ডাবলিননামা

 


সমস্ত লেখকই সমসাময়িক, তার লেখনীতে তার সময়কার প্রভাব থাকতে বাধ্য, অল্পবিস্তর হলেও, এদের মধ্যে কয়েকজন আবার পূর্ণমাত্রায় সমসাময়িক। অর্থাৎ, তার লেখা পড়তে হলে সেই সময়ের লেখকের বাসস্থানের আশেপাশে ইতিহাসটা বেশ গুরুত্বপূর্ণ। যেমন রবীন্দ্রনাথের ‘গোরা’ পড়তে হলে ঊনবিংশ শতকের ধর্মীয় দ্বন্দ্ব, বিশেষ করে হিন্দুসমাজ ও ব্রাহ্মসমাজের শহরকেন্দ্রিক দ্বন্দ্ব সম্পর্কে জ্ঞান না থাকলে রসভঙ্গ হতে বাধ্য। ‘গোরা’ তো আর গোরা-সুচরিতা কিম্বা বিনয়-ললিতার প্রেমকাহিনী নয়। সেটা পার্শ্বঘটনা। তেমনই জেমস জয়েসের ‘ডাবলিননামা’ পড়তে হলে তার সময়ের আয়ারল্যান্ড এবং তার লেখার স্টাইলটা সম্পর্কে অবগত থাকতে হবে। নচেৎ, গল্পগুলোর সাথে কমিউনিকেট করা, অনেক ক্ষেত্রেই, অসম্ভব, সেদিক থেকে দেখলে ডাবলিনার্স পড়াটাই ব্যর্থ হয়ে যাবে। শুধু তাই নয়, জয়েস-ম্যাজিক আরও অনেক ক্ষেত্রে আছে, তা এক-এক করে আসছি।

আয়ারল্যান্ড ইংলন্ডের অধীনস্থ রাজ্য। জয়েসের সময়ের আয়ারল্যান্ডের অবস্থাটা ঠিক কি রকম? আয়ারল্যান্ডের মূল শহর ‘ডাবলিন’-কে কেন্দ্র করে জয়েসের এই গল্পগুচ্ছ আসলে আয়ারল্যান্ডের ক্ষয়িষ্ণু অবস্থার লিপিকাহিনী। ভূমিকায় দেখি, “ডাবলিনার্স –এর গল্পগুলি তৎকালীন ডাবলিনের একটি অত্যন্ত বাস্তবধর্মী খন্ডচিত্র। সে ছবিতে যেমন রুঢ়তা রয়েছে, দৈনন্দিন নাগরিক জীবনের ক্লিন্নতা, বিষাদের ছোঁয়া আছে তেমনই রয়েছে একটি ঔপনিবেশিক সমাজের, একটি পরাধীন জাতির নিত্য গ্লানির অভিজ্ঞতা।” এইটা সবচেয়ে ভালো করে বুঝতে হবে। কারণ এই অবস্থার প্রভাব বা প্রতিফলন পড়েছে চরিত্রগুলোর মধ্যে, তার শহরের বর্ণনার মধ্যে। এই অভিজ্ঞতায় কোন কোন দিক এসেছে? রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব, শ্রেণীগত দ্বন্দ্ব, ধর্মীয় দ্বন্দ্ব।

জয়েস পনেরোটি গল্পে ডাবলিনার্স-কে সাজিয়েছেন। এরও কিন্তু চারটি পর্যায় আছে --- শৈশব (৩), কৈশোর (৪), পূর্ণতাপ্রাপ্তি (৪) এবং জনজীবন (৪)। প্রতিটা পর্যায়ের গল্পগুলোকে স্টাডি করলে দেখা যাবে সেখানে বেশ কয়েকটা বিষয়ের ওপর গল্পের ভিত্তি – Realism / Naturalism, Epiphany, Paralysis & Death / Decay.

জয়েসের ‘এপফেনি’ এক অদ্ভুত দর্শন। কিন্তু তার আগে দেখে নিতে হবে বিষয়টা কি? এপিফেনি – আকস্মিক আধ্যাত্মিক অন্তর্দৃষ্টির ঝলক, যা নিতে পারে রূঢ় বাক্যালাপের দৈনন্দিন রূপ, কোনো বিষেষ ইঙ্গিতের রূপ, যা চেতনার কোন অবিস্মরণীয় পর্বের রূপ। বলেছিলেন জয়েস নিজেই। ব্যাপারটা একটু বোঝানো যাক।

‘এপিঠ-ওপিঠ’ গল্পে বার্নার্ড যে অফিসে কাজ করে, সেই অফিসের সমস্যায় সে জর্জরিত। পরিশ্রমে পরিশ্রমে বিধ্বস্ত, বিরক্ত। এইখানে একটা এপিফেনি-র টুইস্ট - “গোটা অফিসকে একা হাতে সাবাড় করে দিতে পারবে – এতটাই শক্তিশালী মনে হচ্ছিল নিজেকে। কিছু একটা করার জন্য তার শরীর আনচান করছিল। ইচ্ছে করছিল এক ছুটে বেরিয়ে হিংস্র কোন ঘটনায় আনন্দের সঙ্গে যোগ দিতে। তার জীবনের সমস্ত অপমান তাকে ক্রুদ্ধ করে তুলেছিল।” ঠিক এই লাইনগুলোর পেছনের অনুভুতি শুধুমাত্র সেই সময়ের ডাবলিন নয়, তার প্রতিধ্বনি যেন, হঠাৎ উড়ে এসে, যেন মনে হয় কলকাতার অফিস পাড়াতেও এসে আছড়ে পড়ছে। প্রতিদিন কত বার্নার্ডের এ কথা মনে হয়? আর তারপর তার সেই বিষন্ন একাকীত্বের ক্ষুব্ধত্ব সে উগড়ে দেয় বাড়ি ফিরে। গোটা গল্পের শেষে ঠিক তাই হয়। বড়ো মর্মান্তিক সে দৃশ্যায়ন।

পড়ার সময় এই আবিস্কারগুলোই আমাকে মুগ্ধ করে দেয়। নচেৎ, শহরতলীর এই সময়ের একজন যুবতী কীভাবেই বা শতবছরের প্রাচীন ডাবলিনের সাথে নিজের অনুভুতিকে যুক্ত করতে পারবে? একজন মানুষ যে কবি হতে চেয়েছিল, লন্ডনে যেতে চেয়েছিল, ইচ্ছা ছিল সবাই তাকে চিনুক, দিনের শেষে সে-ই একজন সামান্য কেরাণি মাত্র। একজন নিরীহ গোবেচারা অতি-সাধারণ যুবক সংসারের দারিদ্রতার সাথে লড়তে লড়তে ক্লান্ত। তবুও মনে মনে পোষন করে সেই আশা – “গ্যালাহারের মতো বুক ফুলিয়ে নিজের মর্জিতে বাঁচার পথ কি তার কাছে আর নেই? সত্যিই কি খুব দেরী করে হয়ে গেছে?” এই অনুভূতির পেছনে যে অসম্ভব যন্ত্রণা কাজ করে, তার বহিঃপ্রকাশ হয় গল্পের শেষে। “ছেলে এবার উঠে কাঁদতে লাগল। ক্ষুদে শ্যান্ডলার বই ছেড়ে তাকে শান্ত করতে গেল কিন্তু থামাতে পারল না। কোলে দুলুনি দিতে গেলে তার চিৎকার তীব্র হয়ে উঠল। ... তার দ্বারা কিছুই হয় না! ছেলের চিৎকার তার কানের পর্দা ফাটাতে লাগল। কোন অর্থ নেই, কোন অর্থ নেই! সারা জীবনের জন্য তার হাত পা বাঁধা। রাগে তার হাত কাঁপতে লাগল এবার। হঠাৎ ছেলের মুখের সামনে গিয়ে সে চিৎকার করে বলে উঠল, চোপ!” গল্পের নাম, এক ক্ষুদে মেঘ।

ডাবলিনার্স-র সবচেয়ে জনপ্রিয় গল্পগুলো হল দুই বোন, অ্যারাবি, এভ্‌লিন, এক ক্ষুদে মেঘ, যারা মৃত ইত্যাদি। সেগুলো নিয়ে আলোচনা প্রচুর --- কিন্তু এর বাইরে বাকি গল্পগুলোর কয়েকটা আমাকে কোথাও যেন একটা মর্মান্তিক ধাক্কা দিয়ে যায়। ‘এদিক-ওদিক’ গল্পটা তার মধ্যে অন্যতম।

জয়েসের গল্পের আরেকটা বড়ো ব্যাপার ‘সিম্বল’ বা প্রতীকের ব্যবহার। ‘বোর্ডিং হাউস’ গল্পে বোর্ডিং হাউস আসলে সমাজের মধ্যে একটা ছোট সমাজ তৈরী করে তার মধ্যে নিজস্ব সমাজব্যবস্থা চালু করার প্রতীক। যেখানে মালকিন মিসেস মুনিরের ভয়ে সবাই কাঁপে। অথচ মিসেস মুনিরকে ডাবলিনের কেউই খুব একটা চেনে না। ‘অ্যারবি’ গল্পের কিশোর অ্যারাবি নামে স্থানীয় মেলায় যেতে চায়। সে থাকে একটা নিস্তব্ধ কানা গলি-র মধ্যে। সন্ধের আলো-আঁধারিতে সে অপেক্ষা করে, কখন সময় হবে। উদ্দেশ্য ম্যাঙনের দিদি-র জন্যে কিছু কিনে আনার, যাকে সে মনে মনে ভালোবাসে। ‘অ্যারাবি’ রোমান্টিসিজমের প্রতীক; ‘নিস্তব্ধ কানা গলি’ তার নিজের জীবনের হতাশার প্রতীক, যা সমাজ তাকে দিয়েছে; ‘সন্ধ্যের আলো-আঁধারি’ তার স্বপ্ন আর বাস্তবের দ্বন্দ্ব। যা সেই সময়ের ডাবলিনের সামাজিক অবস্থাকেও তুলে ধরে, এক অদ্ভুত ভঙ্গিমায়। আমি প্রতিটা গল্প প্রথমবার গোগ্রাসে পড়ি, তারপর একটু একটু করে সাবধানে পড়ি দ্বিতীয়বার। প্রতীকগুলোকে খুঁজে বার করি। বিস্মিত হই। আমার কাছে ডাবলিনার্স কেবলমাত্র গল্পগুচ্ছ থাকে না। তা এক অদ্ভুত সময়ের ভান্ডারকে তুলে ধরে। যে সময় আমার থেকে অনেক দূরের কিন্তু কত কাছের – একটা পাজলের মতো তার রহস্যের খুঁটিনাটি খুঁজে বের করতে থাকি।

এক সময়ে, কখন যেন, গল্পগুলো শেষ হয়ে যায়। আমি টেরও পাই না।

তবুও কোথাও যেন গল্পগুলো নিস্তরঙ্গ, উত্তাল নয়। এর মধ্যে ব্যাপক ড্রামা নেই। কারণ, গল্পগুলো অতি সাধারণ অবস্থার কথা অতি সাধারণভাবে বলে। সেগুলোর মধ্যে কোন চরম ড্রামা নেই। সেখানেই সে গভীরতাকে ছুঁয়ে যায়। আমাদের দৈনন্দিন জীবনের মতোই গল্পগুলো নিস্তরঙ্গ।

তাই জেমস জয়েস পড়তে গেলে একটা ব্যাপার বুঝে নিয়েই পড়তে হবে। ভুমিকাতে লেখা আছে ---

“তবে একথা ঠিক যে জয়েসের সমসাময়িক আধুনিক শিল্পীদের মতো, তাঁর লেখাতেও প্রতিষ্ঠিত ঘরানার বিপরীতে পাঠকের সাথে সাহিত্যের এক নতুন সম্পর্ক গড়ে ওঠে। তিনি দাবি করছেন পাঠক অভ্যাসগত পাঠ-প্রণালী ত্যাগ করে চরিত্রের দৃষ্টিকোণ থেকে গল্পের ঘটনাগুলি উপলব্ধি করার চেষ্টা করেন। এক ভাবে দেখতে গেলে ডাবলিনের রাস্তাঘাট, মানুষজন, এমন কি ইতিহাসের সাথেও আরও গভীর, আরও ঘনিষ্ঠ এক সম্পর্ক গড়ে তোলার আহ্বান জানাচ্ছেন জয়েস। গল্পের মাধ্যমে সেই সময়ে, সেই জায়গায়, সেই ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে আমাদের জন্য জায়গা করে দিচ্ছেন। ছোটগল্পে আমরা সাধারণত অপ্রত্যাশিত কোন টুইস্ট খুঁজে পেতে অভ্যস্ত। কিন্তু সেই টুইস্ট নির্ভর করে পাঠকের অভ্যাস ও প্রত্যাশার উপর। পাঠক-কেন্দ্রিক গল্প থেকে সরে এসে জয়েস আমাদের সাথে আলাপ করিয়ে দিচ্ছেন এক নতুন ধরনের ফিকশানের সঙ্গে, যার কেন্দ্রে রয়েছেন তাঁর চরিত্র ও তাদের বহুমাত্রিক বাস্তব। পাঠক তাতে যোগ দিতে পারেন। তবে বহিরাগত, নিস্পৃহ দর্শক হিসাবে নয়, সহানুভূতিশীল আগন্তুক হিসাবে।”

======================

ডাবলিননামা

জেমস জয়েস

যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় প্রকাশনা

মুদ্রিত মূল্যঃ ৪৫০/-

ছবি কৃতজ্ঞতাঃ সমর্পিতা

Comments

Popular posts from this blog

যে বুকে আগুন জ্বলে

শারদীয়া আনন্দবাজার পত্রিকা সম্পর্কে

জেরক্স কপির উন্নত ভার্সানে ‘আবার প্রলয়’ এসেছে