জুঠন

 


‘জুঠন’ শব্দটার অর্থ কি? উচ্ছিষ্ট। ভারতবর্ষে মানুষ উচ্ছিষ্ট হয়। আগেও হত। এখনও হয়। যারা এই কথাটাকে মেনে নিতে চাইবেন না তাদের জন্যে আমি একটাই শব্দ উচ্চারণ করব ---

দলিত।

প্রতিদিন, প্রতিনিয়ত কত দলিত নীরবে এক যন্ত্রণাময় জীবন যাপন করছে, সে কি আর আমরা জানি না? এখন তো এদের নিয়ে অনেক সিনেমা কিম্বা ওয়েব সিরিজ হয়। ভারতবর্ষের ‘গোবলয়’ বিখ্যাত হয়েই আছে দলিতদের ওপর নিকৃষ্ট ব্যবহারের জন্য।

দলিত শব্দের অর্থ করা হচ্ছে ‘দমিত’, ‘চূর্ণ-বিচূর্ণ’, বা ‘দলিত-নিপীড়িত’। এরা মূলত ভারতের নিম্নবর্ণের সেইসব মানুষেরা, যারা ঐতিহাসিকভাবে বর্ণপ্রথার কারণে সমাজে বৈষম্যের শিকার হয়েছে। বুদ্ধের আমলের কথা ভাবুন। সে প্রায় আড়াই হাজার বছর আগে! এমনকি বৈদিক সভ্যতা, ইতিহাস যেখানে স্পষ্ট নয়, সেই সমাজও এর বাইরে নয়। দলিতরা প্রধানত চতুর্বর্ণ ব্যবস্থা (ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য, শূদ্র) থেকে সম্পূর্ণভাবে বঞ্চিত, তথাকথিত ‘অস্পৃশ্য’ শ্রেণির মানুষ, যাদের সমাজের নিচু স্তরে ঠেলে রাখা হয়েছিল।

ঠেলে রাখা হয়েছিল বলার থেকে বলা ভাল, ফেলে রাখা হয়। আর তা কতটা নারকীয়তার সঙ্গে হয়, তার উদাহরণ ‘দলিত সাহিত্যে’ ভুরি ভুরি আছে। তারই এক সাংঘাতিক প্রকাশ ওমপ্রকাশ বাল্মীকি-র ‘জুঠন’।

‘জুঠন’ শব্দটা ব্যবহারের একটা উদাহরন দিই। এই বইটা থেকেই দিই বরং। এই বইয়ের ব্যাক কভারে একটা ঘটনার কথা লেখা আছে, যা ওমপ্রকাশজী তার বইতে বিস্তারিতভাবে লিখেছেন---

“বিয়েবাড়ি বা অন্য কোন অনুষ্ঠানে যখন অতিথি বা বরযাত্রীদের অপ্যায়ন করে খাবার খাওয়ানো হত, তখন চুহড়ে জাতির মানুষ বড় বড় ঝুড়ি নিয়ে দরজার বাইরে অপেক্ষা করত। বরযাত্রীদের খাওয়া হয়ে যাওয়ার পর তাদের এঁটো পাতার থালা সেই ঝুড়িতে দিয়ে দেওয়া হত। তারা বাড়ি গিয়ে সেই এঁটো খাবার, পাতা থেকে সযত্নে সংগ্রহ করে আনন্দ পেত। এক আধ টুকরো বেঁচে যাওয়া লুচির টুকরো, মিষ্টির এক আধকণা নয়তো পাতায় লেগে থাকা তরকারির অংশ পেয়েই বাচ্চাদের মুখ হাসিতে ভরে উঠত, খুব মজা করে সেই উচ্ছ্বিষ্ট খাওয়া হত। আর যে বরযাত্রীর খাবার-পাতা একদম চাঁচাপোঁছা থাকত তাদের বলা হত কোথা থেকে এইসব বুভুক্ষু লোক এসে জুটেছে! বরযাত্রীরা মনে হয় কোনদিন খেতে পায়নি। তাই সব কিছু চেটেপুটে খেয়ে গেছে। এই উচ্ছ্বিষ্ট নিয়েও বয়স্করা মজার মজার কথা শোনাত। তারা একেক সময় রোমাঞ্চিত হয়ে কিছু স্মৃতি ভাগ করে নিত। একবার, এমন বরযাত্রী এসেছিল যে প্রচুর এঁটোকাঁটা পাওয়া গেছিল। কয়েক মাস ধরে সেগুলো খাওয়া হয়েছিল। কেউ যে উচ্ছ্বিষ্ট খাওয়ার স্মৃতিও এত আনন্দ সহকারে মনে রাখতে পারে ভাবা যায় না।”

এই উপন্যাসের, বলা ভালো আত্মজীবনীর এই অংশটা পড়ে আমি, সত্যিই বলছি, সেদিন কিছু খেতে পারি নি। আম্বেদকরের জীবন সম্পর্কে আমি যা পড়েছি, এখানে ওমপ্রকাশজীর জীবনেও একই জিনিস দেখতে পাই। স্কুলে পড়তে না দেওয়া, স্কুলে গেলে কেবল কাজ করানো (যেমন ঝাড় দিয়ে স্কুল প্রাঙ্গন পরিস্কার করা কিম্বা একটু এদিক ওদিক হলেই প্রচন্ড মার দেওয়া, সে যাকে বলে গা থেকে রক্ত তুলে দেওয়া মার), কারো বাড়িতে গেলে উঠানেও বসার জায়গা না দেওয়া, পুকুর কিম্বা কুয়ো ব্যবহার করতে না দেওয়া … এগুলো সব শুনেছি। আর বেগার খাটুনির কথা তো ছেড়েই দিলাম। কিন্তু উচ্ছ্বিষ্ট নিয়ে টানাটানি? তা নিয়ে মধুর স্মৃতি রোমন্থন??? আমি যখন পড়ছি, আমার স্পষ্টই মনে হচ্ছিল, ভারতবর্ষের এই পরিচয় আমার কাছে এত অপরিচিত কেন? মঙ্গলে কিম্বা চাঁদে উপগ্রহ পাঠানোর সার্থকতা কোথায়? চুহড় নামক এক জাতি আজও, কোন অন্ধকারে পড়ে রয়েছে, তা কি আমরা খোঁজ রাখি?

‘চুহড়’ জাতি উত্তর ভারতের একটি নিম্নবর্ণের দলিত সম্প্রদায়, যারা সমাজের ‘অস্পৃশ্য’ শ্রেণির অন্তর্ভুক্ত। তারা সাধারণত মেথর, আবর্জনা সংগ্রাহকারী। এছাড়াও মৃত পশুদের চামড়া ছাড়ানোর কাজও তারা করে। ওমপ্রকাশ বাল্মীকি নিজে চুহড়ে সম্প্রদায়ের মানুষ। ফলে তাঁর আত্মজীবনী 'জুঠন' চুহড়ে জাতির দুর্দশাগ্রস্থ জীবন, শৈশবে তার ভোগ করা বৈষম্য, এবং দলিতদের প্রতি সমাজের নিষ্ঠুর আচরণের বাস্তব চিত্র তুলে ধরে, যা পড়ে শিউরে উঠি।

বাস্তব বলে বাস্তব! এ বাস্তবের মুখোমুখি হতে গেলে, আমাদের মতো তথাকথিত উচ্চশিক্ষিত জাতির বুকের পাটা লাগবে। সব সত্যির কি মুখোমুখি হওয়া যায়? না হওয়ার ক্ষমতা আমাদের আছে? আমি রাতের পর রাত জেগে থাকি, ভোরের আলো যখন আমার ঘরে এসে ঢোকে, তখন, সেই আলোতে দেখি, খবরের কাগজে খবর এসেছে, দলিতকে মেরে গাছে ঝুলিয়ে দেওয়া হয়েছে; কিম্বা দলিতকন্যাকে ধর্ষণ করে, খুন করে, পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে; কিম্বা কর্মস্থানে দলিতের ছুঁইয়ে দেওয়ার কারনে পিটিয়ে পিটিয়ে মেরে ফেলা হয়েছে --- এরকম আরও কত খবর। খবরগুলো আমার কাছে আর খবর থাকে না। মনে হয়, আমার গলায় যেন কেউ এক গ্লাস তীব্র অ্যাসিড ঢেলে দিয়েছে। আমার সারা শরীর জ্বলতে থাকে।

বেদনায়, না রাগে? না অসহায়তায়? আমি বুঝতে পারি না।

      ‘জুঠন’ উপন্যাসের পরতে পরতে এমন অনেক বীভৎসতা আছে। এমন অনেক অমানবিক আচরণ বা ব্যবহার আছে। কয়েকটা উদাহরন দেওয়া যাক ---

১। ওমপ্রকাশ যখন প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়তেন, তখন উচ্চবর্ণের শিক্ষকরা তাকে অবজ্ঞার চোখে দেখতেন এবং বৈষম্যমূলক আচরণ করতেন। একদিন, অন্যান্য সহপাঠীদের সঙ্গে ক্লাসে বসতে গেলে, শিক্ষক তাকে ধমক দিয়ে বলেন, "তুই নিচু জাতের ছেলে, তোর জায়গা ক্লাসরুমে নয়!" এরপর তাকে স্কুলের উঠোন ঝাড়ু দেওয়ার আদেশ দেওয়া হয়। একটানা কয়েকদিন ধরে তাকে স্কুলচত্বর পরিষ্কার করতে বাধ্য করা হয়। প্রচণ্ড রোদে ধুলো-ময়লা পরিষ্কার করতে করতে একসময় তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং ক্লান্ত হয়ে কাঁদতে থাকেন। বাড়িতে গিয়ে বাবাকে বলার পর, তার বাবা ক্ষোভ নিয়ে স্কুলে গিয়ে শিক্ষকদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেন। কিন্তু শিক্ষকরা অবজ্ঞার সঙ্গে বলেন, "এই জাতের লোকদের শিক্ষার দরকার কী? তোদের কাজই তো ঝাড়ু দেওয়া!" এই অপমান ওমপ্রকাশের মনে গভীর ক্ষত সৃষ্টি করে এবং ভবিষ্যতে দলিতদের অধিকারের জন্য লড়াই করার সংকল্প কোথাও যেন দৃঢ় হয়।

 

২। উচ্চশিক্ষা শেষে ওমপ্রকাশ বাল্মীকি একটি সরকারি চাকরিতে আবেদন করেন। তিনি পরীক্ষায় ভালো ফল করেও তার নিম্নবর্ণের পরিচয়ের কারণে প্রথমে চাকরি পাননি। যখন তিনি চাকরিতে যোগ দেন, তখন সহকর্মীরা তাকে হেয় করে বলে, "তুই এখানে কীভাবে এলি? তোদের জাতের লোকেরা তো মেথরগিরি করে!" অফিসে বসার জন্য তার আলাদা চেয়ার দেওয়া হয়নি, বরং তাকে বলা হয় মেঝেতে বসতে। সহকর্মীরা তার সঙ্গে খেতে চাইত না, কারণ তারা মনে করত "নিচু জাতের মানুষের হাতের ছোঁয়ায় খাবার অপবিত্র হয়ে যায়"। এত বৈষম্যের পরও তিনি চাকরি করতে থাকেন এবং অবশেষে নিজের যোগ্যতা প্রমাণ করেন।

 

৩। একবার, তার এক উচ্চবর্ণের সহকর্মী প্রকাশ্যে তাকে অপমান করে বলে, "তুই দলিত হয়ে লেখক হবি? এটা তোর কাজ নয়!" তিনি সরাসরি বলেন, "তুমি যতই আমাদের অবজ্ঞা করো, আমি কলম ছাড়ব না। কারণ কলমই আমাদের অস্ত্র!" কবিতার পর কবিতা, কিম্বা গল্প-উপন্যাস, দলিত অবদমনের এক জাজ্বল্য প্রতিফলন হয়ে পড়ে তার সাহিত্য সাধনা। তারই এক অন্যন্য নির্মান হয় ‘জুঠন’।

 

আমি ওমপ্রকাশজীর অন্য কোন লেখা পড়ি নি। পড়ি নি কোন কবিতাও।

কারন, আমি ‘জুঠন’ পড়েছি।

 

===============

জুঠন – এক দলিতের আত্মকথা

ওমপ্রকাশ বাল্মিকী

অনুবাদিকাঃ অ্যাঞ্জেলিকা ভট্টাচার্য

দে’জ পাবলিশিং

মুদ্রিত মূল্যঃ ৪৯৯/-

Comments

Popular posts from this blog

যে বুকে আগুন জ্বলে

শারদীয়া আনন্দবাজার পত্রিকা সম্পর্কে

জেরক্স কপির উন্নত ভার্সানে ‘আবার প্রলয়’ এসেছে