রসিদি টিকট
আমি যে অনুবাদ পড়ছি, ‘আমার কাছের বন্ধুরা’
— রসিদে টিকিট-এর
থেকে একটু আলাদা। কতটা আলাদা সেটা হয়তো ভাষা সংসদ থেকে যে অনুবাদ বেরিয়েছে রসিদি টিকিট
নামে, সেটা পড়লে বোঝা যাবে। কেন আলাদা? এই বইটার ভাষান্তর করেছেন যিনি, সেই সুবিমল
বসাকের কথায়,
“১৯৮২
সালে অমৃত
শারদীয় সংখ্যা-য় অমৃতা প্রীতমের 'রসিদি টিকিট' আত্মজীবনীমূলক রচনাটি আমার পুরুষ বন্ধুরা
নামে বঙ্গানুবাদে প্রকাশিত হয়। এখানে উল্লেখ্য, এই অনুবাদ রসিদি টিকিটের প্রথম সংস্করণ
অবলম্বনে অনূদিত। পরবর্তী সংস্করণগুলিতে লেখিকা অনেকটাই সংশোধন, পরিবর্ধন ও প্রয়োজনবশত
সংকোচন করেছেন, তাই অধুনা প্রকাশিত গ্রন্থটির সঙ্গে মিলিয়ে পড়লে পাঠক কিছুটা অসংগতি
লক্ষ করতে পারেন। বর্তমান গ্রন্থটি আমার কাছের বন্ধুরা নামে প্রকাশিত হবার
পিছনে একটি অনিবার্য কারণ আছে—যাঁদের বন্ধু হিশেবে গ্রন্থটিতে তুলে ধরা হয়েছে সেখানে
শুধুই পুরুষ নয়, নারী বন্ধুর কথাও বিবৃত হয়েছে। আশা করি এই কৈফিয়ৎটুকু পাঠকরা উদারচিত্তে
গ্রহণ করবেন।”
অনেক
অনেক মানুষ, যারা একসময় অমৃতার কাছে এসেছিলেন, ছেড়ে চলে গেলেন, কিম্বা অমৃতা ছেড়ে বেরিয়ে
এলেন, তাদের স্মৃতিচারণা করেছেন। এ কোন ঘটনা সম্বলিত স্মৃতিচারণা নয়। এ এক আত্মখোঁজ।
কার? ষোল বছর বয়সী অমৃতার। অমৃতার বয়স বাড়লেও তার ষোল বছরের মেয়েটি বারেবারেই অমৃতার
পিছু ছাড়ে না। অনেক মানুষের সাহচর্যে কখনও কখনও সে মেয়েটিকে তিনি দেখতে পান। বলা ভালো,
কিছু মানুষের সাহচর্যে অমৃতার ভেতরের অমৃতা বের হয়ে আসে।
“...
ষোল বছর এলো, চলেও গেল। প্রত্যক্ষভাবে কোন ঘটনাই ঘটল না। বস্তুত এই বয়স আয়ুর সড়কে
পোঁতা অ্যাকসিডেন্টের চিহ্নস্বরূপ—(বিগত বয়সের মসৃণ সড়ক শেষ, সামনে বন্ধুর ও ভয়ঙ্কর
মোড়, রাস্তা শুরু হয়, এখন বাবা-মা'র আদেশ থেকে শুরু করে স্কুলের পাঠ কণ্ঠস্থ করা, উপদেশ
শোনা এবং সেই মতো চলা; সামাজিক ব্যবস্থা শ্রদ্ধাসহকারে স্বীকার করে নেয়া সরল বিশ্বাসের
সামনে প্রতি সময়ে একটা প্রশ্ন সূচক হয়ে দাঁড়ায়..)। এই বছর চেনা-জানা সব কিছু শরীরে
বস্ত্রের মতো সংক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে, জীবনের পিপাসায় ওষ্ঠ শুষ্ক হয়ে ওঠে, আকাশের নক্ষত্র,
যাকে সপ্তঋষির আকারে দেখে দূর থেকে প্রণাম করতে হতো, এখন কাছে গিয়ে স্পর্শ করে দেখার
ইচ্ছে হয়... কাছে-পিঠে, দূরে-নিকটে, বাতাসে এত নিষেধ, এত বাধা, এত অস্বীকার এবং এত
বিরোধ যে নিঃশ্বাসে আগুন জ্বলে ওঠে...
এই রোষের সম্পূর্ণ রূপ আমি তারপরে
কয়েকবার লক্ষ করেছি। ১৯৪৭-এর দেশভাগের সময়ও দেখেছি। কাঁচের বাসনের মতো সামাজিক, রাজনৈতিক,
ধর্মীয়—যাবতীয় মূল্যবোধ ভেঙে চৌচির হয়ে গিয়েছিল, সেই কাঁচের টুকরো লোকেদের পায়ের তলায়
বিছানো। এই টুকরো আমার পায়েও বিঁধে ছিল, মাথায়ও। জীবনের প্রতিকৃতি দেখায় বিভ্রমে আমি
সেই উষ্ণতার সঙ্গে কয়েক গুচ্ছ কবিতাও লিখেছি—সেই উষ্ণতার সঙ্গে যা এক 'ষোল বছর' তার
প্রিয়তমের মুখ দেখার জন্য লিখে থাকে। এইভাবে প্রতিবেশী দেশের আক্রমণের সময়, ভিয়েতনামের
দীর্ঘ যাতনার সময়, চেকোশ্লোভাকিয়ার অসহায়তার সময়...
এই
ষোল বছর ফিরে আসে সাজ্জাদের সাথে বন্ধুত্বে, নির্মল বন্ধুত্বে; ফিরে আসে শাহিরের প্রেমে,
অসম্পূর্ণ প্রেমে; এবং ফিরে আসে ইমরোজের সাথে সম্পর্কে, সার্থক সম্পর্কে।
সাজ্জাদ
হায়দারের সাথে বন্ধুত্ব, কেমন সে বন্ধুত্ব? সাজ্জাদ পাকিস্তানের অধিবাসী। সাতচল্লিশের
পরে সে শত্রু। অমৃতার কাছে সে বন্ধু। অমৃতার ছেলে নবরাজ। সে অসুস্থ। চিন্তিত অমৃতা
চিঠি লেখে সাজ্জাদকে। চিঠিতে লেখা থাকে ছেলের অসুখের কথা। চিঠির উত্তরে সাজ্জাদ লেখেন,
“আমি
সারারাত খোদার কাছে দোয়া করেছি যাতে তোমার ছেলে যেন সুস্থ হয়ে ওঠে। আরবি প্রবাদ আছে,
যখন দুশমন দোয়া করে, তখন তা নিশ্চয় কবুল করেন। এই মুহূর্তে আমি দুনিয়ার নজরে তোমার
দুশমন—খোদা না করুন আমি যেন কোনদিন তোমার বা তোমার ছেলের দুশমন হই।”
ষোল
বছরের অমৃতার নারীত্ব কখন ফুটে ওঠে তার জীবনে?
অমৃতার
লেখার কাঁটাছেঁড়া আলাদা করে করতে গেলেই অমৃতা আর থাকেন না। তার প্রতিটি ছত্রে ছত্রে
যখন আমি তাকে দেখি, তাকে স্পষ্ট দেখতে পাই। কিন্তু যখন আমি নিজে তাকে নিজের ভাষায় ব্যাখ্যা
করতে যাই, দেখি, সে আর নেই। অমৃতার ভাষাতেই অমৃতাকে ব্যাখ্যা করতে হয়। না হলে অমৃতা
পিছলে কোথায় যেন হারিয়ে যায়। আর তাই, আমার লেখা শেষ করি অমৃতার নিজের প্রতি নিজের দৃষ্টিকোণ
থেকে, যা ইন্দিরা গান্ধীর দৃষ্টিকোণের সাথে একদম মিলে যায়…
“এর
কিছু অ্যাডভান্টেজ আছে, কিছু ডিসঅ্যাডভান্টেজও। কিন্তু আমি কখনও এ ব্যাপারে লক্ষ করিনি।
নারী-পুরুষের পার্থক্য না ভেবে আমি নিজেকে সর্বদা 'মানুষ' বলে ভাবি। শুরু থেকেই জানতাম—আমি
প্রতিটি ব্যাপারে সমর্থ। যে কোন সমস্যা, পুরুষদের চেয়ে ভালোভাবে সমাধান করতে পারি।
শুধু শারীরিকভাবে খুব ভারী ওজন তুলতে পারি না, তাছাড়া প্রতি ব্যাপারে সব রকমে আমি সমর্থ।
এই জন্য আমি কখনও নারী হওয়ায় কোন অভাব নিয়ে ভাবিনি। যাঁরা শুরুতে আমাকে শুধু নারী ভেবেছিল,
আমার শক্তি বুঝতে পারেনি সেটা তাদের ভাবনা ছিল, আমার নয়… লোকেরা হয়তো এ প্রসঙ্গে কিছু
বলে, অধিকাংশই আমার কাছে এসে পৌঁছয় না। যাও-বা পৌঁছয়, তাকে আমি কোন গুরুত্ব দিই না।”
Comments
Post a Comment