গণতন্ত্রের রহস্য
গায়ত্রী স্পিভাক নিয়ে বলার দুঃসাহস
আমি দেখাব না। তার বইয়ের রিভিউ এটা নয়। কারণ, গায়ত্রীর চিন্তা-ভাবনার ক্ষেত্রটি আমার
কাছে সম্পূর্ন নতুন, শুধু তাই নয়, গায়ত্রীর বিদগ্ধতার সাথে আমার কোন তুলনাই চলে না।
তবু কেন লিখতে বসা? বাংলার আপামর পাঠকদের সামনে আরেকবার তাকে তুলে ধরা। যদি বলেন, ওহে,
তুমি কি বলবে? গায়ত্রীর কাজকম্মো আমরা অনেক আগেই গুলে খেয়েছি। সুতরাং তাকে নিয়ে তোমার
বলার কোন প্রয়োজন নেই। আমি বলব, অত্যন্ত দুঃখিত, বাংলার পাঠক সমাজের অধিকংশই এই মুহূর্তে
ভুলেই গেছে গায়ত্রী কিছুদিন আগে ঠিক কি পুরস্কার পেয়েছে।
এতএব, আমার সাধ্যমত
গায়ত্রীর কথা বলব। সমর সেন স্মারক বক্তৃতায় গায়ত্রী গণতন্ত্রের রহস্য উদঘাটন করছেন।
কি সেই রহস্য? গায়ত্রীর মতে, গণতন্ত্রের রহস্য তিনটে বিষয়ে নিহিতঃ-
১। গণতন্ত্র ব্যাপারটির উদ্দেশ্য সমাজের সকল অংশের একত্র উন্নতি,
এখানে কোন দলবাজি কিম্বা এলাকাবাজি মুখ্য নয়।
গায়ত্রী খুব স্পষ্ট
বলছেন, “মনে রাখবেন যে, গণতন্ত্র practice করে যারা, অর্থাৎ vote দেয়, তাদের সবচেয়ে
সংখ্যাগুরু অংশের শিক্ষার তালব্য 'শ' নেই। … গণতন্ত্র শুধু আমার অথবা আমার দলের অধিকারের
ব্যাপার নয়। Women's vote, dalit vote-এর ব্যাপার নয়। গণতান্ত্রিক নাগরিকতার মধ্যে
এই বোধও থাকতে হবে যে-যারা নানাভাবে নানাধরনের একেবারেই আমার অথবা আমাদের সদৃশ নয়,
এমনকি চোর, ডাকাত, পাজি, বজ্জাত, বৈষ্ণব, গর্দভ, সকলকে সমান বলে মানতে হবে। শুধু তারা
আমাদের সমান ভাবলে চলবে না; আমরা তাদের সমান এটা ভাবতে পারতে হবে জীবনে, মানতে হবে।
আবার ইংরেজিতে বলি - The aporia of democarcy is between liberty equals autonomy
and equality equals alterity | বলা যেতে পারে, অধিকার এবং সমান-অধিকারের মধ্যে বিবাদ
এবং গণতন্ত্রের অন্তর্নিহিত এই বিবাদী রহস্য একমাত্র প্রতি প্রজন্মের শিক্ষার দ্বারা
কিছুটা আটকে রাখা যায়, কিছুটা।
২। সকলের ভোটাধিকার এবং ভোটশেষে যদি দেখা যায়, তা শান্তিপূর্ণভাবে
হয়েছে, তার মানে এই নয় যে, গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা হল। কিম্বা বলা ভাল, ১০০ শতাংশ মানুষের
ভোটে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা না-ও হতে পারে।
গায়ত্রীর বক্তব্য
– “শুধু *ন জ*ম ছাড়া নিয়মানুবর্তী নির্বাচন পরিচালনা করা গেলেই গণতন্ত্র হয় না। … নির্বাচনে
সম্পূর্ণ শৃঙ্খলা আনতে পারলেও, নির্বাচন ব্যবস্থায় সঠিক প্রতিনিধিত্ব বজায় থাকলেও,
দেশ গণতান্ত্রিক হয় না। সুপরিচালিত নির্বাচন হল গণতন্ত্রের গণিত। গণতন্ত্র অত্যন্ত
অতিথিপরায়ণ, যে-কোনও মতবাদ, লোকহিতকারী বা উল্টো, সাম্যবাদী বা উল্টো, সংখ্যাগুরু ভোট
পেলে আসনে স্থান দেবে। যে-কোনও মতবাদকে গণতন্ত্রের গণিত আসন দিতে বাধ্য। আমরা সবসময়
বলে থাকি, জার্মানিতে নাৎসি পার্টি এসেছিল গণতান্ত্রিক নির্বাচনে। আলজিরিয়ায় ‘ইসলামিক
সালভেশন ফ্রন্ট’, তুর্কিতে ‘Tayyip Erdogan’, আমেরিকায় ট্রাম্প এবং আমাদের বর্তমান
কর্তারা, সকলে এসেছেন তথাকথিত গণতান্ত্রিক নিয়ম অনুযায়ী।
কাজেই এহ বাহ্য যে গণতন্ত্রের অভ্যন্তরীণ
নিয়মাবলি দিয়ে গণতন্ত্রের এই দ্বিতীয় আন্তরিক রহস্যের সমাধান করা যাবে না। সবচাইতে
কার্যকরী ভোট দেওয়ার ও গোনার আইনকানুন যে সমানে এবং সাবধানে বদলাতে হয় তা কে না জানে।”
কি সাংঘাতিক কথা বলছেন! আমাকে ব্যাপারটা
বুঝতে দুই দিন সময় নিতে হয়েছিল। বাস্তবতার বোধকে ইতিহাসের প্রেক্ষাপট ও উদাহরণ দিয়ে
বুঝিয়ে দেওয়ার পর সেটাকে মানতে পারা ও বুঝতে পারার যে সূক্ষ্মতা সেটা মাথার ঘিলুতে
থাকা অত্যন্ত প্রয়োজন।
৩। এক সার্থক গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য একটা গণতন্ত্র আগে থেকেই
প্রতিষ্ঠিত থাকা দরকার। এ যেন একটা প্যারাডক্স। আমার মাথার ভেতর আউলা ঝাউলা হয়ে গেল।
আসুন বরং গায়ত্রীর কি মত পড়ে নেওয়া যাক ---
“গণতন্ত্রের নিয়মাবলির
ভিতর যথাযথ কর্মসূচী পালনের জন্য দরকার পূর্বে স্থাপিত গণতান্ত্রিক সমাজের। … Performatic
contradiction অর্থাৎ গণতন্ত্রের পাটিগণিতকে কর্মক্ষম করতে হলে অর্থাৎ সামাজিকভাবে
কর্মক্ষম করতে হলে, দরকার প্রতিষ্ঠিত গণতান্ত্রিক সমাজের। জঁ জাক রুশো এটা জানতেন,
তিনি এটাকে বলেছিলেন paradox। রাজনৈতিক চিন্তকেরা মনে করেন, রুশোর মতে এই রহস্যটি বর্তমান
শুধুই সমাজস্থাপনার প্রথমে অথবা গোড়ায়। Honig বলেন এবং আমিও বলি যে, এই রহস্যের পুনরাবৃত্তি
দৈনন্দিন, যখন কোনো শাসনব্যবস্থায় নতুন নাগরিকদের জন্ম হয় এবং এই যে নাগরিকতার সঙ্গে
বংশানুক্রমের সম্পর্ক আছে অর্থাৎ জন্মগত নাগরিকতা এটা প্রসঙ্গত মনে রাখা দরকার, এই
নবজাতকের রক্ষণাবেক্ষণের সঙ্গে সঙ্গে গণতন্ত্রের রহস্যের পুনরাবৃত্তি দৈনন্দিন।
যখন কোনও শাসনব্যবস্থায় নতুন নাগরিকদের
জন্ম হয় অথবা তাঁরা যে ব্যবস্থায় অধিবাস (immigrate) করেন তখন প্রাচীন নাগরিকেরা সে
শাসনব্যবস্থার চাহিদায় স্বভাবধর্মে এবং আশার ছকে পুনরাবৃত্ত অথবা resocialised হয়।
অর্থাৎ, এই রহস্য শুধু একটি origin নয়, যেটাকে রুশো para-dox বলেছেন, সেটি একটি performative
contradction, কেননা আগে দরকার গণতান্ত্রিক একটা সমাজ, যাতে করে গণতন্ত্রের গণিত কর্মক্ষমতার
সঙ্গে চলতে পারে জনগণের নাগরিকতা অবলম্বন করে। অর্থাৎ, এই রহস্য শুধু একটি origin নয়,
গণতন্ত্রস্থাপনের গোড়াতে একেবারের মতো সমাধানসাপেক্ষ নয়, এটা originary, পুনরাবৃত্ত
হয়, এটার সঙ্গে ঘর করতে শিখতে হয়।
কি অদ্ভুত না? এখানেই গায়ত্রী থেমে
থাকেন নি। গণতন্ত্রে মূল ভিত্তি যে শিক্ষাব্যবস্থা, সেখানেও একহাত নিচ্ছেন। শিক্ষাব্যবস্থা
কীভাবে রাজনীতি এবং গণতন্ত্রের এক ব্রহ্মাস্ত্র হয়ে ওঠে সে নিয়েও কথা বলছেন এরপর। আমি
পড়ি, পড়তে পড়তে শিউরে উঠি, একটুকরো সত্যির সামনে মুখোমুখি হলে কে না শিউরে উঠবে?
“আমি সেইজন্যই বারবার বলছি, আন্দোলন,
বিপ্লব এবং শিক্ষা অনেকেরই খুব ফেভারিট, আজেবাজে স্লোগান দেওয়া, স্কুল বানানো, পয়সা
ছোড়া! এইসবের মধ্যে আমি নেই। আন্দোলন, বিপ্লব ও শিক্ষা (শেষেরটা সবচেয়ে দূরপাল্লার)-এই
তিনটি অসমানতালে একসঙ্গে কিন্তু বিভিন্ন কৌমগোষ্ঠীর হাতে না চললে সমাজে গণতান্ত্রিক
ধরণ বজায় রাখার আশা নেই। এই ছন্দ আনুন সারাদেশে। কিন্তু সে আশা দুরাশা।”
গায়ত্রী জানেন
আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার কি অবস্থা, আর তাই তিনি বলছেন, “ব্যবস্থাপনায় সব সমস্যার সমাধান
হয় না। অপ্রত্যাশিতকে স্বাগত জানানোর ক্ষমতা আমরা হারিয়ে ফেলি। নতুন ফ্রন্টলাইনে দেখছি
আই.টি-র কাজ কমছে, উঁচুতলাতেও। কারণ কৃত্রিম বুদ্ধিতে কগনিটিভ ফাংশান অথবা বোধশক্তির
কাজও এসে গেছে। কিন্তু যত কগনিটিভ ফাংশন ধরবে, যত বোধশক্তির কাজ কম্পিউটার ধরবে, তত
অপ্রত্যাশিত আর-এক পা পিছোবে। সুতরাং এই-যে কাজটা, কল্পনাশক্তিকে সাবলীল করা, যাতে
সাম্যবাদী হতে পারি, অপ্রত্যাশিতকে স্বাগত জানাতে পারি, সে ক্ষমতা নলেজ ম্যানেজমেন্ট
বন্ধ করে দিচ্ছে। সে ক্ষমতা আমরা হারিয়ে ফেলছি।”
শিক্ষা এবং গণতন্ত্রের এই অবস্থার
বর্তমান পরিস্থিতি কি? কেউ কি জানেন?
----------------------
বিঃ দ্রঃ বইটি ভেবে কিনবেন। বা যারা গায়ত্রী স্পিভাকের ‘অপর’
সংকলনটি কিনেছেন কিম্বা কিনবেন বলে মনে করছেন, এই বইটার সমস্তটুকুই ওই বইটার মধ্যে
রয়েছে। আলাদা করে কিনতে ২৫০ টাকা (মুদ্রিত মূল্য) খরচ হবে, যার পুরোটাই আপনার অতিরিক্ত
খরচ।
============
গণতন্ত্রের রহস্য
গায়ত্রী চক্রবর্তী স্পিভাক
অনুষ্টুপ পাবলিকেশান
মুদ্রিত মূল্যঃ ২৫০/-
Comments
Post a Comment