আবার রবীন্দ্রনাথ
“এই ক্ষুদ্র পুস্তকটির নাম আবার রবীন্দ্রনাথ কেন? নিজের রবীন্দ্রনাথ
নামে এই রকমই একটি ক্ষুদ্র পুস্তক প্রকাশ পেয়েছিল আমার ষোলো বছর আগে। পরের পনেরো বছরে
রবীন্দ্রনাথকে বিষয় হিসেবে টেনে এনে সামান্য কিছু লিখেছি আরও। সেইরকম কয়েকটি গদ্য এই
ক্ষুদ্রায়তন গ্রন্থটিতে দিলাম। পাঠক, এই লেখাগুলিকে আমার একান্ত ব্যক্তিগত অনুভব বলেই
গ্রহণ করবেন, এটুকুই অনুনয়। এখানে বলা যে-কোনো কথাকেই যে অক্লেশে উড়িয়ে দেওয়া যায়,
তা আমি মানি।”
লিখছেন জয় গোস্বামী।
তার রাবিন্দ্রীকী জীবনের দ্বিতীয় পর্যায়ে। এই পর্যায়ের বয়স ষোল বছর। ষোলটি বছরে এক
কবি আর এক কবিবরকে নিয়ে কেমন জীবন যাপন করলেন?
“প্রথম দিনের সূর্য?
হ্যাঁ, আমার কাছে রবীন্দ্রনাথই। কারণ মন তৈরির রেওয়াজ দরকার। এবং রবীন্দ্রকবিতার পাঠগ্রহণেই
আমার কাছে তা সম্ভব। সংগীতশিল্পী নিয়মিত রেওয়াজে বসেন যাতে রাগ থেকে ভ্রষ্ট না হন,
গাইবার সময়ে। সুরচ্যুত না হন। এমন অনেক রাগ আছে যাতে বিশেষ-বিশেষ স্বর লাগে না। মালকোষ
যেমন পঞ্চমবর্জিত। খাম্বাজের আরোহণে রেখাব লাগে না। এরকম অনেক পাওয়া যায় সংগীতশাস্ত্রে।
কিন্তু এমন কোনো রাগ কি আছে যেখানে 'সা' বর্জিত-স্বর? রবীন্দ্রনাথ আমার জীবনে সেই
'সা'। এই 'সা' যেন আমার জীবনকে ছেড়ে না যায়।”
কেন? কেন এক কবি
রবীন্দ্রনাথকে এমন নিবিড়ভাবে জড়িয়ে ধরছেন? আমরা জানি, জয় গোস্বামীর আগের পর্বের কয়েকজন
কবি রবীন্দ্রনাথকে অস্বীকার করতে করতে একেবারে লাথি মেরে ফেলে দিতে চেয়েছিলেন নর্দমার
কালো নিবিড়তায়। তবুও, রবীন্দ্রনাথ কেন এত প্রয়োজনীয় হয়ে উঠছেন জীবনে? কেন একজন লেখক
গীতবিতান ছুঁয়ে তার আত্মজীবনীর একটা অংশ লেখেন। কেন? কেন? কেন?
রবীন্দ্রনাথ, তারা
আক্ষরিক অর্থেই জানেন, বাংলা সাহিত্যের গৌরবময় অধ্যায়কে এগিয়ে নিয়ে যেতে হলে যতটা প্রয়োজন,
তার থেকেও অনেক অনেক বেশি প্রয়োজন তাকে নিজের জীবনের ‘ফ্রেন্ড, গাইড অ্যান্ড ফিলোজফার’
হিসাবে। আর তাই, রবীন্দ্রনাথকে অস্বীকার করা যায়, কিন্তু রবীন্দ্রনাথের আশ্রয় ছেড়ে
যাওয়ার কথা ভাবাই যায় না।
“… রবীন্দ্রনাথ
কেবল মহাজগৎকে নিয়েই কবিতা লিখেছেন, তা তো নয়। আমাদের জীবনে কত ছোটো-ছোটো সুখ-দুঃখ
ধরা পড়েছে তাঁর কবিতায়। প্রেমের আনন্দ ও উদ্দীপনা, বিচ্ছেদের মর্মঘাতী বেদনা, বিরহের
আকুলতা ও স্নেহবাৎসল্যের নির্মল মাধুর্য একদিকে, অন্যদিকে সভ্যতার ক্রমাগত পতনদশা ও
অবক্ষয় দেখে তাঁর প্রতিবাদ, যে-কোনো অন্যায়ের বিরোধিতা করা, কবিতারই মাধ্যমে এবং জীবনেও
- এ তো আমরা তাঁর দিকে চোখ রাখলেই দেখতে পাব। রবীন্দ্রনাথের কবিতা ধারাবাহিকভাবে পড়ে
চলা মানে কেবলই দেখতে শেখা। কীভাবে কবিতার মধ্য দিয়ে রবীন্দ্রনাথ জগৎসংসারকে দেখেছেন,
তাঁর কবিতা পড়তে-পড়তে যে-কোনো শিক্ষানবিশ কবি সে-কথা জানতে পারবে। রবীন্দ্রনাথের কবিতার
কাছে আমার ছাত্রাবস্থা এখনও চলছে। কীভাবে দেখতে হবে, মনকে কীভাবে নিয়ে যেতে হবে সব
মলিনতার বাইরে, রবীন্দ্রনাথের কবিতার কাছে এ-বিষয়ে শিক্ষাগ্রহণ- আমার অন্তত এখনও শেষ
হয়নি। যদিও কবি হিসেবে রবীন্দ্রনাথ বেশিরভাগ কবিতা-পাঠকের কাছে থেকে গেছেন যেন একজন
'দূরের কবি' হিসেবেই।”
আমি খুব সাধারণ
পাঠিকা। আমার মতো কোটি কোটি পাঠক পাঠিকা যে সংবেদনশীলতা নিয়ে জীবন যাপন করছে, তার থেকে
হাজার গুণ বেশি সংবেদনশীলতা নিয়ে জীবন যাপন করেন এক কবি। সে কবি হতে পারেন শ্রীজাত;
সে কবি হতে পারেম শঙ্খ ঘোষ, সে কবি হতে পারেন জয় গোস্বামী কিম্বা অন্য যে কেউ – গুলজার,
জাভেদ আখতার বা কে সচ্চিদানন্দন। আমাদের সংবেদনশীলতার মূল্যায়ন করেন এই সব কবিরাই।
আমরা কবিদের প্রতি এত কৃতজ্ঞ থাকি কেন? কারন, আমার বেদনার ভাষা আর ছন্দ জোগান তারা।
তারা আছেন বলেই তাদের আলোকে আমরা নিজেদেরকে নিজেরা চিনতে পারি, নিজেদের ভাষা খুঁজে
পাই। ফলে আমরা সহজেই, অতি সহজেই, রবীন্দ্রনাথকে অস্বীকার করতেই পারি। মনে জানি, আমাদের
আধুনিক কবি হলেই দিব্যি চলে যায়। কিন্তু, আমরা ভেবে দেখি না, কিম্বা গর্বিল আবিলতায়
আমরা দেখতেই চাই না, বিশেষত বাংলা তথা ভারতবর্ষের কবিরা কৃতজ্ঞ থাকছেন কাদের কাছে?
তাদের একজন অবশ্যই
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।
“বাংলা কবিতা এখন
ঐতিহ্যগতভাবে এতটাই সমৃদ্ধিসম্পন্ন যে, রবীন্দ্রনাথের কবিতা ধারাবাহিকভাবে না-পড়লে
কোনো কবিতালেখকেরই লেখার দিক থেকে কোনো ক্ষতি হবে না। তাঁরা সুন্দর ও সার্থকভাবে মুদ্রণযোগ্য
কবিতা লিখে চলতে পারবেন। তবে রবীন্দ্রনাথের কবিতা একাগ্রমনে না-পড়লে ক্ষতি অবশ্য একটা
হবে। সেটা অন্য ক্ষতি। সে-ক্ষতি মনের ক্ষতি। ক্ষতিগ্রস্ত হবে সেই ব্যক্তিটির নিজের
মন। কেননা, কবিতা রচনার কাজ কেবল ভাষার অনুশীলন দ্বারাই সম্ভব, এ-কথা কেউ-কেউ মনে করেন।
প্রকৃতপক্ষে কবিতা রচনা কেবল ভাষার অনুশীলন নয়, আরও বেশি করে মনের অনুশীলন।”
এই পর্যায়ের বইটা
পড়তে পড়তে আমার কেন জানি না মনে হচ্ছিল, এই বই যত না আমাদের মতো ভক্ত পাঠক-পাঠিকাদের
জন্য, তার থেকেও অনেক অনেক বেশি আজকের নবীন কবিকূলের জন্য। কেন? সে তারা নিজেরা পড়ে
বুঝে নিন। কারণ ধ্বনিমাধুর্য, ভাষা বিভঙ্গিমার যেসমস্ত উদাহরন তিনি টেনেছেন, তা আমাদের
মতো ‘আদার ব্যাপারী’দের জন্য নয়। এ যেন জাহাজের নাবিকের জন্য উপযুক্ত কম্পাসের অনুসন্ধানের
ইঙ্গিত।
=================
আবার রবীন্দ্রনাথ
জয় গোস্বামী
ব্ল্যাকলেটার্স পাবলিকেশান
মুদ্রিত মূল্যঃ ২০০ টাকা
Comments
Post a Comment