যুক্তি ও কল্পনাশক্তি
“কল্পনাশক্তির
ব্যায়াম নিয়মমতো শেখানো হয় না বলে সাধারণ মানুষের মনে বামপন্থা এখন আত্মরক্ষা এবং স্বার্থাধিকারের
পথ বৈ আর কিছু না। সারা জগতের শোষণ থামানোর যে-অদম্য ইচ্ছে সম্বন্ধে মার্ক্সসাহেব লিখেছিলেন,
আজকের দুর্ধর্ষ পুঁজিবাদের সামনে সেই ইচ্ছের অঙ্কুর পোঁতা অসম্ভব।”
মোটামুটি এই হল গায়ত্রীর বিষয়, এই বইটার ক্ষেত্রে।
বই না বলে বক্তৃতা বলাই ভাল। এখন প্রশ্ন হল, মার্ক্সসাহেব আসলেই কোন ব্যাপারে নজর দিয়েছিলেন?
– কনটেন্টবিহীন ভ্যালু-ফর্ম।
মার্ক্সের বক্তব্য, মান বা value সমাজে প্রকাশ
পায় ‘মূল্যরূপ’ হিসেবে। এটি একটি রূপান্তরের প্রক্রিয়া, যেখানে শ্রমশক্তি যে কোনো পণ্যের
মধ্যে ‘মূল্য’ হিসেবে প্রতিফলিত হয়। যখন একটি পণ্যের মূল্য শুধু তার অভ্যন্তরীণ গুণাবলীর
উপর নির্ভর না করে, বরং বাজারে তার বিনিময়যোগ্যতা বা মূল্যের দৃষ্টিভঙ্গি দ্বারা নির্ধারিত
হয়—তখন তা হয়ে
পড়ে ‘contentless’ বা নিরবস্তু। অর্থাৎ, পণ্যের ব্যবহারমূল্য, প্রয়োজনীয়তা, মানবিক
উপযোগিতা — এই সব হারিয়ে
গিয়ে শুধু তার টাকা হয়ে ওঠাই মুখ্য হয়ে যায়। তখন তার মূল্যরূপ বাস্তবিকী কোনো শ্রম,
প্রয়োজন বা বস্তুগত সত্যের ওপর দাঁড়িয়ে থাকে না, বরং একটি প্রতীকি বা বিমূর্ত
(abstract) রূপ নেয়।
এ তো গেল যুক্তি। কিন্তু কল্পনাশক্তির কাজ কোথায়?
গায়ত্রী বলছেন, “আমি কবি নই। তবে কবিতা কিছুটা পড়তে পারি, পড়াতে পারি, অস্ত্র হিসাবে
ব্যবহার করতে পারি। এখানেই কল্পনাশক্তির একটা ভাব ধরা পড়ছে।” তার মত, যতটা আমি বুঝেছি,
স্পিভাক মার্কসীয় তত্ত্বকে ব্যবহার করে বলেন, ঠিক যেমনভাবে শ্রমিকের শ্রম অদৃশ্য হয়ে
যায় মূল্যরূপে, তেমনি ঔপনিবেশিক বা গ্লোবাল পুঁজিবাদের কাঠামোতে subaltern মানুষের
ভাষা, দৃষ্টিভঙ্গি, অস্তিত্বও বিলুপ্ত হয়ে যায়।
খুব সাংঘাতিক যুক্তি! আর এই অদৃশ্য হওয়ার হাত
থেকে বাঁচাতে হলে এমন এক vision প্রয়োজন, যার সাহায্যে এই অবদমিত সম্প্রদায়েরা আবার
mainstream-এ ফিরে আসবেন। গায়ত্রীর চোখে ‘পুঁজিবাদ’ আজ আর কেবল অর্থনৈতিক কাঠামো নয়,
এটা একটি প্রতীকি কাঠামো (semiotic structure), যা মানুষের জীবন ব্যবস্থাকেও পণ্যায়িত
করে। গ্লোবালাইজেশনের জগতে আমরা সব কিছুই বিনিময়ের দৃষ্টিতে দেখছি — সংস্কৃতি, শিক্ষা, ভাষা এমনকি মানবাধিকারও।
তখন মূল্য আর কোনো বস্তু বা অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে তৈরি হয় না, বরং এক empty
signifier হয়ে দাঁড়ায় — শুধু প্রতীকের
খেলা। গায়ত্রী বলছেন, “অন্যকে জানার জন্য যে কল্পনাশক্তির দরকার আছে, সেটা আমরা ভুলে
যাই। আমি আগেও বলেছি, বাঙালির সবচেয়ে বড়ো দোষ - 'ভদ্রলোকি'। সুতরাং আমরা শুধুমাত্র
ভদ্রলোকিভাবে এটাকে যেন না-বুঝি। সত্যি সত্যি নিম্নবর্গের দিকে যদি যেতেই হয়, তাহলে
কল্পনাশক্তি না থাকলে চলে না।”
গায়ত্রীর দৃষ্টিতে, যুক্তি আমাদের বোঝায়, বিশ্লেষণ
করতে শেখায়, পুঁজিবাদী কাঠামো চিনতে সাহায্য করে, কিন্তু কল্পনাশক্তি আমাদের সেই কাঠামোর
বাইরে গিয়ে অন্যের অবস্থান গ্রহণ করতে শেখায় — যা নৈতিক, রাজনৈতিক, ও জ্ঞানের দিক
থেকে বিপ্লবাত্মক এক সম্ভাবনার দরজা খুলে দেয়। এইরকম কল্পনাশক্তি ছাড়া কোনো ‘র্যাডিক্যাল
পেডাগজি’ বা ‘গণতান্ত্রিক নৈতিকতা’ সম্ভব নয় — এটাই স্পিভাকের অবস্থান।
গায়ত্রী এই প্রসঙ্গে, অন্তত এই ক্ষেত্রে, কবিতাকে
যথেষ্ট গুরুত্ব দিয়েছেন, শুধু দেনই নি, তিনটে কবিতা নিয়ে (দুটো বিনয় মজুমদারের, একটি
শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের) বিশদে আলোচনাও করেছেন। গায়ত্রীর দৃষ্টিতে কবিতা হলো এমন এক ভাষা,
যা দৈনন্দিন, প্রাতিষ্ঠানিক, উপনিবেশিক ভাষার কাঠামোকে ভেঙে দেয়। অর্থাৎ, কবিতায় এমন
কিছু থাকে যা ব্যাখ্যা বা বাজারযোগ্যতার বাইরে। ফলে, কবিতা contentless
value-form-এর বিরুদ্ধে প্রতিরোধের ভাষা হয়ে ওঠে। Subaltern মানুষ নিজের কণ্ঠে কথা
বলতে পারে না, কারণ ভাষা তাকে জায়গা দেয় না। কবিতা বা কবিত্বপূর্ণ ভাষা সেই কণ্ঠহীনতার
ভাষা হতে পারে। কবিতা অতি স্বাভাবিকভাবেই আপন ছন্দে এবং মাধুর্যে মানুষের হৃদয়ে জায়গা
করে নেয়। সে কোন উচ্চ-নীচের প্রভেদ মানে না।
“উৎপাদন-প্রণালীর শুষ্ক আখ্যান দিয়ে ইতিহাসের
গতিকে অনুধাবন করা - শুধু form, শুধু যুক্তি। ইতিহাসের ভরাটি হচ্ছে ভবিষ্যতের কবিতা,
আর তার মাধ্যম রূপক। কাজেই কবিতা পড়তে শিখতে হয়। ব্যক্তিগত মৃত্যুর পর ভবিষ্যৎ- 'দুর্গম
পথস্তৎ কবয়ো বদন্তি' কবিতা শুনতে শিখতে হয়। নিজের জীবনের বর্গের মধ্যে কবিতা যিনি লেখেন,
তাঁকে যুক্তিযুক্তভাবে স্বীকার করতে হয় যে, সেই সীমার মধ্যে কবিতা লেখা শেষ করা উচিত।
কিন্তু পাঠক তাঁর কবিতা ছাড়ে না। ভবিষ্যতের ইঙ্গিত পায়। এই তো সমস্যার বৃত্তান্ত।”
গায়ত্রী বলছেন। তিনি মনে করেন, “অন্য লোককে, অপরকে নিজের মতো করে ভাবতে পারা --- এটাই
কল্পনার flexibility.”
আমার গায়ত্রীকে অধ্যয়ন করতে করতে কেন জানি না
মনে হয়েছে, বিশেষত একদম শেষে তিনটে কবিতার আলোচনা থেকে, গায়ত্রী অনেক সময় তাঁর ভাষাকে
ইচ্ছাকৃতভাবে দুর্বোধ্য, খণ্ডিত, ধ্বংসাত্মকভাবে নির্মাণ করেন — ঠিক যেমন আধুনিক কবিতা, কারণ, হয়তো
তিনি চান, পাঠক সহজে গ্রাস করতে না পারে, বরং পাঠক ধাক্কা খাক, থমকে যাক, ভাবতে বাধ্য
হোক। এটাই কবিতার রাজনৈতিক গঠন — পাঠককে নাড়িয়ে দেওয়া, চিন্তার অলিগলিতে ঢুকিয়ে দেওয়া, এবং
‘যা বলা যায় না’ তা অনুভব করিয়ে দেওয়া। কারণ, গায়ত্রীর কাছে কবিতা যুক্তির বিকল্প নয়,
বরং একটি নৈতিক ও রাজনৈতিক কল্পনার সাধনা, যা আমাদের শুনতে শেখায়, ভাবতে শেখায়, এবং
অন্যের হয়ে নিজের ভেতরকে বদলে ফেলতে শেখায়। এই বদলে যাওয়ার প্রক্রিয়া, এই ‘retraining
of the imagination’ — এইটিই তাঁর র্যাডিক্যাল শিক্ষাদর্শ, তাঁর কবিতা-প্রীতি, আর
তাঁর নৈতিক অবস্থানের মূল।
----------------------
বিঃ দ্রঃ
বইটি কিনবেন না। বা যারা গায়ত্রী স্পিভাকের ‘অপর’ সংকলনটি কিনেছেন কিম্বা কিনবেন মনে
করছেন, এই বইটার সমস্তটুকুই ওই বইটার মধ্যে রয়েছে। আলাদা করে কিনতে ২৫০ টাকা (মুদ্রিত
মূল্য) খরচ হবে, যার পুরোটাই আপনার অতিরিক্ত খরচ।
============
যুক্তি
ও কল্পনাশক্তি
গায়ত্রী
চক্রবর্তী স্পিভাক
অনুষ্টুপ
পাবলিকেশান
মুদ্রিত
মূল্যঃ ২৫০/-
ছবি কৃতজ্ঞতাঃ
ইন্টারনেট
গায়ত্রী'র লেখাটা পড়ি নি, তবি এই সং্খিপ্ত সমালোচনা / আলোচনা পড়লাম! ভালো লাগলো ! সমালচকের লেখনি ভালো, আরোও সাবলিলতা আশা রাখছি....!!!
ReplyDelete