যখন যুদ্ধ চলছে



যখন যুদ্ধ চলছে, সেই সকালে, শান্তিনিকেতনের উদয়নের ছাদে, চারটে মাইকে বেজে চলেছে রবীন্দ্রকণ্ঠ। জীবনে প্রথম, আমি, শনছিলাম সেই কণ্ঠ, সেই তীক্ষ্ণ ক্ষয়াটে কিন্তু কী আত্মবিশ্বা  সী কণ্ঠ। সেই কণ্ঠ উচ্চারণ করছিল,

“তোমারে পেয়েছিনু যে, কখন্‌ হারানু অবহেলে,

কখন্‌ ঘুমাইনু হে, আঁধার হেরি আঁখি মেলে।

          বিরহ জানাইব কায়, সান্ত্বনা কে দিবে হায়,”

      আমার মনে হচ্ছিল, কে দেবে আলো? কে দেবে প্রাণ? যে পরম করুণাময় ঈশ্বরের নামে অকারণে নিরীহকে হত্যা করা যায়, তার দায় কার? পরম করুণাময়ের? না কি সেই করুণাময়ের নামে যে অকারণ হত্যালীলা চালিয়ে কাপুরুষের পরিচয় দিয়ে আবার পালিয়ে মুখ লুকায়???

      আমার মনে পড়ল সেই অমোঘ লাইনগুলো---

“তোমার ন্যায়ের দন্ড প্রত্যেকের করে

অর্পণ করেছ নিজে। প্রত্যেকের 'পরে

দিয়েছ শাসনভার হে রাজাধিরাজ।”

      আমরা আজ অন্যায়ের দন্ড দিয়েছি। যে প্রতিবেশী দেশ নিজঘরে জামাই আদরে সন্ত্রাসবাদীদের পালন করে তাদের প্রভুর দুর্নামে পাশবিক আনন্দ পাচ্ছে, সেই তাদের ঘরেই ঢুকে আঘাত আমার দেশ করেছে। এই শাসনের একান্তই প্রয়োজন ছিল। সারা দেশ চাইছে বলে নয়, ন্যায়ের প্রতিষ্ঠার জন্য। সহনশীলতা ভাল, কিন্তু অতিরিক্ত সহনশীলতা দুর্বলতার লক্ষ্মণ, আমরা প্রমান করেছি, আমরা দুর্বল নই।

      অনেকে এই অপারেশানের নাম নিয়ে বালখিল্যপনা করছে। দুর্ভাগ্য, তারা ভারতীয়। আরও দুর্ভাগ্য, তারা ভারতের সংস্কৃতিকে নীচু নজরে দেখতে দেখতে বুঝতেই পারছে না, একটা শব্দ সমগ্র ভারতবাসীর জন্যে কতটা আদরের হতে পারে। সেই শব্দ ধর্মনিরপেক্ষতার শব্দ, সে এক ইতিহাস সৃষ্টির শব্দ, নির্দিষ্ট ধর্মের থেকে উদ্ভুত শব্দ সমগ্র ভারতবাসীর নিজের প্রতিশোধের শব্দ হয়ে গেছে। একেই তো ধর্মনিরপেক্ষতা বলে! এ কি তামাশার? না কি এ নিয়ে হঠাৎ করে জিগীর তুলতে যাওয়াটা বুদ্ধিদীপ্ত কাজ? ছোট খোকা আধো আধো কথা বলে, যখন বড়োরা অহেতুকী ‘খোকা’ সাজতে চায় তখন তাদের জন্য যে অসন্মান বরাদ্দ থাকে, তা সুদে-আসলে মেলে। আমি দেখছি, তাদের তা মিলছে বলে, হঠাৎ করে মাথা বলছে, এ আবার কি অন্যায়? ভাষা দিয়ে আক্রমণ করার কি হল? আমরা ভুল কি বললাম?

      কিছুই হল না, কেবল ভাষা দিয়ে আপনাদের একটু শাসন করা হল। শুধু কি বাইরের শত্রুদেরই আমরা শাসন করব? ঘরের মুর্খদের জন্যে কি বকাঝকা চলবে না?

      এমনি মুর্খদের কথা তাও হেসে উড়িয়ে দেওয়া যায়, কিন্তু পন্ডিত-মুর্খদের? তাদেরও সমুচিত জবাব দিতে হয়। যারা এর মধ্যে রাজনীতি দেখছেন, তারা ঠিকই দেখছেন, তবে নিজেদের মুর্খামির রাজনীতির মিশেলে ভুল রাজনৈতিক আখ্যান তৈরী করার চেষ্টা করছেন, এটাই তারা বুঝতে পারছেন না। ফলে সাধারণ মানুষই এর যোগ্য জবাব দিচ্ছেন। আর বড়োখোকারা অভিভূত হয়ে পড়ছেন।

      যুদ্ধ কখনও কখনও অবশ্যম্ভাবী হয়ে পড়ে। মহাভারত সেটি শিখিয়েছে। কত যুগ আগের এক কাব্য, আজও তার থেকে আমি শিক্ষা নিই। সাপ ছোবল দেবে না, ফোঁস করবে, প্রয়োজনে ছোবল দেবে বৈ কি। ভারত কোনদিন কারোকে শোষণ করে নি, কারোর ওপর অযথা শাসন করে নি, ইতিহাস সাক্ষী। কিন্তু উচিৎ জবাব সে চিরকালই দিয়েছে। শক্তিশালী মানুষ তাই করে। কারণ সে জানে, অযথা শক্তিক্ষয় আশেপাশের সবকিছুকে নাশ করে। বাহ্যত কোনদিন ধ্বংসের পক্ষপাতী সে ছিল না, কেবল যে ধ্বংসযজ্ঞে অন্য কেউ আহুতি দিচ্ছে সেই ধ্বংসযজ্ঞের বেদীটাকে বিনাশ করার পক্ষপাতী ছিল। যেখানে বুঝিয়ে কাজ হবে না, প্রয়োজনে, সেখানে পদাঘাতে সেই বেদী নষ্ট করে সামঞ্জস্য বিধানের জন্য চিরকাল ভারত লড়ে এসেছে।

      আমি গর্ববোধ করি, আমি এই ভারতবর্ষে জন্মগ্রহণ করেছি।


Comments

Popular posts from this blog

যে বুকে আগুন জ্বলে

শারদীয়া আনন্দবাজার পত্রিকা সম্পর্কে

জেরক্স কপির উন্নত ভার্সানে ‘আবার প্রলয়’ এসেছে