বেবি রেইনডিয়ার

 


রিচার্ড গাড --- এমন এক জীবন যাপন করেছেন, যা-র ওয়েব সিরিজ ভার্সানটা দেখার পর আমার মাথাটা এখনও টিসটিস করে যাচ্ছে। সিরিজটা দেখেছি সপ্তাহ হতে চলল, কিন্তু মাথার মধ্যে, বুকের মধ্যে এক-একটা জায়গা এমন আলুথালু হয়ে আছে, যে, সেই জায়গাটা গুছিয়ে নিয়ে ওঠা আমার এখনও হয়ে ওঠে নি।

      বেবি রেইনডিয়ার --- ওয়েব সিরিজটার নাম। বিষয়বস্তু – মেল রে*।

      পুরুষ নির্যাতন এখন আর নতুন কথা না। পুরুষ চিরকালই নির্যাতন হওয়ার কথা বলতে ভয় পায়। তার লজ্জা লাগে। এই বিষয়ে সে ঠিক সহজাত নয়। পুরুষতান্ত্রিক সমাজ হওয়ার কারণেই কি? অনেকদিন আগে একটা সিনেমা দেখেছিলাম, Section 377, তা নিয়ে আলোচনাও করেছিলাম। নারী নির্যাতনের আইন আজ নারীর অলঙ্কার হয়ে উঠছে। এমন অমোঘ অস্ত্র, যা, সত্যকে বিচ্যুত করছে।

      কিছুদিন আগে IPC ধারা পরিবর্তন হয়ে এল BNS ধারা। সেখানে প্রসঙ্গাক্রমে টাইমস অফ ইন্ডিয়ায় (JULY 14), একটা কলামে দেখতে পাই লেখা আছে, “The reality is even harder. The Baratiya Nyay Sanhita (BNS), which has replaced the IPC, no longer recognizes sexual crimes against men due to the removal of Section 377. As for transgender people, they now must rely solely on the Transgender act 2019, which has significantly lower penalties than the r*pe law for woman. The r*pe law, under both IPC and BNS, defines the perpetrator as a man and the victim as a woman.” বেবি রেইনডিয়ারের নাম এই কলামটা থেকেই জানতে পারি। কিন্তু তা যে এতটা ভয়ানক, ভাবতে পারি নি।

      গল্পে ডনি ডান লন্ডনের কমেডি জগতে নাম করতে আসা উদীয়মান ছেলে, পার্ট টাইম কাজ করে একটি পাবে, ঘটনাক্রমে জড়িয়ে পড়ে একজন লেখকের সাথে, যে তাকে ক্রমাগত রে* করে। ড্রাগস, জনপ্রিয় হওয়ার লোভ, সামাজিক ভয় --- সে চুপ করে যায়। কিন্তু এই ঘটনা তাকে অন্য জগতের সন্ধান দেয়। সে বুঝতে পারে সে আসলেই বাইসেক্সুয়াল। প্রেমিকা তাকে ছেড়ে চলে যায়, যদিও সে প্রেমিকার বাড়ীতেই থাকে, তার মায়ের বদান্যতায়। এখানে যৌনতা নেই, মায়ের তার প্রতি টানের কারণ তার মৃত ছেলের জন্যে জমে থাকা সমস্ত স্নেহ। এরপর সে নতুন সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ে, যে ট্রান্সজেন্ডার। এর মধ্যেই একটি অত্যন্ত মোটা মেয়ের সাথে তার পরিচয় হয়, যে একজন আইনজীবী, যে একজন স্টকার।

      স্টকার (Stalker) ব্যাপারটা কি? যে ডমিনেট করতে পছন্দ করেই শুধু না, যে অত্যন্ত তীবভাবে কারোর জীবনে শাষন ও শোষন করতেও পছন্দ করে। অন্যের জীবনের অত্যন্ত খুঁটিনাটি বিষয়েও তার প্রচন্ড আগ্রহই শুধু না, সেখানেও তার রাজত্ব চলে। যদি তার অন্যথা হয়, তাহলে সে চরম ভয়ঙ্কর হয়ে যায়। স্টকারের চারটে বৈশিষ্ট্য ---

1. Unwanted Communication: Persistent phone calls, messages, emails, or letters.

2.Physical Following: Trailing the victim in public places or appearing at their home or workplace.

3.Monitoring: Using technology to track the victim’s movements and activities.

4.Threats and Intimidation: Making verbal threats or engaging in actions meant to frighten the victim.

      মার্থার মধ্যে এই চারটে গুণই পূর্ণমাত্রায় ছিল।

      এইটুকু পড়ে যদি মনে হয়, চেনা চেনা লাগছে, আমি বলব হ্যাঁ। কলোনীতে কিম্বা এলিট সমাজে এরকম ব্যাপার আমি অনেক দেখেছি, শুনেছি। রোজ রাত্রে মদ খেয়ে এসে ছেলে-বউ পেটানো কিম্বা বাবা রাত্রেবেলা বউমার ঘরে একটু মদ্যপান করে ঢুকে পড়ছে অথচ পরিবারের সদস্যরা কিছু করতে অক্ষম --- এমন তো হামেশাই হচ্ছে। এখানে বাবা-মেয়ে, মা-ছেলে, ভাই-বোন, পাড়া-পড়শী --- কেউই নিরাপদ নয়। কিন্তু এর মধ্যেও কারোর মনের ওপর কিম্বা চিন্তার ওপর অধিকার কায়েম করে তাকে নিজের করে রাখার একটা যে জান্তব আনন্দ আছে, তার কাছে আর সব কিছুই যেন ম্লান হয়ে যায়। কিন্তু, এরপরেও, এ সবকিছুই একজন প্রকৃত স্টকারের কাছে অনেক ম্লান হয়ে যায়। স্টকার মানসিক অসুস্থতার এক চরম পর্যায়।

      এইটুকুই এই সিরিজের বিষয়বস্তু নয়। তার প্রাক্তন প্রেমিকা, তার বর্তমান ট্রান্সজেন্ডার প্রেমিকা এমনকি তার বাবা-মা, এমনকি পুলিশ --- সবাই তাকে সরে আসতে বলছে। সে নিজেও সরে আসতে চাইছেও। কিন্তু তবুও সরে আসতে পারছে না। কারণ এক অমোঘ আকর্ষণ। যন্ত্রণা পাওয়ারও একটা নেশা আছে। যারা সাবমিসিভ, তাদের সাবমিসিভনেসের মধ্যে একটা উত্যক্ত হওয়া, যাতনা কিম্বা শোষিত হওয়ার মধ্যে আনন্দ পায়। ডনি ডান সেটাই পাচ্ছে। সেটা চাচ্ছেও। তাই সে বারবার মেলগুলো পড়ছে, ভয়েস মেসেজগুলো শুনছে – যেগুলো স্টকার মার্থা স্কট তাকে পাঠাচ্ছে, দিনের মধ্যে একাধিকবার।

      কেন? কেন রে* হতে চাইছে সে? কেন বারবার মার্থাকে কামনা করছে সে। তার উত্যক্ততা তাকে কেন এমন আকর্ষণ করছে? কারণ একটাই। মনে তার আশা, একমাত্র এই একটি পদ্ধতিতেই তাকে কেউ মনে রাখছে। তার জীবন খুবই সাধারণ। সে সব ক্ষেত্রে ব্যর্থ। জীবন এবং আশেপাশের মানুষগুলো তাকে পিষে দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে। সমাজে সে কোনভাবেই সার্থকতা পাচ্ছে না। এমনকি, মজার ব্যাপার, সে জানে, সে যে উদ্দেশ্যে এসেছে, কমেডিয়ান হতে, সেটাও তার জগত নয়, ভালোবাসা নয়। তাকে আস্তে আস্তে সবাই ছেড়ে চলে যাচ্ছে। এইরকম এক সময়ে একমাত্র মার্থা, যে তাকে মনে রাখছে, সারাক্ষণ। হোক না সে স্টকার, কিন্তু এ পৃথিবীতে তারও একটা গুরুত্ব আছে, একজন মানুষের কাছে।

      খুব জটিল এক মানসিক টানাপোড়েনের কাহিনী এটা। দিনের শেষে কোন মানুষ একা হতে ভয় পায় না, কিন্তু একাকীত্বের সাথে বেঁচে থাকাটা, আনওয়ান্টেড জীবন যাপন করাটাকে মেনে নিতে পারে না। Loneliness এবং Aloneness –এর এটাই বড়ো ফারাক।

      এই সিরিজে কে কেমন অভিনয় করেছেন, কিম্বা কেমন ক্যামেরার কাজ, কিম্বা কেমন গল্পের প্লট --- আমি দেখি নি। আমি দেখেছি একটা মানুষ কিভাবে নিজের কাছে নিজেই আধমরা হয়ে যায়। নিজের কাছে কিভাবে নিজেই জটিল হয়ে যায়। কিভাবে সে অন্ধকার থেকে আরও অন্ধকারে চলে যায়। এমন ভয়ঙ্কর এক জটিলতার মধ্যে আমি এমন নিমজ্জিত হয়ে পড়ি যে, একটা সময় সেখান থেকে বেরিয়ে আসার জন্যে হাসফাস করতে থাকি। আমার মনে হয়, এ কেমন অন্ধকার? এ অন্ধকারের শেষ কোথায়? এভাবেই আস্তে আস্তে ডনি-মার্থার পরিণতির দিকে এগিয়ে যাই...

মজার কথা, মূল চরিত্রে অভিনয় করেছেন আত্মজীবনীকার রিচার্ড গাড নিজেই।

==============

Baby Reindeer

Directed by: Weronika Tofilska, Josephine Bornebusch

Written by: Richard Gadd

Starring: Richard Gadd, Jessica Gunning, Nava Mau, Tom Goodman-Hill

OTT Platform: NETFLIX

Comments

Popular posts from this blog

যে বুকে আগুন জ্বলে

শারদীয়া আনন্দবাজার পত্রিকা সম্পর্কে

জেরক্স কপির উন্নত ভার্সানে ‘আবার প্রলয়’ এসেছে