জেন আয়ার - হেলেন বার্নস
“আমি বড় খুশি, জেন; যখন তুমি শুনবে আমি আর নেই, আমার জন্য দুঃখ কোরো না। দুঃখ পাওয়ার ব্যাপারই নয় এ। আমাদের সবাইকেই তো একদিন মরতে হবে; আর যে অসুস্থতা আমাকে নিয়ে যাচ্ছে, তা ব্যথাহীন; খুব ধীরে ও কোমল স্পর্শে সে আমাকে টানছে; আমার মনে কোনো গ্লানি বা অশান্তি নেই। আমার পেছনে এমন কাউকে রেখে যাচ্ছি না, যে আমার জন্য শোক করবে। আমার শুধু বাবা আছেন, কিন্তু তিনিও হালে বিবাহ করেছেন, তাই আমার জন্য বিশেষ শোক করার সময় তাঁর হবে না। অল্প বয়সে এভাবে মারা গিয়ে আমি ভবিষ্যৎ জীবনের অনেক দুঃখ-কষ্টকে এড়াতে পারব। এই পৃথিবীতে অনেক ওপরে যাওয়ার জন্য আমার বিশেষ কোনো প্রতিভা ছিল না; সারাজীবন সবার কাছে আমি দোষী হয়েই থাকতাম।”
সাহিত্যে
কালোত্তীর্ণ গল্প–উপন্যাস–কবিতা–প্রবন্ধ নিয়ে রিভিউ করার ধৃষ্টতা দেখানো আমার কম্ম
নয়। কিন্তু আজ যদি আমি সেইসব কালোত্তীর্ণ লেখার সামনে এসে দাঁড়াই, কী লিখব তাদের নিয়ে?
এই যেমন, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপন্যাস নিয়ে সম্প্রতি যে সিনেমা হল, তা ভালো–খারাপ
ব্যতীত আমি দেখছি; কুসুমের ব্লাউজের নিচে মন আছে কি নেই, থাকলে তা ফ্রয়েডিয়ান না বাঙালীয়ান—তা
নিয়ে ভাবতে ভাবতেই বাঙালি এখনও দিন কাটাচ্ছে, আর সিনেমাটা নিয়ে ‘আহা-উহু’ করছে। অথচ
উক্ত উপন্যাসে কত যে পার্শ্বচরিত্র আছে, যারা বর্ণময়, অথচ কুসুমের আঁচলে বন্দী!
হেলেন
যেন বাইবেল থেকে উঠে এসেছে—সাহিত্যের মাটিতে এক পরাবাস্তবতা; আর সেই কারণেই তার চরিত্র
এত দৃষ্টিকটু। জেনের সাথে তার কথোপকথনে উঠে আসে বাইবেলের সাথে বাস্তবতার দৃষ্টিকোণিক
পার্থক্য।
হেলেন
বলে, “আজ সকালে যখন ক্লাস চলছিল, আমি তোমাকে লক্ষ্য করছিলাম। দেখলাম তুমি খুব মনোযোগী,
তোমার চিন্তাধারা কখনও এদিক–ওদিক ঘুরে বেড়ায় না, তুমি একমনে মিস মিলারকে শুনছিলে, যখন
উনি পড়া বোঝাচ্ছিলেন আর তোমাকে প্রশ্ন করছিলেন। এবার, আমার ভ্রাম্যমাণ চিন্তারা কেউ
আমার দখলে থাকে না, যখন মিস স্ক্যাচার্ড পড়া বোঝান; আর আগ্রহ ও পরিশ্রম সহকারে তাঁর
কথাগুলো স্মৃতিতে সংগ্রহ না করে আমি এমন অমনোযোগী হয়ে যাই যে আমি তাঁর গলার আওয়াজও
শুনতে পাই না। আমি দিবাস্বপ্নে হারিয়ে যাই। কখনও আমি ভাবি যে আমি নর্থাম্বারল্যান্ডে
আছি, আর চারদিকে যে শব্দের গুঞ্জন, সে আর কিছু না, ছোট ঝরনার কাকলি, যা আমার বাড়ির
কাছে ড্রেনের মধ্য দিয়ে প্রবহমান।”
জেনের
শাস্তি একটাই—লোউড ইনস্টিটিউশন। সেখানেই তার বন্ধুত্ব হেলেনের সাথে। কোথায় কনট্রাডিকশন
করছে হেলেন?
“…তুমি
মানুষের ভালোবাসার ব্যাপারে একটু বেশি স্পর্শকাতর, তুমি খুব আবেগপ্রবণ; আবেগ ভীষণরূপ
ধারণ করে তোমার; সেই সর্বশক্তিমান, যিনি তোমাকে তৈরি করেছেন, তোমার আত্ম-অনুভূতি ছাড়াও
আরও উপযোগী বস্তু দিয়েছেন। এই পৃথিবী এবং তার ভেতরের মানবজাতি ছাড়াও এক অদৃশ্য আত্মার
জগৎ আমাদের চারদিক ঘিরে আছে, সর্বত্র, সবসময়; আর সেই দেবদূতের মতো আত্মারা আমাদের লক্ষ্য
করেন, কারণ আমাদের রক্ষাকর্তা তাঁরা। আর যখন আমরা কষ্টে, লজ্জায়, অপমানের আঘাতে জর্জরিত
হয়ে মৃতপ্রায় হই, যদি বিদ্রুপ ও ঘৃণা দ্বারা অকারণে আক্রান্ত হই, দেবদূতেরা আমাদের
যন্ত্রণা লক্ষ্য করেন। আমরা নিরপরাধ হলে আমাদের পবিত্রতা তাঁরা বুঝতে পারেন অবশ্যই
(যদি পবিত্র আমরা হই; যেমন আমি জানি, মি. ব্রকহার্স্টের মিসেস রিডের কাছে শোনা কথা
থেকে তোমাকে এত আড়ম্বর সহকারে অপরাধী বলে দাগিয়ে দেওয়া সত্ত্বেও তুমি নিরপরাধ, কারণ
আমি তোমার উৎসাহী চোখে ও তোমার সুনির্মল চেহারায় তোমার একাগ্র নিষ্ঠা দেখেছি)। ঈশ্বর
সেই সময়ের জন্য অপেক্ষা করেন, যখন আমাদের আত্মা আমাদের শরীর থেকে বিচ্ছিন্ন হবে, তখন
তিনি তাঁর পুরস্কার দেন। তাহলে, আমরা দুঃখে এত কাতর হয়ে পড়ব কেন, যখন জানি জীবন খুব
ছোট, মৃত্যু সুনিশ্চিত, আর তারপরেই অনন্ত আনন্দ ও সুখ...?”
জীবন
খুব ছোট, হেলেন, তোমার জীবন খুব ছোট। আর তাই কি তুমি এমনভাবে বাইবেলের পাতা থেকে উঠে
এসেছ? এমন অস্বাভাবিক শুদ্ধ তুমি? এই শুদ্ধতার উৎস আসলে কি অভ্যন্তরীণ শান্তি, না ধর্মীয়
বশীভূততা?
বসন্তের
রাত। ক্ষয়রোগে আক্রান্ত হেলেনের সাথে দেখা করতে চলেছে জেন। অন্তত একটিবারের মতো যদি
দেখা যায় তাকে! লুকিয়ে লুকিয়ে চলেছে সে। এ এক মরণাভিসার। তার ঘরে তখন কেউ নেই। জেন
আশঙ্কিত। মশারির আড়ালে থাকা হেলেনকে সে প্রশ্ন করে, “জেগে আছ?”
“আমার
ঘুম পাচ্ছে, জেন; কিন্তু আমি ঘুমিয়ে পড়লেও আমাকে ছেড়ে যেও না, জেন। তুমি কাছে থাকলে
আমার ভালো লাগবে।” দুই বন্ধু, লেপের উষ্ণতায় একে অপরকে জড়িয়ে ঘুমিয়ে পড়ে।
জেন
নিশীথনিদ্রায়। হেলেন মরণনিদ্রায়।
===================
Comments
Post a Comment