমারই পাশের বাড়ীর গল্প বলছে। এ তো খুব চেনা সব চরিত্র।

আরেকটু বড়ো হয়ে দেখলাম, উপন্যাসগুলি আসলেই রিপিট টেলিকাস্ট। আমি এখন জানি তিনি কি লিখবেন। কিভাবে লিখবেন। কীভাবে গল্পের জাল বুনবেন। কিভাবে তার জট ছাড়াবেন। কিভাবে চরিত্রগুলো একে অন্যকে কাটাকুটি করে আবার যে যার গ্যারেজে ঢুকে যাবে। এবং সবশেষে পড়ে থাকবে, মনখারাপের স্মৃতি।

এখানেও তাই।

সেই মন খারাপ নিয়েই বলছি, হায় স্যার, আপনি নিজেকে ভাঙবেন কবে?

 

পরিশেষে বলি, দিনকয়েক আগের একটা পোস্টে যারা আমার বানান ভুল নিয়ে হামলে পড়েছিলেন, তাদের উচিৎ, এই উপন্যাসের বানান ও বাক্যগঠনে ভুলগুলো দেখে আতঙ্কিত এবং আশঙ্কিত হয়ে আনন্দ হাউসে গিয়ে মোমবাতি জ্বালিয়ে প্রতিবাদ করা।




“হঠাৎ ঝড় ওঠে, হঠাৎ বন্যা আসে, হঠাৎ করে ভূমিকম্প হয়। আরও কত যে ‘হঠাৎ’ আছে! থাকাই স্বাভাবিক। ‘হঠাৎ’ যে বেঁচে থাকার অঙ্গ। হঠাৎ কেউ অনাথ হয়, হঠাৎ দেশছাড়া। হঠাৎ কর্মহীন, হঠাৎ প্রেমে পড়া। তা হলে ‘হঠাৎ’কে এত গুরুত্ব কেন?” 


বাপ্পাদিত্য বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘অমৃত সন্ধানে’ শুরুই হচ্ছে এই কথাগুলো দিয়ে। 

এই প্রথম পূজাবার্ষিকীর এমন কোন উপন্যাস আমি পড়লাম, যেখানে বাস্তব সময়ের সাথে সাথে চরিত্রগুলো এগিয়ে চলেছে। এর পেছনে ফল্গুধারার মতো যে কাহিনী বিন্যাস তা খুবই সহজ। এক পরিবার, বাবা-মা-ছেলে-মেয়ে। বাবা অত্যন্ত সৎ, চরিত্রবান, মহাপুরুষতুল্য মানুষ। একদিন ধরা পড়ে স্কুলের বেশ কিছু টাকা তিনি চুরি করেছেন। কোন প্রতিবাদ না করে তার কয়েকদিনের মধ্যে তিনি উধাও হয়ে যান। আর তার খোঁজ মেলে না। একসময় ছেলে-মেয়েরা বড়ো হয়। এক ‘হঠাৎ’-এর সন্ধিক্ষণে হারানো ‘বাবা’কে খুঁজে পাওয়ার সম্ভবনা দেখা দেয়, এবং সেই সম্ভবনাকে কেন্দ্র করে সমগ্র পরিবারে একটা অদ্ভুত টানাপোড়েনের সৃষ্টি হয়।

না, আমি উপন্যাসটার জাস্ট শুরুটা বলেছি। হঠাৎ এই খোঁজ শুরু হয় জাস্ট করোনাকালীন পরিবেশ ও তার পরবর্তী প্রভাবকে কেন্দ্র করে। এবং আস্তে আস্তে ঘটনাপ্রবাহ এগিয়ে চলে পঞ্চলিঙ্গেশ্বর হয়ে কুম্ভমেলার দিকে। এবং করোনা পরবর্তী কুম্ভমেলার এক বিরাট পরিবেশের মধ্যে ছেলে-মেয়ের বাবাকে খোজার পাশাপাশি এক অন্তর্জগতের মনোবিশ্লেষন এগোতে থাকে কাব্যিক সুষমার হাত ধরে।

এই কাব্যিক সুষমা কতটা ছন্দোময় বা কতটা উপন্যাসের মূল প্রবাহকে গতি দিয়েছে? বেশ খানিকটা তো বটেই। আবার কোথাও মাঝে মাঝে অতিকাব্যিকতার চোরাবালিতে স্রোত আটকেছে। কখনও কখনও গল্পের টান নাটকীয়তার দিকে গেছে। কিন্তু, তবুও, সব মিলিয়ে উপন্যাসটা পড়তে মন্দ লাগে না। কোথাও যেন একটা বর্তমান সময়ের যে রূপরেখা সেটাকে ধরে এগোনোতে লেখাটার বাস্তবতা মনকে ছোঁয়।

আসলে, গত তিন বছরে করোনার প্রভাব যেন শারদীয়া আনন্দলোকের উপন্যাসগুলোতে, কিম্বা শারদীয়া আনন্দবাজার পত্রিকায় এযাবৎ পড়া উপন্যাসগুলোতে পাই নি। কল্পজগতের চরিত্রেরা কল্পসময়কে ঘিরে যে রচনার জাল বুনেছে সেখান থেকে সরে এসে বাপ্পাদিত্য বন্দ্যোপাধ্যায় কাহিনীকে এগিয়েছেন বর্তমান সময়ের মধ্যে দিয়ে এবং পরিবেশ ও পরিস্থিতির প্রভাব ও দুর্ভাবকে পাশাপাশি টেনে এনেছেন বা আনার চেষ্টা করেছেন। সত্যিই তো, জনজীবনে ধর্ম আর বিজ্ঞান যেভাবে একে অন্যকে টেক্কা দেওয়ার চেষ্টা করছে এবং তার ফলে তার যে প্রভাব সাধারণ মানুষের মধ্যে পড়ছে সেটা কি ফেলে দেওয়া যায়? লেখকের দৃষ্টিতে সেটাই ধরা পড়েছে।

 

আমার ভালো লেগেছে। তার একটা বড়ো কারণই এটা। এছাড়া বাকি সবকিছুই খুব যে গভীরে ভাবার মতো তা নয়, অন্তত যতটা গভীরে ভাবানোর চেষ্টা করা হয়েছে লেখার ভেতরে ভেতরে।



 

কি জানেন তো, পাতে বিরিয়ানী-চিকেন চাপের পর যদি একবাটি সুক্তো আসে, তাহলে কেমন হবে? আপনারা হইহই করে বলবেন, ও হে! তুমি একটা মূর্খ মেয়েমানুষ! ওটা সুক্তো নয় হে, চোখের মাথা খেয়েছ না কি? ওটা গরম রসগোল্লায় ভর্তি প্লেট।

আমি বলব, তাই তো! সরি সরি, আসলে কি হয়েছে জানেন তো, সদ্য জ্বর থেকে উঠেছি, অরুচিটা এখনও যায় নি।

তাই তো! পরপর ছয়টা সামাজিক / মানবিক উপন্যাস পড়ার পর হঠাৎ করে যদি বৌদ্ধতন্ত্র নিয়ে উপন্যাস শুরু হয়ে যায়, এবং সেই উপন্যাসের উপজীব্য বিষয় হয়ে ওঠে যৌনতার মাধ্যমে সমাধিলাভ, এবং তাকে প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে টানাটানি করতে হয় ড্রুকপা কুনলেকে, তার নির্দেশিত পুরুষাঙ্গ পূজাকে, এবং যৌন আনন্দের ধাপগুলোকে প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে আনতে হয় তাদের আচার ব্যবহারকে, তখন মনটা একটু বিকল হয় বৈ কি।

আমি জানি, বর্তমানে তন্ত্রচর্চার ট্রেন্ড চলছে। বইমেলায় রহস্য এবং তন্ত্র উপন্যাসের জয়জয়াকার, হটকেক, সুপার ডুপার হিট। এবং এই তন্ত্রমতকে নিয়ে অনেক আলোচনা, সমালোচনা ও গবেষণা। মানুষের মনের সুপ্ত ক্ষিধে এখন ‘তন্ত্রমত’ নামক ধর্মীয় ধারার মধ্যে দিয়ে প্রতিষ্ঠা লাভ করতে চাইছে। কিন্তু একটু ভাল করে ভেবে দেখলে কি মনে হয় না যে, শুদ্ধতা আর অশুদ্ধতার মাঝখানের মাপকাঠিটা নিজমতে বিচার করার অধিকার সবার জন্যে নয়? সেখানে প্রয়োজন, মহাজনো যেনো গত স পন্থা? আর মহাজনেরা দিয়েই গেছেন গোল্ডেন রুল, বলেছেন, ভাল হও, ভালো কর। জানি না, সেই গোল্ডেন রুলে তন্ত্রমত কতটা সহায়ক। আমি অবলা নারী, এ ব্যাপারে বিশেষ কিছুই জানি না, লড়াই করা শোভাও পায় না যেখানে তাবৎ বঙ্গকূলের একটা বড়ো অংশ এই মত নিয়ে মনে মনে উন্মত্ত।

কিন্তু আমার মনে হয়, একটাই কথা, “অন্তর মম বিকশিত করো, অন্তরতর হে...”

উপন্যাসটা আমার ভালো লাগে নি। একটা বড়ো কারণ, বিষয়বস্তু; একটা বড় কারণ, কেমন যেন ছাড়া ছাড়া; একটা বড়ো কারণ, হঠাৎ করে ভূটানের অধিবাসীরা একজন বিদেশীনিকে এত সহজে বিশ্বাস করে নিজেদের প্রাচীন প্রথা বা আচার-ব্যবহারকে উজাড় করে দেখিয়ে দিচ্ছে (তাও একবেলার পরিচয়ে) এটা বিশ্বাস করা; আর একটা কারণ, কাহিনীর বিশ্বাসযোগ্যতা। কোথাও যেন মনে হল এটা একটা মশলা উপন্যাস।

এই উপন্যাসে উত্তেজনা আছে, একটা আবেগ আছে, একটা যৌনতার আবহ আছে, প্রয়োজনে বারবার সেই যৌনতার দৃশ্যায়ন আছে, আর আছে এটা প্রমাণ করা যে, যে কেউ চাইলেই তন্ত্রমতের গূঢ় সাধনা না করেই শুধুমাত্র যৌনতা দিয়ে নির্বাণ লাভ করা সহজ উপায়। আর যাই হোক, তন্ত্রমতের সাধনাও এত সহজ নয়। হয়তো উপন্যাসে সম্ভব। হয়তো বজ্রযোগিনী হলে সম্ভব, হয়তো সাংগে ওয়াংচুক আর রণিতা হলে সম্ভব।

উপন্যাসটা আমাকে হতাশ করেছে। কিন্তু আপনাদের ভালো লাগতে পারে। মানে ভাল লাগার যাবতীয় উপকরণ এটাতে রয়েছে। এবার, যিনি এ রসের পথিক, তার উচিৎ এই উপন্যাসটা দিয়ে এই পূজাবার্ষিকীটা শুরু করে। দিল খুস হয়ে যাবে।

চাই কি, এই উপন্যাসটা তার চোখে সেরার শিরোপাও পেতে পারে।

আর বানান ভুল, বাক্যগঠন ভুল নিয়ে আর কথা না-ই বা বাড়ালাম।

তবে হ্যাঁ, অলংকরণে রৌদ্র মিত্র কিন্তু ফাটিয়ে দিয়েছেন। প্রত্যেকটা ছবি, সাদা-কালো হলেও বড়ই চমৎকার।



আকাশে থাকে নীল সমঝদার

আকাশব্যাপী নীল সমঝদার

বাহবা তার, তার সে-কেয়াবাত

কলসে ভরে এ-কবিতার শেষে

 

       মাঝে মাঝে মনে হয় লিখব না। কবিতার আমি কি বুঝি? কবিতা না কি মহাসাগরের মতো। কিন্তু মহাসাগরে অবগাহন করতে গেলেই সে যদি খানিকটা নোনা জল খাইয়ে পাড়ে আছড়ে ফেলে দেয় বারবার, তখন মনে সন্দেহ হয়, এটা আমার দুর্বলতা, না মহাসাগরের আত্মঅহমিকায় অধঃপতন। জানি না, কেবল এটুকু জানি, জয় গোস্বামী থেকে শুরু করে শুভদীপ দত্ত চৌধুরী পর্যন্ত --- সবাই আমাকে তীরেই আছড়ে ফেলল।

কিম্বা, হয়তো---

“কবিরা ভেসে গেছে আনন্দের জলে”

ভালো কথা, ঊপরের চারটি লাইন পারলে কেউ বুঝিয়ে দেবেন। আগাগোড়া কবিতা আমি বুঝতে পারিনি। উদাহরণস্বরূপ জয় গোস্বামীর কবিতাটির চারটি লাইনই সামনে রাখলাম সবার সামনে।

আর সঙ্গের অলংকরণ? জন্ম থেকে যেরকমটি দেখে যাচ্ছি দেশ পত্রিকার পাতায়, এখানেও তাই-ই দেখলাম। কোন পার্থক্য নেই।

 

হালত খারাপ গল্পেরও। সমরেশ মজুমদার কি লিখছেন, কেন লিখছেন, তিনিই জানেন। তার কাছে গভীরতা আশা করেছিলাম। হতাশা ছাড়া আর কিছু মিলল না। মানে গল্পটা যে ঠিক কি ও কেন, বোঝা গেল না। এমনকি গল্পটাকে শুধুমাত্র গল্প হিসাবে পড়লেও যে খুব একটা উচ্চমানের কিছু তা মনে হয় না। উনি ধারে এবং ভারে --- কোনটাতেই কাটলেন না।

সুকান্ত গঙ্গোপাধ্যায় --- স্যার, আপনার গল্পটা বুঝলাম। নিপাট সাধারণ একটি গল্প। আর তাতে টানটান ব্যাপার বলে কিছু নেই। গল্প আছে একটা। কেমন সেটা? ঠিক যেমন পঞ্চাশের দশকের প্রৌঢ়া নারী প্রচন্ড গরমে শাড়ী আলুথালু করে বৈঠকখানায় বসে আবোল তাবোল সাংসারিক গল্প করলে যেমন হয়, তেমন। আনন্দবাজার পত্রিকার শারদীয়া সংখ্যায় এমন সাদামাটা গল্প আশা করি নি।

তিলোত্তমা মজুমদারের ‘অপাপবিদ্ধা’ নিয়ে অনেক প্রশংসা শুনেছি। পড়লাম। মন্দ নয়। তবে ভুয়োসী প্রশংসা করার মতোও নয়। অস্তিত্বের সংকট, না কি সম্পর্কের মনোবিকলন? কি বলতে চাইলেন? গল্পের মধ্যে যে দৈনন্দিন সাংসারিক ক্ষুদ্রতার পরিচয় আমরা পাই সেটার বিবরণে তিনি সত্যিই সংবেদনশীল মনের পরিচয় দিয়েছেন, কিন্তু তাতে ছোটগল্পের সম্পূর্ণতা পেল কি? জানি না। শেষ প্যারায় গিয়ে কেমন যেন হয়ে গেল। মানে ঘেটে গেল। যে প্রতিমার সাংসারিক দুর্যোগের কথা লেখিকা তিনটে মাত্র ছোট্ট বাক্যে মাঝখানে হেলায় লিখে সরে গিয়েছিলেন, শেষ পর্যায়ে হঠাৎ করে সে বা তার পরিবার কেন অতটা গুরুত্ব পাবে? মাঝখান থেকে নীলপর্ণার লড়াই ফিকে হয়ে গেল। হারিয়ে গেল কোথাও যেন।

ইন্দ্রনীল সান্যাল। অত্যন্ত দুর্বল গল্প সাজিয়েছেন। মনে হচ্ছিল লেখার ইচ্ছা ছিল না। কিম্বা বাইরের ঘরে আনন্দের প্রতিনিধিকে একটু অপেক্ষা করতে বলে লেখার কাজটা সেরেছেন। যে সুমিত্রা পিউকে ছোটোবেলা থেকে চেনে, তার কাজের ক্ষেত্রে পথপ্রদর্শিকা, সে-ই পিউকে দেখতে এসে তার বাবা মিলনকে এমন সব প্রশ্ন করছিল যা যাস্ট বিশ্বাস করা যায় না। মিলনকে যে সব প্রশ্ন করছিল, আসলেই সেই প্রশ্ন অনেক আগেই পিউকেই করে নিয়ে জেনে নেওয়ার কথা। আমি কথা বাড়ালাম না, পড়লেই বুঝতে পারবেন। আর শেষের দিকে একটা চমকে দেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন বটে, কিন্তু পুরোটাই ড্রামাটিক হয়ে গেল। বিশেষ করে কথোপকথনগুলোতে এসে ব্যাপারটা আরও হাস্যকর হয়ে গেল।

সৌভিক গুহসরকার। যা লিখেছেন, গল্প হিসাবে চমৎকার। কিন্তু বিষয়বস্তু যেন আশির দশকের। পড়লে মনে হবে, এঃ! এমন ধরণের লেখা তো আগেও পড়েছি। নতুনত্ব তো কিছু নেই!




আমি একটা জিনিস দেখেছি যে, মোটামুটি একটা প্রবন্ধ কখনও খালি হাতে ফেরায় না। সে কিছু না কিছু তথ্য দিয়েই যায়, বা চিন্তার খোরাক। যে তথ্য হয়তো আমাকে চমকে দেয়, কিম্বা পরবর্তীকালে স্মৃতির অতল থেকে ফিরে এসে আমায় কোন একটা সময়ে সাহায্য করে যায়।

শারদীয়া আনন্দবাজার পত্রিকা পড়তে পড়তে আমার যে মিশ্র প্রতিক্রিয়া হয়ে চলেছে তা তো জানিয়েই চলেছি। প্রবন্ধ সেকশানে চোখ বোলাতে বোলাতে কিন্তু মনে হল, এখনও ঋদ্ধ হওয়ার মতন অল্প কিছু আছে।

এই যেমন ধরুন না নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুড়ী। তার লেখা ‘বাণভট্টঃ সত্য এবং অপ্রিয়’ প্রবন্ধটা মূলত বাণভট্ট এবং হর্ষবর্ধনের মধ্যেকার সম্পর্ককে নিয়ে লেখা। এবং বাণভট্টের ‘হর্ষচরিত’ যার মূল উপজীব্য। পড়তে পড়তে মনে হচ্ছিল, উনি এমন একটা বিষয় বাছলেন কেন? কিছু পরেই তার উত্তর পেলাম। রাজা আর সভাকবির এই সম্পর্কটাকে কোথাও উনি আজকের সমাজের পরিপ্রেক্ষিতে দেখতে চেষ্টা করেছেন। তার ফলে সরকার এবং বুদ্ধিজীবীর যে মতভেদ কিম্বা বিকিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা এবং তা থেকে উদ্ভুত রাষ্ট্রীয় সমস্যা, সেই দিকেই অমোঘ নির্দেশ করার চেষ্টা করে গেছেন। রথ দেখাও হল, কলা বেচাও হল। হর্ষচরিতকে সবার সামনেও আনা হল, আবার... থাক থাক মন... আর এগোসে নে।

দুঃখ লাগে বাঙালী পাঠককুলকে দেখলে। এর একটা অংশ আজও কল্পবিজ্ঞানকে নিয়ে যেভাবে মাতামাতি এবং রিসার্চ করে চলেছে তা সত্যিই প্রশংশনীয়। লভক্রাফট থেকে শুরু করে রে ব্রডবেরিকে যেভাবে সামনে নিয়ে আসছে, তাতে করে আমার মতন মুর্খ মেয়েমানুষ অনেক নতুন নতুন লেখা এবং লেখকের খোঁজ পেয়ে পুলকিত হয়ে যাচ্ছে। পাঠকের মধ্যে উন্মাদনা না থাকলে এ সম্ভব নয়। কিন্তু, পাশাপাশি আমার এক বন্ধুর কথাও মনে পড়ছে। সে বলেছিল, যারা লিখছেন, তাদের বেশিরভাগই বিজ্ঞান জানে না, পড়ে না, কেবল কল্পনায় ভেসে কিছু একটা নিজের মতন করে দাড় করিয়ে নেয়। তাদের সমস্ত বিজ্ঞান কল্পনায়। ফলে বিজ্ঞানের ‘ইউনিভার্সাল ল’গুলোর ফর্দাফাই করে দিয়ে তারা লিখে চলেছেন এবং প্রশংশাও কুড়াচ্ছেন বটে, কিন্তু একটা লভক্রাফট, বা কোনান ডয়েল, নিদেনপক্ষে জুলে ভের্নে বাংলায় আসার সম্ভবনা নেই। অদ্রীশ বর্ধন, রেবন্ত গোস্বামী বা রণেন ঘোষকে নিয়ে মাতামাতি করা ছাড়া আর কিছু তো হচ্ছে না।

আর সেই কারনেই পথিক গুহ’র মতন লেখক অনেকটাই আড়ালে থাকেন। মজার কথা, পথিক গুহ’র এবারের লেখাটাতে সেই ইঙ্গিতই মিলছে। স্টিফেন হকিন্সের ‘ব্রিফ হিস্ট্রি অফ টাইম’ বাইবেলের পরে সর্বাধিক বিক্রীত বই, আবার সেটাই সবচেয়ে অপঠিত বই। মানে, লোকে কিনেছে, পড়েনি, পড়লেও চর্চা করেনি। বিদেশেই যখন এই অবস্থা, এত এত পপুলার সায়েন্সের ওপর জার্নাল, ম্যাগাজিন থাকা সত্ত্বেও যখন এই অবস্থা, তখন আমাদের যে কি মরণ দশা সে নিয়ে কিছু বলার নেই। যারা কল্পবিজ্ঞান লিখছেন, পাশাপাশি তারা যদি একটু পড়াশোনা করেন, আমাদের মতন অবোধ পাঠক পাঠিকাদের জন্যে বর্তমানের বিজ্ঞানটাকে পথিক গুহ’র মতন করে আমাদের সামনে মেলে ধরেন, আর পাঠকেরাও একটু বিজ্ঞানচর্চা করেন তাহলে দুই তরফেই ঋদ্ধ হওয়ার সম্ভবনা থাকে। এই মুহূর্তে তন্ত্রমতের আলোচনা থেকে বিজ্ঞানমনষ্ক হওয়ার কি প্রয়োজন বেশি নয়? চাঁদে বা মঙ্গলে যেখানে ভারতের রকেট যাচ্ছে, সেখানে ভুতুড়ে প্রলাপ যে মানুষের মনে কি অঙ্কট বঙ্কট প্রভাব ফেলতে পারে, দিনকয়েক আগে দেবীপ্রসাদ দুয়ারী মহাশয় যাদবপুর ইউনিভার্সিটির ছেলেমেয়েদের বোঝানোর চেষ্টা করছিলেন। পথিক গুহ’র লেখাটা পড়তে পড়তে সেটাই মনে হচ্ছিল।

বাকি পাঁচটি প্রবন্ধ পাঁচটি দিককে মেলে ধরেছে --- দেবাশিষ ভট্টাচার্যের ‘তিনি আর আমি’ – সত্যজিৎ রায়ের শতবর্ষ উপলক্ষে একটা স্মৃতিচারণ; অনির্বাণ চট্টোপাধ্যায়ের ‘এ জগৎ মহাপণ্যশালা’ --- অর্থনীতিতে মানুষ কিভাবে পণ্য হচ্ছে তার উপর একটি নিবন্ধ; ঈশানী দত্ত রায়ের ‘যা হারিয়ে যায়’, বিভিন্ন আঙ্গিকে মানুষের হারিয়ে যাওয়ার আলেখ্য; প্রেমাংশু চৌধুরীর ‘দিল্লী, দোস্তি, দাস্তান’ রাজনৈতিক প্রেক্ষিতে একটি প্রবন্ধ এবং রামমোহন রায়ের ওপর লেখা সেমন্তী ঘোষের ‘প্রথম বাঙালি বিশ্বনাগরিক’ --- ব্যাস! আনন্দের সবদিক দিয়ে প্রবন্ধের ডালির পসরা। যার যেটা ইচ্ছা পড়ে নিন টাইপের আর কি। আমার মনে একটাও তেমন ধরে নি।

কিন্তু তবুও, প্রত্যেকটা লেখার মধ্যেই কিছু না কিছু পাবেনই। ওই বললাম না, প্রবন্ধ কখনও আপনাকে খালি হাতে ফেরাবে না। আমাকেও ফেরায় নি। 


===============================================

 

শারদীয়া আনন্দবাজার পত্রিকা

মুদ্রিত মূল্যঃ ২২০/-

Comments

Popular posts from this blog

যে বুকে আগুন জ্বলে

জেরক্স কপির উন্নত ভার্সানে ‘আবার প্রলয়’ এসেছে