1984
যে বই নিয়ে কয়েক লক্ষবার আলোচনা করা হয়ে গেছে, সে বই নিয়ে কি
বিশেষ করে কিছু বলা যায়? না আমার মতো অতি সাধারণ পাঠিকার পক্ষে তা মানায়? অবশ্যই মানায়
না। তবে কয়েকটা বিষয়কে সামনে আনা যেতেই পারে। বিশেষ করে কয়েকটা শব্দ, যা কালজয়ী, আর
এই সময়ে দাড়িয়েও কি সাংঘাতিকভাবে প্রযোজ্য!
তার আগে একটা কথা
বলে নেওয়া যাক। ডিস্টোপিয়ান উপন্যাস এর আগে আমি দুটো পড়েছি। অ্যালডাস হাক্সলি-র আর
রে ব্র্যাডবেরি-র। কিন্তু জর্জ অরওয়েল পড়ার সময় আমার মনে হচ্ছিল, এ যেন অন্য লেভেলের
উপন্যাস। তুলনা না করেও বলতে বাধ্য হচ্ছি, ডিস্টোপিয়ান অভিজ্ঞতায় এ আমার পড়া সর্বশ্রেষ্ঠ
উপন্যাস। আর বুঝতে পারছি, হারুকি মুরাকামি কেন 1Q84 নাম দিয়েছিলেন তার উপন্যাসের।
মজার ব্যাপার ভারতে
এই বই অনুবাদ হল ২০২৫ সালে। আর হল তো হল, একেবারে দু-দুটো! ১৯৪৯ সালের বই এখন অনুবাদ
হচ্ছে! ভ্যালা রে বাঙালি! জানি না, এর মাঝে অনুবাদ হয়ে ‘আউট অফ প্রিন্ট’ হয়ে গেছে কি
না, হলে তা আমার জানা নেই। অনুবাদ করেছেন দুইজন। রাকেশকুমার দাস এবং প্রবাল বসাক। একটা
বেরিয়েছে কল্পবিশ্ব থেকে, আরেকটা ফিঙ্গারপ্রিন্ট পাবলিকেশান থেকে। আমি যেদিন জানলাম,
ঠিক সেইদিনই কল্পবিশ্বের বই আমার হাতে চলে এসেছে। ফলে অধিক মুল্য দিয়ে বইটা কিনেছি,
ঠকিনি, কারণ, অনুবাদ খুবই ভাল। প্রবাল বসাকের অনুবাদ কেমন তা যারা কিনবেন এবং পড়বেন,
তারাই বলতে পারবেন, আপাতত তার অনূদিত ‘অ্যানিমেল ফার্ম’ অর্ডার দিয়েছি, এল বলে।
বইয়ের বিষয়ে ফিরে
আসি। কিছু মূল বিষয় যেগুলো বর্তমান সময়ের সঙ্গে মিল খায়:
"Big Brother is watching you" — সিসিটিভি, অনলাইন
নজরদারি, সোশ্যাল মিডিয়া ট্র্যাকিং – এ তো হামেশাই হচ্ছে।
Newspeak — রাজনৈতিকভাবে গ্রহণযোগ্য ভাষা তৈরি করে সত্যকে দুমড়ে
মুচড়ে পরিবেশন করা;
Doublethink — একই সঙ্গে দুই বিপরীত চিন্তার সহাবস্থান এবং
সেটাকে মান্য করা;
Historical revisionism — ইতিহাসকে পাল্টে ফেলা, প্রপাগান্ডা;
Thoughtcrime — মতপ্রকাশের স্বাধীনতা নিয়ন্ত্রণ।
আমার মতে, 1984
হচ্ছে সবচেয়ে রাজনৈতিক, সবচেয়ে ধ্বংসাত্মকভাবে বাস্তব। তার কারণই হল, ক্ষমতা ও নিয়ন্ত্রণের
নিষ্ঠুর ব্যাখ্যা। যেভাবে ভাষাকে (Newspeak) সংকুচিত করে মানুষকে চিন্তা করতেও নিরুৎসাহিত
করা হয়, বা কন্ট্রোল করা হয় সেটা আমাকে সবচেয়ে বেশি শিহরিত করে। ভাষা এমন এক বিষয় যা
মানুষের একেবারে মাটির সাথে, তার জীবনের সাথে, তার স্মৃতির সাথে মিশে আছে। তাকে নিয়ন্ত্রণ
করতে পারলে সভ্যতার কন্ট্রোল অনেকটাই রাষ্ট্রযন্ত্রের হাতের মুঠোয়। তাই না?
মনে রাখতে হবে,
অরওয়েল নিজেকে গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রী মনে করতেন। তিনি সমাজতন্ত্রে বিশ্বাস করলেও,
ছিলেন স্ট্যালিনবাদী একনায়কত্ব এবং ফ্যাসিবাদ উভয়েরই কঠোর সমালোচক। ১৯৩৬ সালে স্পেনের
গৃহযুদ্ধে ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে লড়াই করতে যান এবং সেখানে সোভিয়েত-সমর্থিত কমিউনিস্টদের
দ্বারা বিপ্লবীদের দমন প্রত্যক্ষ করেন, যা তার রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গিকে গভীরভাবে প্রভাবিত
করে। ফলে অরওয়েলের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা, যেমন ঔপনিবেশিক প্রশাসনে কাজ করা, স্পেনের গৃহযুদ্ধে
অংশগ্রহণ, এবং তার রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি — সবকিছুই 1984 উপন্যাসের থিম ও বার্তার
মধ্যে গভীরভাবে প্রোথিত। এবং এখানেই উপন্যাসটা কয়েক দশক পেরিয়েও আজও অলোচনার কেন্দ্রে,
কারণ, বিষয় এক, কেবল টেকনোলজি বদলে গেছে, মডার্ণ হয়েছে --- History repeats
itself.
“যুদ্ধই শান্তি,
স্বাধীনতা মানে দাসত্ব, অজ্ঞতাই বল” --- আমাকে চমকে দেয়।
পার্টি সারাক্ষণ যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে
— বাইরে ‘অশান্তি’
চলছে যুদ্ধ চলছে (আদৌ চলছে কি?), যাতে ভেতরের জনগণ ‘শান্তিপূর্ণভাবে’ নিয়ন্ত্রিত থাকে।
যুদ্ধ মানুষের মনোযোগ সরিয়ে দেয় প্রশ্ন করার দিক থেকে। তারা দুশ্চিন্তায় পড়ে, আতঙ্কে
থাকে — আর আতঙ্ক
রাষ্ট্রযন্ত্রের ওপর নির্ভরশীলতা বাড়িয়ে দেয়। আর এটাই পার্টির চোখে 'শান্তি'। যদি আমি
স্বাধীনভাবে চিন্তা করি, তাহলে আমি মূলস্রোতের বাইরে এসে দাঁড়ালাম — তার মানে আমি একা। মনে পড়ে হীরক রাজার
দেশে-র সেই সংলাপ --- “এরা যত বেশি পড়ে / তত বেশি জানে / তত কম মানে।” ‘একা’ মানে দুর্বল,
ভীত, ধ্বংসের পথে — সুতরাং
‘স্বাধীন হওয়া’ মানে নিজেকে ধ্বংস করা। এতএব, তারা চায় মানুষ নিজেই বিশ্বাস করুক যে
দাসত্বই সবচেয়ে নিরাপদ। যদি জনগণ কিছু না জানে, কিম্বা ভুলটাকেই ঠিক বলে জানে — তাহলে তারা প্রশ্নও করবে না, চিন্তাও
করবে না। তাহলেই রাষ্ট্রযন্ত্র শক্তিশালী থাকবে। আমি যদি সত্যিটা জানি, তাহলে আমি বিপজ্জনক।
ডাবলথিংকের কি অসামান্য প্রয়োগ!
আর অদ্ভুত ব্যাপার হল, মানুষ শেষমেশ
এইসব স্লোগানকে ভালোবাসে। ওরা শুধু মান্য করে না, বিশ্বাস করতেও শেখে। এটাই
Orwell-এর ট্র্যাজেডি। এই প্রসঙ্গেই Fake News, Alternative Facts, War on Terror
is Peace – ইত্যাদি কতরকমের কথা মনে পড়ে যাচ্ছে!
Orwell নিজেই বলেছেন:“1984 is not a prophecy. It is a
warning.” তাঁর শঙ্কা ছিল — সমাজ যদি
ক্ষমতাকে প্রশ্ন না করে, মানুষের ব্যক্তিসত্তা যদি নিঃশেষ হয়ে যায়, ইতিহাস যদি মুছে
ফেলা হয় বা পরিবর্তন করে ফেলা যায় তাহলে এক সময় মানুষ Doublethink–এ বিশ্বাস করবে,
যুদ্ধকে শান্তি ভাববে, অজ্ঞতাকে শক্তি বলে মেনে নেবে, এবং নিজেকে ভালোবেসে নয়, Big
Brother-কে ভালোবেসে বাঁচতে শিখবে।
আমি শিউরে উঠি। কারণ, অরওয়েল বারবার
বলতে চান, এটা হচ্ছে, এবং আমরা টের পাচ্ছি না। যার ফলে, আমরা বুঝতেই পারছি না, Big
Brother আর Goldstein — একে অপরের বিপরীত নয়, বরং একই মুদ্রার দুই পিঠ।
শেষ করি আরেকটা বিষয় দিয়ে, পরিসংখ্যান
কীভাবে মানুষকে বোকা বানানোর অস্ত্র হয়ে উঠতে পারে? আমরা জানি, পরিসংখ্যান নিজে নিরপেক্ষ,
কিন্তু প্রেজেন্টেশন আর পাঠকের বোধের অভাব মিলিত হয়ে এটা প্রোপাগান্ডার হাতিয়ারে পরিণত
হতে পারে। কত কত এমন দিকভ্রষ্টতার উদাহরণ আছে --- গ্রাফিক্যাল বিভ্রান্তি; অনুকূল তথ্য
বেছে নেওয়া (Cherry‑Picking), সাম্প্রতিক বা ছোট নমুনায়
নির্বিচার সিদ্ধান্ত (Small Sample Size), লোডেড প্রশ্ন ও জরিপের গঠনগত পক্ষপাত
(Loaded Questions), অনুপাতে(%)–এর বদলে আপেক্ষিক পরিবর্তন দেখানো, কনফাউন্ডিং ভেরিয়েবল
উপেক্ষা (Ignoring Confounders) --- এরকম কত যে আছে বা থাকতে পারে তা অর্থনিতীবিদরা
বলবেন, যে কারনে, বইমেলাতে কোটি কোটি টাকার বই বিক্রী হলেও, প্রতি বছর মূল্যের আঙ্গিকে
বিক্রীর পরিমাণ বাড়লেও, বইমেলার মধ্যেই বইয়ের এডিশান শেষ হয়ে গেলেও, আমি জানি, এতে
বিশ্বাস করার কিছু নেই যে, বাঙালী বই পড়ছে। বরং, সন্দেহ হয়, বাঙালী কি সত্যিই বই পড়ছে?
অবিনির্মান? থ্যাংকু গায়ত্রী ম্যাম।
যাই হোক, আমি যদি বর্তমান সময়কে গভীরভাবে
চিন্তা করতে চাই — বিশেষ করে
নজরদারি, সত্যের বিকৃতি, রাজনৈতিক ভাষার অপব্যবহার, এবং মানুষের মানসিক নিয়ন্ত্রণ — তাহলে জর্জ অরওয়েলের 1984 এখনো ভয়ঙ্করভাবে
প্রাসঙ্গিক। এই উপন্যাসটা পড়ে আমার আশঙ্কা হয়, অনেক ক্ষেত্রেই হয়তো বা সেই ডিস্টোপিয়ান
ভবিষ্যতের খুব কাছাকাছি চলে এসেছি আমরা, যেটা অরওয়েল ১৯৪৯ সালে কল্পনা করেছিলেন।
===================
১৯৮৪
জর্জ অরওয়েল
অনুবাদকঃ রাকেশকুমার দাস
কল্পবিশ্ব পাবলিকেশান
মুদ্রিত মূল্যঃ ৫২৫/-
-------
অনুবাদকঃ প্রবাল বসাক
ফিঙ্গারপ্রিন্ট পাবলিশিং
মুদ্রিত মূল্যঃ ২৯৯/-
-------
ছবি কৃতজ্ঞতাঃ সমর্পিতা
Comments
Post a Comment