অবিনির্মাণ
এক সপ্তাহ ধরে পড়ছি, ছোট্ট একটা প্রবন্ধ। মাথার চুল ছিঁড়ে ন্যাড়া
হয়ে যাওয়ার মতো অবস্থা, থুড়ি নেড়ী --- হইনি। অবশেষে বুঝতে পেরেছি, এমন কথাও জোর দিয়ে
বলতে পারছি না, কিন্তু ছুঁচোর মতো কানা দৃষ্টিশক্তি নিয়ে যতটুকু ঠাহর করতে পারলাম,
তা নিয়ে কথা বলা যেতেই পারে। এখানে অনেক বিজ্ঞজন আছেন, তারা আরও সহায়তা করলে আমি উপকৃত
হব।
অবিনির্মাণ কি? Deconstruction = In
philosophy, deconstruction is a loosely-defined set of approaches to
understanding the relationship between text and meaning. The concept of deconstruction
was introduced by the philosopher Jacques Derrida, who described it as a turn
away from Platonism's ideas of "true" forms and essences which are
valued above appearances. অর্থাৎ, যে কোনো লেখ্য বা সাংস্কৃতিক পাঠের অন্তর্নিহিত
দ্বৈততা, অসঙ্গতি ও শক্তি-সম্পর্ক উন্মোচন করাই হল অবিনির্মাণের কাজ।
এর একটা উদাহরন হয়ে যাক? ধরুন, শক্তি
চট্টোপাধ্যায়ের ‘অবনী বাড়ি আছো’ কবিতাটা। “অবনী, বাড়ি আছো?”—এই প্রশ্নটি একাধিকবার
ফিরে আসে কবিতায়। যেন কোনো আত্মীয়, বন্ধু, কিংবা পরিচিত কেউ সন্ধান করছে এমন একজনের,
যার অনুপস্থিতি তার কাছে বেদনাদায়ক। এটিকে দেখা যেতে পারে অনেকভাবে, যেমন - প্রেমিকের
অনুপস্থিতি, বন্ধুর মৃত্যু, কিংবা জীবনের শূন্যতার প্রতীক। অনেকভাবে দেখছি বটে, কিন্তু
এটা হল অর্থের বহুবিধতা।
অর্থের বহুবিধতা মানে, একটি টেক্সট
বা বক্তব্যের অনেকগুলো সম্ভাব্য এবং একসাথে অস্তিত্বশীল অর্থ থাকতে পারে। এতে কোন নির্দিষ্ট
বা একক অর্থ নয়, বরং একাধিক সম্ভাব্য ব্যাখ্যা থাকে, যা পাঠকের অভিজ্ঞতা, সামাজিক প্রেক্ষাপট,
বা ব্যক্তিগত দৃষ্টিভঙ্গি অনুসারে পরিবর্তিত হতে পারে।
তাহলে ডিকনস্ট্রাকশন কি হবে? অবনী
কে? অবনী এক ব্যক্তি হতে পারেন, আবার প্রতীকও হতে পারেন — মাটি (অবনী = পৃথিবী), পূর্বপরিচিত
মানবিক সম্পর্ক, বা এমনকি ঈশ্বরের অনুপস্থিতি। তাহলে, "বাড়ি আছো?" মানে কী?
শারীরিকভাবে? মানসিকভাবে? নাকি অস্তিত্বগতভাবে? Deconstructive প্রশ্ন: যদি অবনী না-ই
আছেন, তাহলে তাঁকে উদ্দেশ করে বারবার প্রশ্ন কেন? যদি তিনি থাকেন, তবে ঘরের দরজা বন্ধ
কেন? এই দ্বন্দ্ব থেকেই অর্থ গড়তে গড়তে ভেঙে পড়ে। “অবনী, বাড়ি আছো?”—প্রশ্নটি একধরনের
আকুতি, কিন্তু তার পেছনে কাজ করছে অভাব, বিস্মরণ, প্রত্যাশা ও অস্তিত্বহীনতার অনুভব।
এই কবিতায় ভেতরের ও বাইরের জগৎ, প্রকৃতি ও মানসিকতা, ভাষা ও মৌনতা — সব কিছুর মধ্যে সম্পর্কের ভাঙন রয়েছে।
এবং সেই ভাঙনই Deconstruction-এর ভিত্তি। এর আরও ভেতরে যাওয়া যেতে পারে, আমি যাচ্ছি
না। আমার সে ক্ষমতা বা মেধা নেই।
অবিনির্মাণ (Deconstruction) মূলত
শব্দ, বাক্য বা টেক্সটের মধ্যেকার দ্বন্দ্ব এবং অসম্পূর্ণতা খুঁজে বের করে। এর মূল
লক্ষ্য এটা দেখানো যে একটি টেক্সট বা ভাষার মধ্যে কোন নির্দিষ্ট, স্থির, বা একক অর্থ
নেই—বরং সেখানে
দ্বন্দ্ব, বিরোধিতা, এবং অপর্যাপ্ততা কাজ করছে।
এটা কিভাবে কাজ করে?
১। শব্দের দ্বন্দ্ব (শব্দের ভেতরই
বহুমাত্রিক অর্থ থাকতে পারে।)
২। গঠনমূলক দ্বন্দ্ব (কোনো একটি টেক্সটের
মধ্যে যে গঠন বা কাঠামো তৈরি হয়েছে, সেটিও কখনো সম্পূর্ণ বা একরৈখিক নয়। অর্থাৎ, তার
ভেতরেই বিভিন্ন উপাদান একে অপরকে সমর্থন বা বাধাগ্রস্ত করতে পারে।) এবং
৩। বিরোধী অর্থ
Deconstruction যেভাবে কাজ করে, তা
হলো - একটি টেক্সটের মধ্যে কোনো একটি শব্দ বা বাক্যের অর্থ ঠিক করে দেওয়া সম্ভব নয়।
পাঠক যতই পড়বে, ততই শব্দের মধ্যে নতুন অর্থের সৃষ্টি হবে, এবং সেই অর্থগুলির মধ্যে
বিরোধিতা এবং দ্বন্দ্ব বজায় থাকবে।
জ্যাক দেরিদা তো এর উদ্গাতা। গায়ত্রী
সেই তত্ত্ব নিয়ে কি করলেন? গায়ত্রী চক্রবর্তী স্পিভাক অবিনির্মাণকে
(deconstruction) শুধুমাত্র ভাষাতাত্ত্বিক বিশ্লেষণ হিসেবে দেখলেন না — তিনি একে রাজনৈতিক, নৈতিক ও বৈপ্লবিক
পদ্ধতি হিসেবে দেখলেন, দেখালেন। Derrida যেখানে অবিনির্মাণকে মূলত ভাষার অভ্যন্তরস্থ
দ্ব্যর্থতা (ambiguity) আর ক্ষমতার গোপন খেলা ভাঙার পদ্ধতি হিসেবে ব্যাখ্যা করেছেন,
সেখানে স্পিভাক এটিকে ব্যবহার করেছেন উপনিবেশিত, নিঃস্ব, প্রান্তিক মানুষের পক্ষে দাঁড়ানোর
একটি কৌশল হিসেবে।
যেমন ধরা যাক ‘সেক্যুলার’ শব্দটা।
‘সেক্যুলার’ বলতে সাধারণভাবে বোঝানো হয়: ধর্মনিরপেক্ষ, রাষ্ট্র ও ধর্মের বিভাজন, প্রত্যেক
নাগরিকের ধর্মবিশ্বাসের স্বাধীনতাকে সমর্থন করা, এখানে মনে হয় শব্দটি নিরপেক্ষ এবং
ন্যায্য একটি ধারণাকে প্রকাশ করছে।
অবিনির্মাণমূলক প্রশ্ন ও বিশ্লেষণ:
(১) সেকুলার আসলে কার জন্য নিরপেক্ষ?
‘সেক্যুলার’ ধারণা মূলত ইউরোপীয় ইতিহাস থেকে এসেছে (যেখানে চার্চ ও রাষ্ট্র আলাদা হয়েছিল)।
কিন্তু দক্ষিণ এশিয়া বা উপনিবেশিক দেশগুলোতে কি একইভাবে কাজ করে?
দ্বন্দ্ব: যেখানে ধর্ম ও সংস্কৃতি
একে অপরের মধ্যে গভীরভাবে গাঁথা, সেখানে ‘সেক্যুলার’ হতে গেলে ঠিক কোনটাকে বাদ দেওয়া
হচ্ছে?
(২) ‘সেক্যুলার’ শব্দটি কি ধর্মবিরোধী?
কেউ কেউ মনে করেন সেকুলার মানে ‘ধর্মবিরোধী’ অন্যদিকে, কেউ বলেন এটা ‘সকল ধর্মের প্রতি
সমান শ্রদ্ধাশীল’। এই দ্ব্যর্থতা নিজেই শব্দটিকে অস্থিতিশীল করে তোলে।
(৩) ‘সেক্যুলার’ কি সত্যিই নিরপেক্ষ
হতে পারে? অনেক সময় রাষ্ট্র ‘সেক্যুলার’ পরিচয় রাখলেও এক বিশেষ ধর্ম বা সংস্কৃতির প্রতি
বেশি সহানুভূতিশীল হয়।
(৪) ভাষা ও ভাবনার দ্বন্দ্বের দিকে
তাকানো যাক --- ‘সেক্যুলার’ বললে একধরনের প্রগতিশীল, আধুনিক ভাবনার ইঙ্গিত আসে, যেন
ধর্মবাদ পুরনো আর সেকুলারই উন্নত — এই ভাবনার মধ্যেও শক্তির আধিপত্য
লুকিয়ে আছে, যা অন্যকে ‘অপ্রগতিশীল’ বলে চিহ্নিত করে।
এই হল অবিনির্মাণ। গায়ত্রী এর সার্থক
প্রয়োগ ঘটিয়েছেন তার “Can the Subaltern Speak?” গ্রন্থে।
“প্রাতিষ্ঠানিকভাবে অবিনির্মাণ শিখতে
হলে দর্শন পড়তে হবে; সেটা অন্য জিনিস। আন্দোলন থেকে দৈনিক এক ঘণ্টা অবসর নিয়ে মহিলারা
একটু চিন্তা করুন। দেখবেন নারীবাদের শত্রু পুরুষাঙ্গের আইন, অবিনির্মাণ নয়। সাম্যবাদের
শত্রু পুঁজিবাদ, অবিনির্মাণ নয়। আর নয়া-ঔপনিবেশিকতা, অধুনা গোলকায়নের বিরুদ্ধে হাতে
থাকুক সংবিধান, চিত্তে থাকুক সমষ্টিবাচক প্রতিজ্ঞা, কিন্তু মাথায় থাকুক নামহীন অবিনির্মাণের
নাছোড়বান্দা আগ্রহ, তবেই হাতড়ানো হাতিয়ার হবে, বার বার।”
গায়ত্রী বারংবার সাবধান করছেন আমাদের।
==============
অপরঃ লেখা ও কথার সংকলন
গায়ত্রী চক্রবর্তী স্পিভাক
অনুষ্টুপ পাবলিকেশান
মুদ্রিত মূল্যঃ ৬০০ টাকা
Comments
Post a Comment