চিন্তার দুর্দশা


­“যাঁরা আমার কলকাতার গত দুটি বক্তৃতায় এসে আমাকে বাধিত করেছেন, তাঁদের বলে রাখি যে আজকের কথাগুলি সেই দুটি ভাষণের সঙ্গে জড়িত থাকবে। প্রথম ছিল 'গণতন্ত্রের রহস্য' (শুধু আমি ও আমার অধিকার নয়, সম্পূর্ণ অন্যরকম লোকেদের সঙ্গে সমতাবোধ), তার পরেরটা ছিল 'যুক্তি ও কল্পনাশক্তি' (কল্পনাশক্তি যুক্তিকে রক্ষা করে), এবং সেই দুটির সঙ্গে এক রেখায় আজকের বক্তব্য: যখন চিন্তাধারায় এই রহস্যগুলি স্থান পায় না, তখনই চিন্তা দুর্দশাগ্রস্ত হয়। এখানে বলা দরকার যে, কল্পনাশক্তি এই অর্থে একটি শক্তি। শুধু উড়িয়ে দেওয়ার মতো অসত্য নয়।”

      এই কল্পনাশক্তিরই কি প্রকৃত ধারক ও বাহক চিন্তা? গায়ত্রী বলছেন, “এই সাবলীল বলিষ্ঠ কল্পনাশক্তি নিজেকে ছেড়ে, অন্যের এবং অন্য গোষ্ঠীর অন্তর্গত হতে চেষ্টা করে অন্তরে অন্তরে। একক এবং বহুজনীন অন্তরে। এই পারদর্শী কল্পনাশক্তি যখন মৃতপ্রায়, আত্মমুখী, যুক্তিকে রক্ষা করতে অক্ষম, তখন গণতন্ত্রের সেই অন্তর্নিহিত রহস্য- আমি নই অধিকারের মালিক শুধু, অপরের অধিকারের জামিনও আমি, এ-চিন্তা হারিয়ে যায়। ভীরু দুর্বল চিন্তায় যখন এই রহস্য কল্পনা করা যায় না, তখন সব আমি, সব আমার - আমার স্বামী, আমার স্ত্রী, আমার ছেলে, আমার সংসার। অভাবে স্বভাব নষ্ট, সুতরাং, গরিব মানুষকে অপরের কথা চিন্তা করতে বলা উচিত নয়, এসব কথা আমাকে বলে লাভ নেই। আজ চল্লিশ বছর আমি এই সমস্যার নিত্য সম্মুখীন, হাতে-কলমে। এবং যাঁরা ভোট দেন তাঁরা যতই গরিব হোন না কেন, তাঁদের এই 'আমি বা আমার শুধু নই, অপর এবং অপরেরা'- এই চিন্তা করতে পারতে হবে। কেননা তাঁরাও গণতন্ত্রের রক্ষক। নইলে তাঁরা শুধু গণতন্ত্রের পাটিগণিত অর্থাৎ ভোট গোনার উপায়।”

      এবং এই পরিপ্রেক্ষিতেই যদি গায়ত্রীর কথাগুলোকে একটু গুছিয়ে নিতে চেষ্টা করি তাহলে কি ব্যাপারটা দাঁড়ায়?

চিন্তা (Thinking): চিন্তা হলো যুক্তিভিত্তিক বিশ্লেষণ। সমাজ, রাজনীতি, অর্থনীতি ইত্যাদি বিষয়ে পর্যবেক্ষণ ও বিশ্লেষণ করার ক্ষমতা। চিন্তার মাধ্যমে আমরা বিশ্বের কাঠামোগুলো বুঝিকীভাবে ক্ষমতা চলে, কীভাবে শোষণ হয়, কীভাবে পুঁজিবাদ আমাদের দৈনন্দিন জীবন নিয়ন্ত্রণ করে। শুধু চিন্তা করে যুক্তি বিশ্লেষণ করলেই চলবে না, কারণ তা দিয়ে বিশ্বে পরিবর্তন আনা যায় না। চিন্তা যখন একা থাকে, তখন সেটা শুধু জ্ঞান তৈরি করে, ন্যায় তৈরি করে না।

কল্পনা (Imagination): কল্পনা হলো অন্যের অবস্থানে নিজেকে ভাবতে পারার ক্ষমতা। যেখানে চিন্তা হলো যুক্তির কাজ, কল্পনা হলো সহানুভূতি ও নৈতিক অভ্যাসের কাজ। কল্পনা ছাড়া শুধু চিন্তা করলে মানুষ নিজেকে-নিজের মধ্যেই আটকে যায়, বিশ্বব্যাপী নিপীড়িতদের যন্ত্রণাকে অনুভব করতে পারে না। স্পিভাকের বক্তব্য: "Imagination is the training of the ethical impulse." অর্থাৎ, কল্পনা হলো নৈতিক তাগিদ তৈরির ব্যায়াম।

গায়ত্রী স্পিভাক বলেন, চিন্তা আমাদের বিশ্ব বুঝতে শেখায়; আর কল্পনা আমাদের বিশ্বকে বদলাতে প্রেরণা দেয়। তাঁর মতে, যদি কেবল চিন্তা করি কিন্তু কল্পনা না করি, তাহলে আমরা শোষণের কাঠামো চিনতে পারবো, কিন্তু সেটাকে ভাঙার নৈতিক শক্তি অর্জন করতে পারবো না। অন্যদিকে, যদি কেবল কল্পনা করি কিন্তু চিন্তা না করি, তাহলে আবেগে ভেসে যাবো, কার্যকর কাজ করতে পারবো না। এটাই চিন্তা আর কল্পনার মেলবন্ধন।

কি সুন্দরভাবে গায়ত্রী এক সাদামাটা কথায় এর উপসংহার টানছেন! ‘আমি আমি’ আর ‘তুমি তুমি’। প্রথমটায় প্রসারতা, দ্বিতীয়টায় সংকীর্ণতা। এটাই গায়ত্রীর ‘Unconditional Ethics’ – অহৈতুকী প্রেম। গায়ত্রী দুইজনকে উদাহরণ হিসাবে টানছেন --- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং সারদামণি চট্টোপাধ্যায়।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর – “অসাধারণ রবীন্দ্রনাথকে ধরে শঙ্খ ঘোষ দেখিয়েছেন 'আমি আমি' চিন্তা আর অপর-চিন্তাকে কী করে আলাদা করা যায়। 'আমার জন্য, কাছের জন্য, শরীরের জন্য চাওয়া- বাসনা। সবার জন্য, দূরের জন্য হৃদয়মনের জন্য চাওয়া- আকাঙ্ক্ষা।' কোনো ধারণাকে দু'ভাগে ভাগ করে বোঝা হচ্ছে তাত্ত্বিক ধরন।”

সারদামণী দেবী – “এবারে যাই সারদামণি চট্টোপাধ্যায়ের কথায়। তিনি প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা পাননি, নিরক্ষর ছিলেন। প্রচলিত নিয়মে তাঁকে সম্পূর্ণ মাতৃরূপায়িত করা হয়েছিল, এবং সেই প্রচলন অনুযায়ী তিনি নিজেও গভীর স্নেহের সঙ্গে 'আমি সকলের মা' ইত্যাদি বলেছেন। কিন্তু যখন গুরু হিসেবে, নেতা হিসেবে কথা বলেছেন তখন অহৈতুক অপরাশক্তির ঢেউয়ে ভেসে কথা বলেছেন, তথাকথ্যি 'মহিলাসুলভ' আবেগ ছাড়াই। এমনকী মাতৃভাবের ভিতর থেকে গণতান্ত্রিক অপরাভাবের ব্যবহার তিনি করেছেন- অর্থাৎ, আমার চেয়ে একেবারে অন্য ধরনের লোকের এবং গোষ্ঠীর সঙ্গে সমান অধিকার- যথা: 'আমি সতেরও মা, অসতেরও মা। ভয় পেয়ো না। দুঃখ হলে বলবে, আমারও মা আছে।' এই তো unconditional ethics- অহৈতুক প্রেম। মাতৃভাবকে সমালোচনা না করে- তিনি বুদ্ধিজীবী ছিলেন না কিন্তু প্রখর বুদ্ধি ছিল, সমালোচনা করতে জানতেন- একাকার করে দিলেন সন্তানসমাজকে, যেমন শঙ্খ দিলেন 'চাওয়া'-য়। আছ তোমরা- পাজি হও, বদমাশ হও, আবার ভালোও হতে পারো। সৎ বা অসৎ। সকলের দুঃখের সময়ে, যেমন খুশি দুঃখ, বলবে: 'মা আছে ভয় পেয়ো না।'- সামুহিক।”

গায়ত্রীর যুক্তিতে চিন্তাকে শক্তিশালী করা যায় কি ভাবে?

“Slow Reading” — মনোযোগ দিয়ে গভীরে পড়াশোনা করা

"Acknowledging one's ignorance" — নিজের অজ্ঞানতাকে মেনে নেওয়া

"Unlearning Privilege" — নিজের সুবিধাজনক অবস্থান ভেঙে দেওয়া

"Ethical Singularities" — নির্দিষ্ট ব্যক্তির প্রতি নৈতিক মনোযোগ

"Self-critique" — আত্মসমালোচনা

আমরা এরই অভাবে ভুগছি। ভয়ঙ্করভাবে ভুগছি। গায়ত্রী বলছেন, “ওই যে আমি বলি না, rearrangement of desire। মানুষের মন সহজে বদল করা যায় না। যে বাসনা আকাঙ্ক্ষা আছে, তাকে গুছিয়ে রাখা যায়। এটুকু বলতে পারি এতকাল পড়িয়ে। এই তো চিন্তাকে দুর্দশা থেকে মুক্তি দেয়ার উপায়। অবহেলিত নিম্নবর্গের সাধারণ মানুষ, অথবা বিলাসে নষ্ট উদ্ধত ভদ্রলোক-বড়োলোক সাধারণ মানুষের মনের গহনে ঢোকার চেষ্টা সফল হয় না দিনের পর দিন, এবং ডিজিটালের তাড়না ওপরের তলার সাধারণ মানুষের মনের দরজায় 'প্রবেশ নিষেধ' টাঙায়। কিন্তু তবু করা যাবে, এই ভুল ধারণা নিয়ে এগোতে হবে।”

----------------------

বিঃ দ্রঃ বইটি কিনবেন না। বা যারা গায়ত্রী স্পিভাকের ‘অপর’ সংকলনটি কিনেছেন কিম্বা কিনবেন মনে করছেন, এই বইটার সমস্তটুকুই ওই বইটার মধ্যে রয়েছে। আলাদা করে কিনতে ২৫০ টাকা (মুদ্রিত মূল্য) খরচ হবে, যার পুরোটাই আপনার অতিরিক্ত খরচ।

============

চিন্তার দুর্দশা

গায়ত্রী চক্রবর্তী স্পিভাক

অনুষ্টুপ পাবলিকেশান

মুদ্রিত মূল্যঃ ২৫০/-

ছবি কৃতজ্ঞতাঃ ইন্টারনেট 

Comments

Popular posts from this blog

যে বুকে আগুন জ্বলে

শারদীয়া আনন্দবাজার পত্রিকা সম্পর্কে

জেরক্স কপির উন্নত ভার্সানে ‘আবার প্রলয়’ এসেছে