শাইলকের বাণিজ্য বিস্তার

 


মুখ ঢেকে যায় বিজ্ঞাপনে কবিতাটা মনে আছে? শঙ্খ ঘোষের?

 

“বিকিয়ে গেছে চোখের চাওয়া / তোমার সাথে ওতপ্রত

নিয়ন আলোয় পণ্য হলো / যা কিছু আজ ব্যাক্তিগত।

মুখের কথা একলা হয়ে / রইলো পড়ে গলির কোণে

ক্লান্ত আমার মুখোশ শুধু / ঝুলতে থাকে বিজ্ঞাপনে।”

 

বিজ্ঞাপনের পেছনের যে ব্যাবসা, অর্থাৎ, লেনদেন, আজ তো আর শুধুই টাকা-পয়সাতে সীমাবদ্ধ নয়। সময় কতটা দেওয়া হচ্ছে, ক্রেতা কতটা মাথায় রাখছে, ব্যবহার করছে, কতটা নিজের জীবনের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে নিচ্ছে সেটাও একটা বড়ো ব্যাপার।

এবার আসা যাক শাইলকের ব্যাপারে। শাইলক শেক্সপীয়ারের এক নাটকের চরিত্র। সে মহাজনী কারবারি। অর্থ বোঝে, এবং একমাত্র অর্থই বোঝে। দুর্ভাগ্য, এই শাইলকের ঋণের জালে প্রচুর মানুষ জড়িয়ে পড়েছিল, তার হাত থেকে যেন নিস্তারই ছিল না কারোর। চিরকালই দারিদ্রতাকে সম্পূর্ণ নির্মোচনের বদলে দারিদ্রের শোষকদের আমরা ঘৃণ্য চোখে দেখে এসেছি।

এই শাইলক নিয়ে উপন্যাস কেন? শাহযাদ বলছেন, “খুব স্বল্পকালের ভেতরে আমরা এমন একটা বণিক সভ্যতার গহ্বরে প্রবেশ করতে বাধ্য হব যে, আমাদের কেবল অন্ধকার থেকে আরও গভীরতর অন্ধকারের অভ্যন্তরে ঠেকে দেবে। আমাদের শিল্প সংস্কৃতি ইতিহাস ঐতিহ্য চিন্তন মনন অতীত বর্তমান ভবিষ্যৎ সত্তা আত্মা সহ সমগ্র জীবন বাজারের পণ্যের মতো বিশ্বায়নের বিশ্বহাটে বিক্রি হবে (এই পর্যায়ে আমার মনে হয়, আজকে যুগে যে রিলসগুলো সাধারণ ঘরণীরা করছেন, সেগুলো কি খুব সমর্থনযোগ্য?)। আমরা বিক্রি হওয়ার আগে বিকৃত হব এবং বিক্রি হওয়ার পর চিন্তাচেতনাহীন দাসানুদাসে রূপান্তরিত হব। আমাদের ভাবনাবিহীন সেই বিচিত্র দাসানুদাস সত্তা শুধুমাত্র একতি বস্তুর জন্য জীবন উৎসর্গ করবে, তার নাম মুদ্রা; আরও স্পষ্ট করে বললে বলতে হবে, ডলার (এই ভাবনাটা আমার একটু ‘উত্তর’ঘেষা লেগেছে। মুদ্রার কোন জাত হয় না। সাধারণ মানুষ ডলার বোঝে না। টাকা বোঝে)। ডলার আমাদের জীবনের প্রধান চালিকা শক্তিরূপে আবির্ভূত হবে আর আমরা তারই আরাধনায় প্রাণপাতকরতে বাধ্য হব। আমরা কারা? সমগ্র পৃথিবীর মানুষেরা। যারা ডলার উৎপাদন করে তারা এবং যারা তা করতে পারে না তারাও। যাদের ডলার নেই তারা এবং একই সঙ্গে যাদের আছে তারাও! এমনই এক বীভৎস বিশ্বায়নের জাল সারা বিশ্বজুড়ে বিস্তৃত হবে যা কাটা যায় না ছেঁড়া যায় না, যার ফাঁস থেকে কারও পরিত্রাণ নেই।” শাহযাদ লিখছেন ২০১১ সালে, আজ চৌদ্দ বছর পেরিয়ে গেছে। ভাবনাটা পুরোনো হয়ে যায় নি।

আমরা অতীত বেঁচে দিচ্ছি। আমরা আর ভারতীয় নেই। আমরা এখন বিশ্বনাগরিক। কিন্তু তার বিনিময়ে আমদের কি তাগ করতে হচ্ছে? আমাদের মুল কাঠামোটাকেই কি আমরা অস্বীকার করছি শুচিবায়ুগ্রস্থতার নাম দিয়ে? রবীন্দ্রনাথ ১৯২২ সালে একতি চিঠিতে প্রশান্তচন্দ্র মহলানবিশকে ‘আর্ট’ সম্পর্কে একটা উক্তি করেছিলেন। আর্ট শব্দটাকে সরিয়ে সাধারন জনজীবনের ক্ষেত্রেও, অন্তত বর্তমানে তার কথাটা কি সাংঘাতিক দেখুন! তিনি লিখছেন,

“শুচিবায়ু বলে একটা বায়ু আছে সেটাকে ত্যাগ করা চাই, কিন্তু অশুচিবায়ু বলে যে বায়ু আছে সেটাকে কি গ্রহণ করতে হবে? Distilled জলের ঝরনা বানাতে চাইনে কিন্তু তা বলে কি ধাপার মাঠে সহরের ড্রেনের জলে ঝরনা বানিয়ে … সেটাকে উপভোগ করতে যাব?”

আজ বিজ্ঞাপন কিম্বা বিজ্ঞাপনের পেছনের ব্যাবসা কখন যে আমাকে ধাপার মাঠের জলকেই গ্রহণ করতে বাধ্য করছে, আমরা টেরই পাই না। আমরা যে সমস্ত জিনিস কিনি, দেখা গেছে, তার অধিকাংশই আমাদের আসলেই কেনার কোন প্রয়োজন ছিল না।

শাহযাদের শাইলক সিকান্দারের অতীত কিনে নেয়। অতীত কি? সিকান্দারের বাবার ভাষায়, “অতীত! তার মানে তোমার ঐতিহ্য, তোমার সংস্কৃতি, তোমার ইতিহাস, তোমার পূর্বপুরুষের আশা-আকাঙ্ক্ষা, কামনা-বাসনা, তোমার স্মৃতি, তোমার সমস্ত সত্তার তিন ভাগের এক ভাগ---” এই সমস্ত উপন্যাসের মধ্যে আলো করে উঠে আসে সিকান্দারের ছেলে, সে হারিয়ে যায় গল্পের এক পর্যায়ে এই কথা বলতে বলতে, “বড় হবার ভবিষ্যৎ কিছুতেই বেচবো না --- কিছুতেই না!”

শাহযাদ যেন ভবিষ্যৎ প্রজন্মের হাতে এই সমস্যার সমাধান ন্যস্ত করেন। কিন্তু সেই ভবিষ্যৎ প্রজন্ম কোথায়?

ভবিষ্যতের গর্ভে।

 

======

শাইলকের বাণিজ্য বিস্তার

শাহযাদ ফিরদাউস

খোয়াবনামা প্রান্তজনের কথা

মুদ্রিত মূল্যঃ ১৫০/-

Comments

Popular posts from this blog

যে বুকে আগুন জ্বলে

শারদীয়া আনন্দবাজার পত্রিকা সম্পর্কে

জেরক্স কপির উন্নত ভার্সানে ‘আবার প্রলয়’ এসেছে