২৪ শ্যামানন্দ রোড বিশ্বায়ন পূর্ববর্তী কলকাতা
এই বইটার রিভিউ অনেক আগেই দিয়ে দিতে পারতাম, দিই নি, কারণ,
দুটো বই ঘিরে আমার প্রাথমিক অভিজ্ঞতার প্রতিক্রিয়া। আমি নিজেও ক্ষিপ্ত ছিলাম, সবুজ
মুখোপাধ্যায়, খোয়াবনামা-র প্রকাশক ও তাদের অন্ধ ভক্তেরাও উন্মত্ত ছিলেন, এবং সেই সময়ে
বইটির রিভিউ ঠান্ডা মাথায় করা যেত না।
একটা শব্দ আমি
ভুলে গিয়েছিলাম – Nostalgia, ‘নস্টালজিয়া’ শব্দটির বাংলা অর্থ হলো স্মৃতিবেদনা বা
স্মৃতিবিধুরতা। এটি একটি আবেগপ্রবণতা যা অতীতের কোনো বিশেষ সময় বা ঘটনার জন্য মন কেমন
করে। সাধারণত, এটি পুরনো ছবি, গান, বা স্মৃতির সাথে জড়িত।
আমি ভুলে গিয়েছিলাম,
প্রতিটি বাঙালীই অতীত ইতিহাস, যার সাথে বিশেষত, সে নিজে জড়িত, তাকে খুব সঙ্গোপনে, নরম
হৃদয়ের ভেতরে অজ্ঞাতবাস করায়। এবং সেইখানে যদি কেউ খোঁচা দেয়, তাহলে, তা সাপের লেজে
পা পড়ার মতো হয়ে যায়। ঠিক সেই কারনে গায়ত্রীর বইয়ের তঞ্চকতা নিয়ে যখন গলা ফাটাচ্ছি,
তখন এই স্মৃতিমেদুর ভক্তকূলকে মাথা ঘামাতে দেখি নি। নান্দনিকতা-র যোগ্য সমর্থন কি অনুষ্টুপের
প্রকাশকেরা পান নি? সেখানে কি কোন স্মৃতিমেদুরতা বা আবেগপ্রবণতা ছিল না?
যাই হোক, ধান ভানতে
শীবের গাইব কেন আমি? আমি বলব আমার কেমন লেগেছে এই বইটা পড়তে। কেমন লেগেছে বলতে রীতিমতো
ভয় পাচ্ছি। কেন? বইটা শুরুই হচ্ছে তৃতীয় সংস্করণ দিয়ে এবং সেইখানে লেখা আছে শঙ্খ ঘোষ,
নবারুণ ভট্টাচার্যের মতোন শ্রদ্ধেয় ব্যক্তিরা, যারা এক-একজন আগেকার দিনের ‘স্টলওয়ার্ট’,
তারা মুক্তকণ্ঠে প্রশংসা করে গিয়েছেন। এতএব ‘মহাজনো যেন গতো স্ব পন্থা’ করে আমি বলি,
চোখ বন্ধ করে বলা যায় এ বই ভাল না হয়েই যায় না। কার পিতাঠাকুরের ক্ষমতা আছে একে মন্দ
বলে বলে দেখাক দিকি। আজ থেকে আমিও এই ভক্তকূলের দলে।
তবু চোখ পড়ে যায়
প্রথম সংস্করণের ভূমিকাতে। দেখি, সেখানে লেখা আছে, “জানি, প্রত্যেকটা সময়ই তার আগের
সময়ের থেকে আলাদা। আর প্রত্যেকটা সময়েরই কিছুটা ভালো দিক থাকে, কিছুটা মন্দ দিক থাকে
--- তার আগের সময়ের তুলনায়। তাই আগেরটা ভালো আর এখনকারটা খারাপ --- চট করে এহেন মন্তব্য
করা উচিত নয়। কিন্তু তবু, এক্ষেত্রে বলতে বাধ্য হচ্ছি --- ‘এই’ কলকাতার চেয়ে ‘সেই’
কলকাতাই অনেক শ্রেয়। অন্তত আমার কাছে।” এই ব্যক্তিগতকরণের মধ্যে দিয়ে বাকি দেড়শো পাতা
এগিয়েছে। এবং পরিশিষ্টে লিখছেন, “জানি, এসব সেন্টিমেন্টের কোনো দাম নেই তোমাদের কাছে।
এ-ও জানি, তোমাদের উন্নয়নের এক ধাক্কায় হুড়মুড় করে ভেঙে পড়বে ২৪ নম্বরের ওই বারান্দা,
ঘুলঘুলি, খড়খড়ি, নোনা-লাগা নীল দেওয়াল- সব কিছু। একে-একে ভেঙে পড়বে গোটা পাড়াটাই। হারিয়ে
যাবে শ্যামানন্দ রোডের আদিবাসীরা। তার পর, ওখানে আবার নতুন করে বাড়ি উঠবে, হয়তো-বা
তৈরি হবে নতুন এক 'কমিউনিটি'। আর এসবই হবে আরও 'আধুনিক', আরও বাতানুকূল। 'সূর্য-গ্রহ-চাঁদ'
তখন অনেক দূরে সরে যাবে। আলাদা হয়ে যাবে মানুষের থেকে।”
ঠিক এইভাবেই, কখন যেন মধ্যেকার লেখাগুলো
একটু একটু করে সরে এসে তুলনা হয়েছে প্রত্যেকটা সময়েরই কিছুটা মন্দের দিক থেকে – কারণ
যে সেন্টিমেন্ট আমার চোখে জল এনেছে (সত্যিই আমি কেঁদেছিলাম এই অংশটুকু পড়ে), সেই সেন্টিমেন্টই
আমাকে ভুলিয়ে দিয়েছে, এই ২৪ শ্যামানন্দ রোডের বাড়িটা হয়তো একদিন বেশ কয়েকটা মাটির কুটিরকে
ভেঙে মাটিতে মিশিয়ে মাথা তুলে দাঁড়িয়েছিল। আমরা ভুলে গেছি, কারন, সেই মাটির কুটির থেকে
কোন সবুজ মুখোপাধ্যায় বের হয়ে আসেন নি। আসলেও তালপাতার সেই পুঁথিটি কীটদ্রষ্ট হয়ে হারিয়ে
গেছে কালের কোন গর্ভে।
এই স্মৃতিচারণ
এক মধবিত্ত পরিবারের একটি ছেলের স্মৃতিচারণ, সময়টা আশির দশকের কলকাতা। ২৪ শ্যামানন্দ
রোড, বৃষ্টি (এই অংশটার vision আমাকে সত্যিই চমকে দিয়েছে), ঘুলঘুলি, সেজকাকা এমনকি
পাঁচু পর্যন্ত যে ম্যাজিক তৈরী করলেন, সেই ম্যাজিক আস্তে আস্তে হারিয়ে গেল, পড়ে রইল
এমন এক স্মৃতিচারণ যার ছোঁয়া Gen Z পেতে পেতেও পেল না। Generation X এবং Millennials-দের
মধ্যেই যেন কোথাও সীমাবদ্ধ রইল। কারণ, তাদের কাছে ম্যাজিকের থেকেও এক বাস্তব যাপন অনেক
বেশি সত্যি। সেই সত্যিটার ছোঁয়া আমি অন্তত পেলাম না। স্মরণজিৎ চক্রবর্তীর ‘ঝাল লজেন’
বইটার মতোই, এই বইটা এমন একটা ইতিহাস হয়ে রইল, যে ইতিহাস কালের এক টুকরো ছবিকে ধরে
রাখে মাত্র, মুষ্টিমেয়র জন্য।
ছবির ক্ষেত্রে বলি, কিছু কিছু ছবি
লেখার সাথে বিদ্যুৎ চমকের মতো ব্যোমকে দিয়ে যায়। ‘সেজকাকা’ পর্বের শেষ লাইনের টেলিগ্রামের
পড়ে একটা দাগ রক্তের দাগের মতো বুকের মধ্যে ছ্যাৎ করে যায়, কিম্বা, শুরুতেই তারের ওপর
কাকের বসে থাকে একটা আধো আলো আধো অন্ধকারের স্মৃতিচারণের কথা বলে। লোডশেডিং অধ্যায়ের
অর্ধেক লণ্ঠন, কিম্বা বোরোলিনের সংসারের রেডিও, কিম্বা নব্বই পয়সার নিউ এম্পায়ারের
ফিল্মের ছবি --- টুকরো টুকরোভাবে ভালো লাগা তৈরী করে। আর তারপরেই, ছবির দুর্বোধ্যতার
মধ্যে আমি হারিয়ে যাই, ছবির ম্যাজিকও হারিয়ে যায় অনেক অনেক স্পেসের মধ্যে…
তবু ভালো লাগে
বইটা পড়তে, একটাই কারনে, আমি জানি, আমার বাবা এই ‘মধ্যবিত্ত’ জীবন যাপন করে এসেছেন।
সেই জীবন ‘যাপনের’ প্রতি তিনি শ্রদ্ধা রেখেছেন। সেই জীবনের প্রতি তিনি কোন মোহ রাখেন
নি। তাকে কোনদিন বলতে শুনি নি, ছোটবেলাটাকে আমি খুব মিস করি জানিস, কী সব দিন ছিল আমাদের
সময়ে; তাকে কোনদিন বলতে শুনি নি, তোদের জেনারেশানটা উচ্ছন্নে যাচ্ছে, আর আমাদের দ্যাখ,
কত কষ্ট করেও কত আনন্দ থেকেছি আমরা; বলতে শুনি নি, আমরা এই হারিয়েছি, ওই হারিয়েছি;
তাকে কোনদিন হাই থিংকিং, প্লেন লিভিং-এর গুণগান করতে শুনি নি।
বরং তাকে বলতে শুনেছি, যখন যেমন তখন
তেমন। যেখানে যেমন সেখানে তেমন। তাকে পরিবর্তনকে অ্যাকসেপ্ট করতে দেখে চলেছি, এবং সেই
পরিবর্তনের মধ্যেই আনন্দে থাকতে দেখেছি।
বাবাকে এই বইটা
পড়ার পর জিজ্ঞাসা করেছিলাম, তোমার কি মনে হয় না ছোটবেলায় তোমাদের সময়টা খুব ভাল ছিল?
আর এখন উন্নয়নের নামে আমরা যে উচ্ছন্নে…, তৎক্ষণাৎ বাধা দিয়ে তিনি বলেছিলেন, উন্নয়ন
মানে কি? যদি উচ্ছন্নে যাচ্ছিস, তাহলে উন্নয়ন বলছিস কেন? এটা তো হিপোক্রেসী। আগে ঠিক
কর, উন্নয়ন হচ্ছে, না উচ্ছন্নে যাচ্ছিস। যেটাই হোক না কেন, তা আদিকাল থেকেই হয়ে আসছে।
আমাদের ছোটবেলাটাও তাহলে এর আগের জেনারেশানের থেকে উচ্ছন্নের / উন্নয়নের ফসল। যেটাই
সত্যি হোক না কেন, বিচার করার অধিকার আমি ঠিক সেই মুহূর্তেই হারিয়েছি, যখন আমি বলছি
এটা উন্নয়ন।
পরে দেখলাম, উন্নয়ন বলতে বোঝায় কোনো
ব্যক্তি, বস্তু, বা সমাজের অগ্রগতি বা উন্নতি। এটি একটি প্রক্রিয়া যা ধীরে ধীরে পরিবর্তন
ঘটিয়ে নতুন এবং উন্নত পর্যায়ে পৌঁছায়। উন্নয়ন বিভিন্ন ক্ষেত্রে হতে পারে, যেমন:
সামাজিক, অর্থনৈতিক, প্রযুক্তিগত, বা পরিবেশগত।
এত কথা বলার কারণ, লেখক মহাশয় যাই
বলুন না কেন, তার বইতেই স্পষ্ট, তিনি বিশ্বাস করেন, ব্যক্তিগতভাবেই বিশ্বাস করেন, এক্ষেত্রে
বলতে বাধ্য হচ্ছি --- ‘এই’ কলকাতার চেয়ে ‘সেই’ কলকাতাই অনেক শ্রেয়। এবং যারা এই বইটার
মধ্যেকার নস্টালজিয়াকে বিশ্বাস করেন, তারাও কোথাও এই চিন্তার পন্থী। তাদের প্রতি আমার
কোন ব্যক্তিগত ক্ষোভ নেই।
রইল বাকি নান্দনিকতা।
খোয়াবনামার কর্ণধার আমাকে বইয়ের ফন্ট ইত্যাদির সায়েন্টিফিক ব্যাখ্যা দিয়েছেন। আমি মাথা
পেতে মেনে নিলাম। নিয়মের ক্ষেত্রে আমার অস্বীকার করার কোন যো নেই, তার বিরুদ্ধে বলার
যো আছে। আমি তা বলব না। কেবল বলব, নান্দনিকতা অতি অদ্ভুত ব্যাপার। এটা অনেকটা বিজ্ঞাপনের
মতো। লোকমুখে ‘ভালো’ বলতে বলতে এমন হয়ে যায় যে, সে ভালো কি মন্দ --- ঠাহর করার উপায়
থাকে না। ফলে নান্দনিকতা ব্যক্তিগত থেকে সমষ্টিগত হয়ে গেলে আবেগের গাড়িতে চলতে চলতে
কত আরোহীকে চাপা দিয়ে দেয়, তার কোন হিসাব থাকে না।
আমি চাপা পড়ে যাওয়া
এক আরোহিনী মাত্র…
===========
২৪ শ্যামানন্দ রোড
বিশ্বায়ন-পূর্ববর্তী কলকাতার এক মধ্যবিত্ত পরিবার
সবুজ মুখোপাধ্যায়
খোয়াবনামা প্রান্তজনের কথা
মুদ্রিত মূল্যঃ ২০০/-
Comments
Post a Comment