“যে
কোনো মেয়ে, সে হিন্দু হোক কি মুসলমান, যে সব মেয়েরা ফিরে গিয়ে আপন আপন ঘরে ঠাঁই পাচ্ছে,
মনে করো তাদের সঙ্গে পূরোর আত্মাও সঠিক ঠিকানায় পৌঁছে গেছে।”
দেশভাগের
ক্ষতচিহ্ন আর তার থেকে যে বিষ ছড়িয়েছে, আজও আমরা তার ভুক্তভোগী। অন্তত আমাদের আগের
জেনারেশন। আমাদের মধ্যে কিংবা আমাদের পরে এর প্রভাব অতটা সুদূরপ্রসারী হবে না, এবং
আস্তে আস্তে মিলিয়ে যাবে। পড়ে থাকবে এক টুকরো মর্মান্তিক ইতিহাস।
এই
ইতিহাস আমাদের গল্পে-গাঁথায়। এই ইতিহাস আমাদের চারপাশের রাস্তায়, বাড়িতে, ক্ষেতে-খামারে।
ভারত এবং প্রতিবেশী দুটি দেশই এই ইতিহাস বয়ে নিয়ে চলেছে, আজকের যুগে সঠিক ও সটীক প্রমাণের
কারণে যাকে আর অস্বীকার করা যায় না।
অমৃতা
প্রীতম দেশভাগের শিকার। অমৃতা দেশভাগের পরে দেশভাগের কুটিল পরিণতির সাক্ষী। অমৃতা রচনা
করেছেন ‘পিঞ্জর’।
এই
উপন্যাস বহুপঠিত। বহু আলোচিত। আর তাই আমার বলার জায়গা খুব কম। অহেতুক আবেগপনায় ভাসতেও
মন চায় না। কারণ, অনেক আবেগ আমরা খরচ করে চলেছি অহেতুক। নিজেদের আবেগী বলে গর্ববোধ
করি বটে, বুঝতে চাই না—এই আবেগ বর্তমান যুগে আমাদের ধ্বংসের অন্যতম কারণ। আর তাই, আমি,
নারীর অসহায়তা ও পিতৃতান্ত্রিক সমাজ, দেশভাগের যন্ত্রণা, প্রেম ও ত্যাগ ইত্যাদি থেকে
সরে এসে চরিত্রগুলোকে দেখতে চেষ্টা করি।
অমৃতা
নিজেই দেশভাগের ভেতর দিয়ে গিয়েছেন—তিনি ছিলেন প্রেমে বঞ্চিতা কিংবা অসম্পূর্ণতা, আধুনিকতার
কারণে সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন, এবং সর্বোপরি একজন প্রতিবাদী নারী। পিঞ্জর-এর মূল
চরিত্র পূরো কি তারই নারীত্বের এক প্রতিরূপ—যে একইসঙ্গে অসহায়, সাহসী ও পরিবর্তনের
দিশারী? অমৃতা যখন পূরোকে নির্মাণ করছেন, তখন, আমার কোথাও মনে হয়, তিনি যেন নিজেকেই
ভেঙে লিখছেন, আবার নিজেকে পুনরায় গড়ে তুলছেন। পূরোর মতো তিনিও একসময় ভালোবাসা হারান,
কিন্তু নিজেকে কবিতার ভাষায় কিংবা উপন্যাসের পর্বে পর্বে খুঁজে পান। এক অর্থে, পিঞ্জর
হল অমৃতা প্রীতমের নিজের ভেতরের “মুক্তির ডায়েরি”। ‘রসীদে টিকিট’ নামক স্মৃতিচারণমূলক
লেখায় তিনি একটা জায়গায় লিখেছেন—
“মনের
অন্তরালে সর্বপ্রথম যন্ত্রণা, যার চোখেমুখের আলোয় দেখতে পাই, তিনি সেই ধর্মের লোক,
যাদের জন্য আমাদের বাড়িতে বাসনপত্র আলাদা রাখা হতো। এই মুখশ্রী আমার ভেতরের মানবতাকে
এত বিশাল ব্যাপ্ত করে তুলেছিল যে ভারত ভাগ হওয়ার সময়, খণ্ডিতকারীদের হাতে নিগৃহীত হয়েও
দুই ধর্মের জুলুম কোনরকম পক্ষপাত-বিনা লিখতে পেরেছি; এ মুখশ্রী যদি দেখা না থাকতো,
কে জানে পিঞ্জর উপন্যাসের ভাগ্যে কী ঘটতো।”
অমৃতা
একজন কবি, আর তাই তার গদ্যও কবিতার মতো। এমনকি, বাংলা অনুবাদে তার সেই গদ্যের ভেতরে
পদ্যের অভিঘাত একটু মন দিয়ে পড়লেই বোঝা যায়। এমনই তার কবিতার শক্তি! পিঞ্জর
পড়লে বোঝা যায়, কিছু কিছু বাক্য যেন এক-একটি আহত কবিতা—প্রেম, শরীর, সমাজ ও দেশভাগের
রক্তাক্ত ইতিহাসে ভেজা—
“…ঈশ্বর
যদি আমার বিয়েতে সাক্ষীই দিয়ে থাকেন তো মিথ্যে সাক্ষী দিয়েছেন। সেটা আমার বিয়ে ছিল
না...” তারো কেমন যেন পাগল পাগল চোখ দুটি মেলে ঘরের ছাদের দিকের লম্বা লম্বা কড়ি-বড়গাগুলোর
দিকে তাকিয়ে দেখতে লাগল! আর পূরো দেখছিল তারোর মুখের দিকে চেয়ে চেয়ে। এই মেয়েটা, এই
তারো নামে মেয়েটা, ভাল-মন্দ সব কিছু ভেবে দেখার পরও, ভাল-মন্দ মিশিয়ে এতগুলো কথা বলার
পরও, বিবাহ নামক ওই মেকি অনুষ্ঠানের মহান অসত্যটা থেকে কিছুতেই যেন নিজেকে মুক্ত করতে
পারছিল না। অথচ, এদিকে তার জীবনের অন্তিম দিনটা বড় দ্রুতগতিতে জীবনের সমস্ত সত্য-অসত্যকে
পিছনে ছুড়ে ফেলে এগিয়ে আসছিল।
এখন
গোধূলিবেলা। পূরো বুকের মধ্যে ভারী এক বোঝা নিয়ে উঠে দাঁড়াল। ওর মনটা যেন এই ভর-ভরন্ত
সংসারের বাইরে গিয়ে কোথাও একা একা উদাস হয়ে স্তব্ধ দাঁড়িয়ে রইল।”
পড়তে
পড়তে আমার মনে হচ্ছিল—‘অমৃতা প্রীতম’ ও পিঞ্জর একে অপরের প্রয়োজনীয়তা। পিঞ্জর
না লিখলে অমৃতা অসম্পূর্ণ থেকে যেতেন—আর অমৃতা না হলে পূরো কেবল আরও একটি ধর্ষিত নারীচরিত্র
হয়ে থাকত, কোনো প্রতিবাদের প্রতীক নয়। এই উপন্যাস নারী-শরীর, আত্মা, প্রেম, ধর্ম, দেশভাগ,
ক্ষমা, আর বিদ্রোহ—সবকিছুর এক রক্তাক্ত ফুল।
কীভাবে
চরিত্রগুলোর উত্তরণ হচ্ছে উপন্যাসের পরতে পরতে কেউ খেয়াল করেছেন? আমি যেভাবে দেখছি,
তাকে এরকম সাজানো যেতে পারে—
পূরো = প্রেমিকা,
কন্যা > স্বনির্বাচিত স্ত্রী, নারী = আত্মমর্যাদা ও প্রতিরোধ
রশীদ = অপহরণকারী
> অনুতপ্ত প্রেমিক = অপরাধ ও মোচনের দ্বন্দ্ব
রামচন্দ্র = আদর্শ
প্রেমিক > মানবিক পুরুষ = বিকশিত পুরুষতন্ত্র
লাজো = নিঃসহায়
নারী > উদ্ধারপ্রাপ্ত বোন = নীরব প্রতিরোধ
সমস্ত
উপন্যাসের মধ্যে এই চারটে চরিত্র আমার ভেতরে দাগ কেটে যায়। চরিত্রগুলো হঠাৎ করে নাটকীয়
হয়ে যায় না, যদিও, একটু ভাল করে দেখলে বোঝা যায় যে গোটা পিঞ্জর উপন্যাসটাই নাটকীয়।
সেই নাটকের মধ্যে চরিত্রগুলো মিশে গেছে, মেলোড্রামাটিকে পরিণত হয়নি।
পূরো
নারী-অবমাননার প্রতীক হলেও সে একইসঙ্গে নারীর আত্ম-উত্তরণের অনন্য দৃষ্টান্ত হয়ে ওঠে।
সমাজ যাকে ত্যাগ করেছে, সেই পূরো শেষপর্যন্ত নিজের জন্য এক নতুন দেশ, এক নতুন পরিচয়
এবং এক নতুন প্রেম বেছে নেয়। সে কিন্তু রশীদকে ত্যাগ করে না, বরং হামিদা হয়ে একজন অপরজনের
ভরসাস্থল হয়ে ওঠে।
রশীদ
একধরনের post-traumatic masculinity-এর প্রতীক—যার ব্যক্তিত্ব জাতিগত বিদ্বেষ
ও পারিবারিক প্রতিশোধের চাপে বিকৃত হয়ে উঠলেও সে ঘটনার অভিঘাতে redemption-এর
সুযোগ খোঁজে, এবং সেই চেষ্টাই তাকে একাধারে জটিল ও মানবিক করে তোলে।
রামচন্দ্র
অন্যদিকে সেই নতুন পুরুষের প্রতীক, যে শিক্ষা, বেদনা, দুঃখ, প্রেম এবং অভিজ্ঞতা থেকে
মানবিকতা শেখে। কিন্তু সমস্যা হল সমাজের কাঠামোতে সে সীমাবদ্ধ, কারণ পূরো তাকে আর গ্রহণ
করে না। রামচন্দ্র সেই শূন্যস্থান পূরণ করে তার আপন বোনকে গ্রহণ করে, তাকে সে ত্যাগ
করে না। পূরোর ভাইও সেই একই ভুল করে না। অর্থাৎ, পূরোর ঘটনা তাদের কাছে এমন এক উদাহরণ
হয়ে ওঠে যে, তাদের মানবিক সত্তার এক আমূল পরিবর্তন ঘটে।
অন্যদিকে
লাজো সেই শতসহস্র নারীর প্রতিনিধিত্ব করে, যারা পিতৃতন্ত্র ও জাতিগত সহিংসতার শিকার।
তার চারিত্রিক নীরবতা এমন একধরনের আঘ্রাণ—যেখানে চিৎকার নেই, কিন্তু দগ্ধতার গন্ধ আছে।
অমৃতা
এমন কিছু প্রশ্ন ভাসিয়ে দিয়ে যান, যা পিঞ্জর-এর ভেতর থেকেও পিঞ্জর-এর
হাওয়ায় প্রশ্ন হয়ে ভাসতে থাকে, যেন পিঞ্জরের মধ্যে থেকেও ওইটুকু জায়গায় সে মুক্ত। তার
সেই মুক্তিবোধই তাকে প্রশ্ন করায়, আমাদের কাছেও প্রশ্ন রেখে যায়…
“পূরোর
মনে থেকে থেকেই কতগুলো প্রশ্ন জাগে, কিন্তু কোন উত্তরের কথাই ও ভেবে ঠিক করতে পারে
না। ও বুঝতে পারছিল না—এই পৃথিবীর যে মাটির বুক মানুষের রক্তে থইথই ভিজেছে, এরপর সেই
মাটির বুকে আগের মতো আবার গমের সোনাবরণ শিষ উৎপন্ন হবে কি না। এই পৃথিবীর ক্ষেতের মাটিতে
পড়ে মানুষের মৃতদেহ যখন পচে যাচ্ছে, তখন সেই ক্ষেতে উৎপন্ন মকাই-ভুট্টা থেকে আগের মতো
সুগন্ধ বাতাসে বইবে কিনা? এইসব স্ত্রীরা আর এই সমস্ত পুরুষদের জন্য সন্তান জন্ম কি
দেবে—যে পুরুষেরা ওই সব স্ত্রীদের আপন ভগ্নীদের ওপর এমন অকথ্য অত্যাচার করেছে?...”
=========
পিঞ্জর
অমৃতা প্রীতম
অনুবাদক, প্রকাশক, মুদ্রিত মূল্যঃ অজ্ঞাত
সম্ভবত বর্তমানে এর প্রিন্ট পাওয়া যায় না
ছবি কৃতজ্ঞতাঃ ইন্টারনেট
Comments
Post a Comment