নিজের রবীন্দ্রনাথ

 


“এই হল আমার নিজের রবীন্দ্রনাথ। তাঁকে বোঝা-না-বোঝা। সেই জন্যই রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে প্রকাশ্যে বলতে অস্বস্তি হয়। কেন না, বলতে হলে তো নিজেরই অজান্তে ভক্ত হয়ে বলব। ভক্তের মতের দাম নেই। জানি, চোখে জল এসে পড়লে তা দিয়ে সাহিত্যের বিচার হয় না। চকখড়ির দাগ ধুয়ে যায়। দণ্ডী কাটা যায় না। এবং এও জানি, রবীন্দ্রনাথকে সকলেরই দরকার হয় না। রবীন্দ্রনাথকে ছাড়াই বহু মানুষের জীবন চলে যাচ্ছে। জানি। রবীন্দ্রনাথকে দরকারও হচ্ছে অনেকের। নিজের কোনও মতকে জোরের সঙ্গে স্থাপন করবার জন্য রবীন্দ্রনাথের কোনও কোটেশন- কবিতা, প্রবন্ধ বা বক্তৃতা কি চিঠিপত্র যাই হোক— ব্যবহার করা যায়। এ ছাড়া, রবীন্দ্রনাথকে উড়িয়ে দেবার জন্যও, অথবা তেমন ভালো কবি ছিলেন না, বলবার জন্যও রবীন্দ্রনাথকেই ব্যবহার করতে হয়। আক্রমণ করবার জন্যও তাঁর চেয়ে উপযুক্ত কিছু এখনও বাংলার সংস্কৃতিতে আবিষ্কৃত হয়নি। তবে এ সবই নিজের নিজের দরকারে। অপরের সামনে নিজের প্রতিষ্ঠা আরও শক্ত করবার দরকারে। এজন্য রবীন্দ্রনাথকে লাগে।”

      বলছেন জয় গোস্বামী। আমাদের সময়ের অন্যত্ম শ্রেষ্ঠ। এক কবি আর এক কবিকে দেখতে চাইছেন, যে তার অগ্রজই নন, বাংলা সাহিত্যের অবিসম্বাদিত গুরু-কবি। কন কবি রবীন্দ্রনাথকে অস্বীকার করবেন? কোন সাহিত্যিক রবীন্দ্র-প্রতিভাকে এড়িয়ে যাবেন? কে আছে, সেই বঙ্গপুত্র।

      “রবীন্দ্রনাথের কবিতা ধারাবাহিকভাবে পড়লে পুনরাবর্তন অনেকই পাওয়া যায়। ঠিক, তবে তাঁর চেয়ে অনেক কম লিখেছেন কবিতা, এমন প্রধান কবিদের মধ্যেও পুনরাবৃত্তি দেখি আমরা। তার একটা কারণ হয়তো এই, নিজস্ব একটি ভাষা তৈরি করতে যিনি পারেন তিনি নিশ্চয়ই শক্তিমান কবি। কিন্তু সেই ভাষাটি হয়ে পড়ে তাঁর আশ্রয় বা রক্ষাপীঠের মতো। সেটিকে স্বহস্তে ভাঙবার ঝুঁকি নিতে পারা যায় না। একবার-দুবার ঝুঁকি কেউ কেউ নিয়েছেন আমাদের ভাষায়। কিন্তু রবীন্দ্রনাথের মতো এত অজস্রবার নতুন হয়ে উঠতে আমি দেখিনি কোনও কবিকে।”

      জয় গোস্বামী নিজেকে বললেন, না তাবত কবিকূলকে বললেন? তাবত ভারত কবিকূলকেই বললেন বোধহয়। সেই কবিদের আর্টের মধ্যে আমাদের প্রবেশ কষ্টকর। কয়েক মাত্রার ছন্দে এক অনির্বচনীয় আবেগকে ধরার যে ব্যকরণ, তা কি আমাদের জন্য? নিশ্চই নয়। কোন কবি সেই উদ্দেশ্যে কবিতা লিখবেন না, কবি দেখবেন, তার সেই অনুভুতির সাথে আমরা সাধারণীরা কতটা যুক্ত হতে পারছি। সেইখানেই কবির সার্থকতা। তাহলে আমাদের জন্য, পাঠকদের জন্য, জয় গোস্বামী কি বললেন?

      “সৌন্দর্যকে আমার জীবনে এনে দিয়েছেন রবীন্দ্রনাথ। তাঁর গানের মধ্যে ধরা আছে আমার প্রেমের ধারণা। প্রথম তারুণ্যে, যখন কোনো নারী আসেনি জীবনে, তাঁর যে-গান শুনতে শুনতে প্রস্তুত হয়ে উঠতাম না আসা ভালোবাসার জন্য, অপেক্ষা করতাম- আজ সেই একই গান শুনতে শুনতে দূরে চলে যাওয়া ভালোবাসাকে দেখতে পাই। কিন্তু তার মধ্যে কোনও ক্ষয়, গ্লানি বা হতাশাও নেই। বরং মনে হয় যৌবন একদিন জেগে ওঠে, থাকে কিছুকাল, তারপর এক সময় আবার চলেও যায়। কিন্তু রবীন্দ্রনাথের গানের মধ্যে ধরা থাকে তার সমস্ত আবেগ বিষাদ সৌন্দর্য। জীবনে না থাকলেও রবীন্দ্রনাথের গানে ধরা রইল আমাদের প্রেম। অনেক গান আজ নতুন করে চিনতে পারি।”

      আর নিজের অভিজ্ঞতায় রবীন্দ্রনাথ কেমনভাবে এসেছে কবি জয় গোস্বামীর? যেখানে তিনি পুত্র, স্বামী, বন্ধু, পিতা?

      “আমার মা বাবা ভাইয়ের সঙ্গে শৈশবে, আমাদের পরিবারের একজন হয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। আমার বাবা বসাতেন গান কবিতার আসর, শ্রোতা ও দোহার ছিলাম আমি আর আমার ভাই। আর এখন বাড়িতে, আমাদের একটি সদস্য আছে তার নাম গিতো। গীতবিতান। মেয়ে হস্টেল থেকে এসে খোঁজ করে গিতো কই। বইটি পুরোনো হয়ে ছিঁড়ে এসেছে। তাকে একটি ব্যাগে ভরে রাখা হয়। সেটি তার ঘর। ছুটির দিন সন্ধেবেলা অনেক সময় আকাশপ্রদীপ পলাতকা মহুয়া থেকে কবিতা পড়ি আমি, মেয়ে খেয়ালখুশিতে গান গায়। মেয়ের মাও হয়তো গলা মেলাল তার সঙ্গে। কোনও একটা ক্যাসেট চালিয়ে তিনজনেই হয়তো মেতে গেলাম শেষে এই জলসায়। আমাদের কার্যক্রম শিল্পের মান অনুযায়ী নয়। কিন্তু আমাদের সন্ধেবেলার ওই ছোটো ঘরটাই যে তখন শিল্প হয়ে উঠল।

আর এই সবের মধ্যে পড়ে, রবীন্দ্রনাথও আর আমার কাছে তেমন একটা বিশ্বকবি হতে পারলেন না। বাড়ির লোক হয়েই রইলেন।

অথচ অন্য দিকে তার অজানার রহস্যও গভীর হয়ে চলেছে দিনে দিনে। এই আপন আর অজানা নিয়ে আমার নিজের রবীন্দ্রনাথ।

রোজ যার বিস্তার হচ্ছে অসীম কোনো রাগমালার মতো। কত দিকেই যে চলেছে সেই সুর, কতটুকু বা বলতে পারি?”

মাত্র ৮৮ পৃষ্ঠার ছোট্ট এক বই, অথচ কি বিস্ময় নিয়ে এসেছে আমার কাছে। রবীন্দ্রনাথকে তিনি ধরেছেন তার কবিতায়, স্মৃতিচারণে, আর কবিতার কাঁটাছেড়ায়। অনুভূতির স্তরে স্তরে সেই প্রকাশ… একটা কবিতা দিয়ে এ গ্রন্থের পরিচয় শেষ করি…

শুভেচ্ছা, অপরাজিত আলো

ভোর এসে জানলায় দাঁড়াল-

 

সারা রাত্রি রেখেছে সম্মান

শিমুলপলাশ ভরা প্রাণ

 

চুরি ক'রে দেখার কারণে

লুকিয়েছি আগুনের বনে

 

গায়ে অগ্নিগাছ জন্ম নেয়

লুপ্ত হও, হে ন্যায় অন্যায়

 

দেহ পেতে রেখেছে খোয়াই

ঘাটে ঘাটে আঙুল ছোঁয়াই

 

শরীর আনন্দে পুড়ে খাক্

কাল ভোরে পঁচিশে বৈশাখ

===========

নিজের রবীন্দ্রনাথ

জয় গোস্বামী

প্রতিভাস

মুদ্রিত মূল্যঃ ১০০/-

Comments

Popular posts from this blog

যে বুকে আগুন জ্বলে

শারদীয়া আনন্দবাজার পত্রিকা সম্পর্কে

জেরক্স কপির উন্নত ভার্সানে ‘আবার প্রলয়’ এসেছে