‘ঈশ্বর’-এর পাশা

 


বাঙালী পাঠক আর যাই হোক, বিজ্ঞানমনষ্ক হয় নি, প্রযুক্তিমনষ্ক হয়েছে; ফলে পরিশিলীত বোধযুক্ত মন নয়, ধূর্ততা আর ছলনাময় মন নিয়ে নিজের পৃথিবী দাপানোর কথা ভাবে। আর ভাবে, খুব কম নাম্বার পেলেও, যেভাবেই হোক, সায়েন্স নিয়ে পড়তে পারলেই কেল্লা ফতে। চাকরী মিলবে, সমাজে মাথা উঁচু করে চলার (এটা বাবা-মায়ের দিক থেকে বলছি) টিকিট মিলবে।

      একথা আরও বেশি করে মনে হয়, কারন, বিজ্ঞান নিয়ে পড়লেও তন্ত্র, লুতুপুতু প্রেম আর গোয়েন্দা উপন্যাসের সস্তা কাহিনীর দিকে তার রুচি। বইমেলাতে দেদার বিকোয়। সারা বছর ধরে দেদার লোকে পড়ে। যদি একটু রিসার্চ করে দেখা য্য, তাহলে, দেখা যাবে, বিজ্ঞান নিয়ে পড়ে চাকরী করা লোকের অভাব নেই।

      কিন্তু বাংলা বইবাজারে পপুলার সায়েন্সের ওপর বই, ভারতে ক্রিকেট টিমে বাঙালী প্লেয়ার থাকার মতোই ক্ষীণ।

      এর মধ্যে আমার হাতে এল এই বইটা। ‘ঈশ্বর’-এর পাশা। গৌতম গঙ্গোপাধ্যায় আর দেবজ্যোতি ভট্টাচার্যের পরিশ্রমের ফসল, প্রশংসার দাবী রাখে। তবে যারা ক্লাস টুয়েলভ পর্যন্ত সায়েন্স একটু মন দিয়ে পড়েছে, তারা মোটামুটি ১৫২ পাতা পর্যন্ত খুব একটা নতুন কিছু পাবেন না। মূল বই ২২৬ পাতার।

      কেন পাবেন না? পড়লেই বুঝতে পারবেন। আমরা মোটামুটিভাবে গ্যালিলিও থেকে নিউটন --- ঘটমান ঘটনাগুলো ক্লাসের ধাপে ধাপে পাঠ করেছি। এখানে ব্যাপারটা একবার জাস্ট রিডিং দেওয়ার মতো। আইনস্টাইন ও তার পরবর্তী বিশ্ব সম্পর্কে লেখাটাই বরং কঠিন ছিল। সেটা পড়ার পাঠক কজন আছেন? জানি না। রিলেটিভিটি কিম্বা E=mc2 সবাই জানে, কোয়ান্টম থার্মোডায়নামিক্স কয়জন বোঝেন? রিচার্ড ফিনম্যানের কাজ কয়জন মনে রেখেছেন। হ্যাঁ, ‘ইউটিউব’, ‘ডিসকভারি’ বা ‘ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক’ চ্যানেলের দৌলতে অথবা হালফিলের ‘ওপেনহাইমার’ সিনেমার কারনে তার নামটা হয়তো কেউ কেউ জানেন।

      এত নৈরাশ্যজনক কথা কেন? কারন, এই বইটা আমাকে হতাশ করছে। বইটার মধ্যে পরিশ্রম আছে। এই ধরনের বই বইজগতে যত আসবে বাংলা বিজ্ঞানচেতনার দিকটা তত সুদৃঢ় হবে। কিন্তু এই বই কয়জন পড়বে? কয়জন এই বই না বুঝেও পড়বে? যেমন করে পরকীয়া নিয়ে পড়ে, তাদের নিজেদের ক্ষমতা না থাকা সত্ত্বেও পড়ে? হতাশা জাগছে এই কারনেই, এই বইটা, কিছুদিনের মধ্যে আউট অফ প্রিন্ট হয়ে হারিয়ে না যায়। কারন, এই বইটা, যে কোনও বিজ্ঞান বিষয়ে কৌতুহলী পাঠকের জন্য অসাধারন পকেটবুক।

      ‘ঈশ্বর’-এর পাশা-য় ছয়টি পর্যায়। অ্যারিস্টটল থেকে মোটামুটিভাবে শুরু, শ্রয়ডিঙ্গারে এসে মোটামুটিভাবে শেষ। মাঝে নিউটনের জন্যেই বরাদ্দ দুটো পর্ব! এইখানেই বোঝা যায়, সমগ্র পদার্থবিদ্যার জগতে আইজ্যাক নিউটন কি বিস্ময়কর ব্যাক্তিত্ব। আমরা বোঝার ক্ষমতা রাখি না। আমাদের ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য জগতের সম্পূর্ণ বিশ্বের পদার্থের তত্ত্বতালাশ নিউটনের হাতে গড়া। আর সে কম কথা নয়। সে এক বিস্ময়কর ঘটনা। নিউটনের জীবন ও তার কাজ নিয়ে বাংলায় পূর্ণাঙ্গ কোন কাজ হয়েছে কি? এই বইটা পড়তে পড়তে আমাকে ব্যাপারটা কৌতুহলী করে তুলেছে। ইংরাজীতে অনেক বই পাব জানি। বাংলায় কোন বই নেই, বিশ্বাস করি। বাঙালীর অধঃপতনের এর থেকে ভালো উদাহরন আর কি হতে পারে?

      আমার আরেকটা ব্যাপার খুব ভাল লেগেছে। তা হল পাঠকদের সাথে কানেক্ট করার পদ্ধতি। খুব সুন্দর ছিমছাম ভাষায়, সহজ সরল ভাষায় লেখার চেষ্টা করা এবং এক্ষেত্রে তারা সাকসেসফুল। পড়তে বেশ ভাল লাগে। এক ধাক্কায় অনেকটা যে কখন পড়ে ফেলি, টের পাওয়া যায় না।

      এমন পপুলার সায়েন্সের ওপর বই আসুক, সাধারন মানুষ পড়ুক। টেকনোলজির ঈশ্বর হল বিজ্ঞান। আমরা GOD ছেড়ে GODMAN ধরে পড়ে আছি। ASTRONOMY ছেড়ে ASTROLOGY নিয়ে পড়ে আছি। আর পড়ে আছি বলেই আমাদের দুর্দশা কিছুতেই কাটতে চাইছে না।

================

‘ঈশ্বর’-এর পাশা

গৌতম গঙ্গোপাধ্যায়, দেবজ্যোরি ভট্টাচার্য

জয়ঢাক প্রকাশন

মুদ্রিত মূল্যঃ ৩০০/-

Comments

Popular posts from this blog

যে বুকে আগুন জ্বলে

শারদীয়া আনন্দবাজার পত্রিকা সম্পর্কে

জেরক্স কপির উন্নত ভার্সানে ‘আবার প্রলয়’ এসেছে