হেমলকের নিমন্ত্রণ

 


“আমি মানুষকে বলি, প্রশ্ন কর। তোমরা সবাই প্রশ্ন কর। পরীক্ষা কর। জীবনকে পরীক্ষা কর। বিনা প্রশ্নে কিচ্ছু মেনে নিও না। যে জীবন পরীক্ষিত, শুধু সে জীবনই বেঁচে থাকার উপযুক্ত। অপরীক্ষিত জীবন বেঁচে থাকার উপযুক্ত নয়। আমি মানুষের উপকার করছি। এথেন্সের উপকার করছি। সেজন্য আমার পুরস্কার পাওয়া উচিত। কোনো শাস্তি নয়।”

পাশ্চাত্য দর্শনের মহামানব সক্রেটিস। দর্শন? হ্যাঁ হ্যাঁ দর্শন। যিনি দ্রষ্টা, এবং অপরকেও শক্তি দেন দৃষ্টির। কেমন সে দৃষ্টির? সম্যক দৃষ্টির। সে দৃষ্টি দিয়ে আমি দেখব আমার পৃথিবীকে। আমার ভেতরের এবং বাইরের পৃথিবীকে। আমি জানব, নিজেকে। বড়ো সুন্দর করে লিখছেন সুজন দেবনাথ, “ক্রিতো বললেন, আমাদের জন্য আর কোনো আদেশ আছে? সক্রেটিস বললেন, নতুন কিছু নয়। যা সব সময় বলি , নিজেকে জানো। নিজেকে জানতে পারলেই সুন্দর জীবন হবে।”

সুজন দেবনাথের এই উপন্যাস কি তাহলে সক্রেটিসকে নিয়ে। উঁহু। এই উপন্যাসের নায়ক এথেন্স এবং তার স্বর্ণযুগ। সেই স্বর্ণযুগে কে নেই? লেখক এক জায়গায় তার কলমে পরিচয় করাচ্ছেন, “… এভাবে চিকিৎসাশাস্ত্র বের হলো দেবতার খপ্পর থেকে। বিজ্ঞানের সাথে মিশে গেল চিকিৎসা। বিজ্ঞানের জন্য যে রকম নতুন জিনিস করেছেন থেলিস, দর্শনের জন্য সক্রেটিস, স্থাপত্যে ফিডিয়াস, সাহিত্যে এস্কিলাস ও সফোক্লিস, সেরকম চিকিৎসার জন্য একেবারে নতুন কিছু করলেন কস দ্বীপের হিপোক্রাটিস।” আরও কত চরিত্র আছে --- পেরিক্লিস, আসপাশিয়া, প্লেটো…

আসপাশিয়াকে চেনেন? আশপাশিয়া ছিলেন পেরিক্লিসের ঘরণী। বিদগ্ধা এই নারীকে সমাজ মেনে নেয় নি। ফলে সমাজে তিনি পেরিক্লিসের স্ত্রী ছিলেন না, হন নি তার সম্পদের উত্তরাধিকারিণী। অথচ তার কাছে আসতেন স্বয়ং সক্রেটিস। তিনি তাকে মানতেন তার বন্ধু এবং গুরু বলে। আসপাশিয়া ছিলেন একজন ব্যতিক্রমী নারী, যিনি এথেন্সের পুরুষতান্ত্রিক সমাজে বুদ্ধিবৃত্তিক ও রাজনৈতিকভাবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছিলেন। তবে তাঁর কারণে প্রাচীন গ্রীসে নারীদের অবস্থানে উল্লেখযোগ্য কোনো কাঠামোগত পরিবর্তন ঘটেছিল কি না, তা নিশ্চিতভাবে বলা কঠিন, কিন্তু পেরিক্লিস এথেন্স এবং তার রাজনৈতিক পটভূমিকাকে নিয়ন্ত্রণ ও সুন্দর করার জন্য আশপাশিয়ার কাছে অনেকটাই কৃতজ্ঞ এবং নির্ভরশীল ছিলেন। আসপাশিয়ার কথা মূলত প্লুটার্ক, প্লেটো, জেনোফোন, অ্যারিস্টোফানিস ও অ্যাথেনিয়াসের গ্রন্থে পাওয়া যায়।

ফিরে আসি সক্রেটিসে, সক্রেটিসকে ঘিরেই যেন সুজন দেবনাথের এথেন্স আবর্তিত হয়েছে। হেমলকের নিমন্ত্রণ সক্রেটিসের আগমনে সূচনা, সক্রেটিসের মৃত্যুতে সে নিমন্ত্রণের যবনিকা। কেন? “মানুষ হিসেবে বেঁচে থাকার উদ্দেশ্য বদলে যাচ্ছে — সক্রেটিসের এথিকস বা নৈতিকতার মাধ্যমে। সক্রেটিসের এই সুন্দর জীবনের ধারণা হোমারের ছিল না। তার আগে কারওই ছিল না।”

সুজন দেবনাথ এই গল্প বলেছেন এখনকার যুবসমাজের কথ্যভাষায়। এ প্রসঙ্গে তিনি লিখছেন, “ভাষার ব্যাপারে আমি এই বইয়ে অত্যন্ত সচেতনভাবে একুশ শতকের তরুণদের মুখের ভাষাটিকে প্রমিতভাবে আনতে চেষ্টা করেছি। আমি মনে করি সব যুগেই একটি প্রমিত মানদণ্ড রেখে সেই যুগের মুখের ভাষাটিই সাহিত্যের ভাষা হয়ে ওঠে। এছাড়া আমার মনে হয়েছে সক্রেটিস সব সময় wit আর রসিকতা মিশিয়ে তরুণদের সাথে কথা বলতেন। সেজন্য এই বইয়ে আমি ইচ্ছে করেই এই সময়ের তরুণদের মুখের প্রাঞ্জল ভাষা ও শব্দ ব্যবহার করেছি।” কিন্তু সুজন দেবনাথ জানেন না, যে কেউ, এই উপন্যাসটা থেকে তার নাম মুছে দিয়ে যদি পড়ে, তাহলে চোখ বুজে বলবেন, এ উপন্যাসের লেখক হুমায়ুন আহমেদ। তিনি একুশ শতকের তরুণ তুর্কির মুখের ভাষা আনতে গিয়ে কখন যে হুমায়ুনের ভাষা কপি-পেস্ট করে ফেলেছেন লেখক মহাশয় জানতেই পারেন নি। ফলে এমন সুন্দর একটা উপন্যাসে কোথাও সুজন দেবনাথের লেখনীর সিগনেচার স্টাইল পাওয়া যাবে না। কেবল তার মুন্সিয়ানা এথেন্সের সুবর্ণযুগের সার্থক নির্মানে।

      কোন সুবর্ণযুগ একজনের কারণে হয় না। একঝাঁক মহাপুরুষ আসেন। তারা শুধু সেই সময়ের সেই সমাজকেই বদলে দেন না, পরবর্তী বহু সমাজ ও ব্যক্তির চিন্তাধারার ধারক ও বাহক হয়ে যান। সারা মানব ইতিহাসে, সম্ভবত এথেন্স প্রথম, এত বড়মাপে এবং এত বিভিন্ন বিষয়ে এত এত পরিবর্তন এনেছে যে, আজও আমরা তাদের কাছে কৃতজ্ঞ। এই পরিবর্তন হয় জ্ঞানের মধ্যে দিয়ে, আমাদের অভিধানে এর একটা সুন্দর শব্দ আছে – প্রজ্ঞা। প্রজ্ঞা মানুষকে আমূল বদলে দেয়। সুজন দেবনাথ লিখছেন, “সক্রেটিস আবার বললেন, তবে জ্ঞান বিষয়ে আর একটি ব্যাপার আছে। মানুষ যখন জ্ঞানকে পুরোপুরি উপলব্ধি করতে পারে, তখন তাকে বলে প্রজ্ঞা। প্রজ্ঞা কাউকে শেখানো যায় না। প্রজ্ঞা হলো স্বর্গীয় জিনিস। যে এটি পায়, সে আপনা-আপনি পায়। একটি অবস্থায় যাওয়ার পর আর কোনো শিক্ষক থাকে না।”

      এই প্রজ্ঞা পেয়েছিলেন সক্রেটিস। এই প্রজ্ঞা পেয়েছিলেন হেরোডটাস, পেয়েছিলেন পেরিক্লিস, পেয়েছিলেন প্লেটো, পেয়েছিলেন সফোক্লিস, পেয়েছিলেন আশপাসিয়া, পেয়েছিলেন ইউরিপিডিস, পেয়েছিলেন এরিস্টোফোনিস, পেয়েছিলেন হিপোক্রিটাস, পেয়েছিলেন ফিডিয়াস, ক্রিতো, জেনোফোন, সিমন আরও কত কেউ। এদের সবার রাজা সক্রেটিস। কেন? “সক্রেটিস বিমূর্ত কোনো ধারণা নিয়ে কথা বলেন না, তার সবকিছু প্র্যাকটিক্যাল, কোনো কিছুই অ্যাবস্ট্রাক্ট নয়। তিনি মানুষের জীবনের প্রতিদিনের সমস্যা, মনের উন্নত এসব নিয়েই কথা বলেন। তিনি এমন জ্ঞানের কথা বলেন, যে জ্ঞানকে জীবনে ব্যবহার করা যায়। তাই তার কথা সহজ। অর্থ গভীর কিন্তু শুনতে খুবই সহজ। মানুষের কাছে মনে হয়, সে তার নিজের কথা শুনছে। তাই তরুণরা সক্রেটিসকে ভালোবাসে, দূর থেকে ছুটে আসে তার কাছে , দূরে নিয়ে যায় তার ভাবনা।”

      এই উপন্যাসের আরেকটি বড়ো জায়গা হলেন জেনথিপি। সক্রেটিসের স্ত্রী। গ্রীসের সক্রেটিসের অনুগামী জেনথিপিকে দেখেছেন মন্দচোখে। সক্রেটিসের জীবনকে ঘনঘোর আন্ধকার ছাড়া জেনথিপি যেন আর কিছু দিয়ে যেতে পারেন নি। এই উপন্যাসেও জেনথিপিকে সেইভাবেই আঁকা হয়েছে। কিন্তু, তারও একটি কারন আছে। সংসারের যে দাবী জেনথিপিকে প্রতিদিন মেনে নিয়ে লড়তে হয়েছিল, সক্রেটিসকে তা হয় নি। ফলে জেনথিপি এবং সক্রেটিসের সম্পর্কটাকে বড়ো সুন্দরভাবে এঁকেছেন সুজন দেবনাথ তার লেখনীতে ---

      “জেনথিপি ভাবছেন, শুধু শুধু অভিমান করে কষ্টটা মনে পুষে রেখেছিলাম। আগে জিজ্ঞেস করলে, আগেই মিটে যেত। তিনি ভেবে দেখছেন, তিনি আসলে সারা জীবন সবকিছুতেই সক্রেটিসের সাথে অভিমান করে গেছেন। তাই দাম্পত্যের অনেক কিছুই উপভোগ করতে পারেননি। আজ শেষ রাতে তার অনেক কিছু মনে পড়তে লাগল। স্বামীর সাথে কত খারাপ ব্যবহার করেছেন। অকারণে রাগ করেছেন। গালি দিয়েছেন। এক-একটি ঘটনা মনে পড়ছে, আর কান্না পাচ্ছে। জেনথিপি কাঁদছেন। সারা জীবনের রাগের জন্য কাঁদছেন।

সক্রেটিস অনেক চেষ্টা করেও কান্না থামাতে পারছেন না। সারা জীবনের অপরাধ এক রাতের কান্নায় ভাসিয়ে দিতে চাইছেন জেনথিপি। কিন্তু সেটির কোনো দরকার নেই। তার ওপর সক্রেটিসের কোনো রাগ নেই। বরং সক্রেটিস ভাবছেন — সারা জীবন এই মেয়েটিকেই শুধু কষ্ট দিয়েছেন। দুনিয়ার সব মানুষের জন্য সুন্দর জীবন খুঁজেছেন। শুধু জেনথিপিকে দিয়েছেন একটি অসুন্দর জীবন। সক্রেটিসেরও কান্না পাচ্ছে।

দুজন দুজনের দুঃখে কাঁদছেন। রাত বয়ে চলছে। একটি ঝিরঝির বাতাসের শব্দ শোনা যাচ্ছে।”

সক্রেটিস একা বাঁচেন নি। সকলকে নিয়ে বাঁচতে চেয়েছিলেন। তিনি মানতেন, “মানুষ শব্দটার মানে একজন মানুষ নয়। মানুষ মানে অনেক মানুষের একত্র শক্তি। একা একা জ্ঞানী হয়ে লাভ নেই। একা কোনোদিন সুন্দর জীবন পাওয়া যাবে না। অনেকে একসাথে সুন্দর জীবন যাপন করলেই জীবন সুন্দর হবে। আর এই কারণেই আমি মানুষ খুঁজি। মানুষ না দেখলে আমি হাঁসফাঁস করি। শুধু মানুষের সঙ্গ পাওয়ার জন্য আমি পৃথিবীর শেষ প্রান্ত পর্যন্ত যেতে পারি।”

সক্রেটিস তাই আজও অমর। সম্ভবত মানব সম্প্রদায়ের যতদিন অস্তিত্ব থাকবে, সক্রেটিস থাকবেন। তার অমরত্বের কারনটি বড়ো সুন্দরভাবে লিখছেন সুজন দেবনাথ ---

“সারা দুনিয়া মিথ্যার পিছনে ছোটে। মিথ্যার অট্টালিকায় ভরে উঠে নগরের পর নগর। তবু দু’একজন মানুষ সত্যকে আঁকড়ে ধরে থাকেন। সেটিই তাদের সুন্দর জীবনের রহস্য। কেননা তারা পৃথিবীতে আসেন এক মুঠো আলো ছড়াতে। সেই আলো আকাশ - প্রদীপ হয়ে জ্বলতে থাকে। রয়ে যায় পৃথিবীর শেষ দিন পর্যন্ত। কেউ তাদের সাথে খারাপ কিছু করলেও, তারা বিনিময়ে খারাপ করেন না। অন্যায়ের বদলে অন্যায় করেন না। ক্ষমা ও প্রেমমাখা একটি সুন্দর জীবন যাপন করতে করতে একদিন নীরবে পৃথিবী থেকে চলে যান।”

আমি দেখছি, লেখক দেখাচ্ছেন, সক্রেটিস হেমলক পান করলেন এক নিঃশ্বাসে। ধীরে ধীরে পায়চারি করতে লাগলে কারাকক্ষে। এক সময় শরীর অবশ হয়ে এল। তিনি শুয়ে পড়লেন। তিনি ঢলে পড়লেন। তিনি মৃত্যুকে বরণ করলেন না, মৃত্যু তাকে বরণ করে নিয়ে মহান হয়ে গেল…

“একটি অবিনশ্বর মৃত্যুর জ্যোতি নিয়ে অদ্ভুত আঁধার নামছে পৃথিবীতে। সেই আঁধারের গা বেয়ে ফোঁটায় ফোঁটায় চুইয়ে পড়ছে মৃত্যু। মহাবিশ্বের মহত্ত্বম কান্নায় ভিজে যাচ্ছে পৃথিবীর সমস্ত আলো। মরণ সাগরের উপর দিয়ে অনাগত কালের পথ - সন্ধানী মানুষের জন্য নিমন্ত্রণ নিয়ে আসছে একটি পাখি — পাখিটির ঠোঁটে এক পেয়ালা হেমলক।”

 

==============

 

হেমলকের নিমন্ত্রণ

সুজন দেবনাথ

অন্বেষা প্রকাশন

মুদ্রিত মূল্যঃ ৮০০ টাকা

ছবি কৃতজ্ঞতাঃ তানজিলা জাহান

Comments

Popular posts from this blog

যে বুকে আগুন জ্বলে

শারদীয়া আনন্দবাজার পত্রিকা সম্পর্কে

জেরক্স কপির উন্নত ভার্সানে ‘আবার প্রলয়’ এসেছে