বিদ্বান বনাম বিদুষী




অসাধারণ গল্পকারদের দলে প্রীতম বসু নিঃসন্দেহে অন্যতম। ‘পাঁচমুড়োর পঞ্চাননমঙ্গল’ কিংবা ‘চৌথুপীর চর্যাপদ’ উপন্যাস দুটোতে এটা বেশ লক্ষ্য করেছি। এবং এত সুখপাঠ্য লেখা খুব কম লেখকের লেখায় পেয়েছি। মাঝের উপন্যাসগুলো আমি পড়িনি। কিন্তু এখন ‘বিদ্বান বনাম বিদুষী’ পড়ার পর মনে হচ্ছে, বাকি উপন্যাসগুলোও পড়ে ফেলতে হবে।
      এর সঙ্গে তার উপন্যাসে দেখি রিসার্চ ওয়ার্ক। এই রিসার্চ ওয়ার্ক শুধুমাত্র আমাদের ঋদ্ধ করে, শুধু তাই নয়, কৌতূহলীও করে তোলে। ইংরেজিতে যাকে বলে ফার্দার রিডিংস—সেটাতে উৎসাহিত করে।
      এই উপন্যাসের বিষয়বস্তু খনা। এই উপন্যাসের বিষয়বস্তু টাইমলাইন—চিরপরিচিত এই চেনা ছকে এখন তাবৎ লেখককুল হাঁটছেন, বিশেষ করে যারা ঐতিহাসিক উপন্যাস লিখছেন। ওই অনেকটা এভারেস্টে ওঠার মতো। এই প্যাটার্নের লেখায় এখন ট্রাফিক জ্যাম হয়ে গেছে। প্রীতম বসু সেই ট্রাফিকের মধ্যেই নিজের থ্রিলার-মেশানো ঐতিহাসিক কাল্পনিক পটভূমিতে খনাকে দাঁড় করিয়েছেন।
কিরকম দাঁড় করিয়েছেন? একটা জায়গা তুলে ধরি, তাহলে ব্যাপারটা পরিষ্কার হবে—

“বেহুলা চুপ হয়ে বসে রইল। সাহেবও স্বল্পক্ষণ মৌন থেকে তারপর নীরবতা ভাঙল 'বেহুলা, একটা কথা বলব?'

'কী কথা সাহেব?'

'টুমি এত সুন্দরী, টুমি সাজলে খুব সুন্দর লাগবে। টুমি সাজো না কেন?'

'আমি যে বিধবা সাহেব, সমাজ বলে বিধবাদের সাজতে নেই। বিধবারা সিঁথি কেটে চুল আঁচড়াতে পারে না। মাথা কামিয়ে ফেলতে হয় আর তা না হলে সিঁথি না কেটে মাথার পিছনে চুলে একটা গিঁট দিতে হয়। আমি এসব করিনি। আমাদের সমাজে বিধবাদের নিজের সুখদুঃখকে অস্বীকার করে পরিবারে টিকে থাকতে হয়। আর এই অসহনীয় বেঁচে থাকা থেকে মুক্তি পেতে বিধবারা কায়মনোবাক্যে ঈশ্বরকে আঁকড়ে ধরে নিজেদের প্রতি উদাসীনতার পথ খোঁজে। আমাদের সাধ আহ্লাদ বলে কিছু থাকতে নেই।'

'বেহুলা টুমি এত বুদ্ধিমতী, টুমি আবার বিয়ে কর।'

বেহুলা মলিন হেসে বলল, 'একবার পালিয়ে গায়ে আগুন দেওয়া থেকে বেঁচেছি। কী দরকার সাহেব আবার নিজেকে ঝামেলায় ফেলার। আমাদের দেশে তো আর তোমাদের দেশের মতো মেয়েদের সম্মান করে না। আমাদের দেশে মেয়েরা লেখাপড়া শিখলেই পুরুষের চক্ষুশূল হয়ে যায়।'

'আমাদের দেশেও কম না। এসব সংবাদ চাপা পড়ে যায়,' ডেভিড বলল। 'ইউরোপে গত তিনশো বছরে কত এরকম গুণবতী নারীকে ডাইনি আখ্যা দিয়ে বিচারের নামে গণহত্যা করা হয়েছে তার ইয়ট্টা নেই। প্রায় পাঁচ লাখ নারীকে নির্মমভাবে পুড়িয়ে মারা হয়েছে। যে নারী পুরুষের কাছে পোষ না মানে, সেই বিদ্রোহী নারী হয়ে যায় ডাইনি। সব দেশেই পুরুষের সূত্র আর অনুশাসনের ফাঁস নারীকে গলায় বেঁধে চলতে হয়…”

এই একটা কথোপকথনে উঠে আসে নারী-পরাধীনতার চিরায়ত সত্য। যুগের পর যুগ, দেশ-কাল-পাত্র ভেদে অবস্থা সেই একই হয়ে পড়ে…
      প্রীতম বসু পূজাবার্ষিকীতে লেখেন না—ভাগ্যিস লেখেন না। না হলে তিনিও এতদিনে প্রচুর পরিমাণে লেখা ডেলিভারির কারণে আর পাঁচজনের মতোই সাধারণ লেখকে পরিণত হতেন।

============
বিদ্বান বনাম বিদুষী
প্রীতম বসু
মুদ্রিত মূল্য: ৫০০/-

 


Comments

  1. ছন্দ নিয়ে চমৎকার একটি বই আছে

    ReplyDelete

Post a Comment

Popular posts from this blog

যে বুকে আগুন জ্বলে

শারদীয়া আনন্দবাজার পত্রিকা সম্পর্কে

জেরক্স কপির উন্নত ভার্সানে ‘আবার প্রলয়’ এসেছে