অঙ্গুলিমাল

 


“হিংসার বিরুদ্ধে অহিংসার বিজয়।”

শাহযাদ ফিরদাউস তার ‘অঙ্গুলিমাল’ উপন্যাস শেষ হচ্ছে এমনিভাবে। আজকের সময়ে দাঁড়িয়ে এই বাক্যের মূল্য কি নতুন করে উপলব্ধি করতে হবে?

না। আমার অন্তত তা প্রয়োজন নেই।

শাহযাদ তার এই উপন্যাসটি উৎসর্গ করেছেন কাদেরকে? “রক্তপাতহীন একটি পৃথিবী নির্মাণের জন্য যাঁরা সংগ্রাম করছেন” --- তাঁদেরকে।

কি নির্মম পরিহাস! আমরা মধ্যযুগীয় বর্বরতা পেরিয়ে এসেছি। আমরা দুটো বিশ্বযুদ্ধ পেরিয়ে এসেছি। তবু রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম শেষ হচ্ছে না। প্রতিদিন, প্রতি মুহূর্তে কোথাও না কোথাও তার জন্ম হচ্ছেই। কোন ঘরে কিম্বা দুটো দেশে। আবার তার শেষও হচ্ছে করুণ পরিনতিতে। সম্পর্কে… কিম্বা কাঁটাতারের বেড়ার ফাঁকে।

শাহযাদের এই উপন্যাসে অঙ্গুলিমাল ফার্স্ট পার্সনে লিখছেন, এবং কি সুচারুভাবে তার মনের অন্ধকারকে তুলে ধরছেন! কি সাংঘাতিক ঘৃণাবোধকে সযত্নে লালন পালন করেছেন। তাকে বড়ো করেছেন। এবং একসময় সমাজের ওপরে তার অমোঘ প্রয়োগ করেছেন। এমন উন্মাদনার মধ্যে মানুষ তার নিজের অন্তরাত্মার সাথে কিভাবে কথা বলে? শাহযাদ তার এক টুকরো ছবি গেঁথেছেন, আপন লেখকসত্ত্বার সুরমূর্চ্ছনা দিয়ে।

এ প্রসঙ্গে বলে রাখা যাক, অঙ্গুলিমাল হিংসার, না, হিংসা না বলে বর্বরতা বলা ভাল, তার এক সর্বোচ্চ উদাহরণ। অঙ্গুলিমাল সম্পর্কে উল্লেখ আছে মুল বৌদ্ধ গ্রন্থে ‘অঙ্গুলিমাল সূত্ত’ নামে, মজঝিম নিকায় (মধ্যমনিকায় / মধ্যম-পঞ্চাশ / রাজ-বর্গ)। ধর্মাধার মহাস্থবিরের অনুবাদটি বড়োই চমৎকার। অংশবিশেষে চোখ বুলিয়ে নিলে ক্ষতি কি?

(৩৪৭) আমি এইরূপ শুনিয়াছি। এক সময় ভগবান শ্রাবস্তীতে অনাথপিণ্ডিকের আরাম জেতবনে বিহার করিতেছেন।

সেই সময় রাজা পসেনদি কোশলের রাজ্যে নিষ্ঠুর, লোহিত-পাণি, হত্যা-প্রহত্যায় নিবিষ্ট, প্রাণী-ভূতদের প্রতি দয়াহীন অঙ্গুলিমাল নামক দস্যু ছিল। সে গ্রাম, নিগম, জনপদ ধ্বংস করিতে লাগিল। সে মানুষদিগকে বধ করিয়া অঙ্গুলির মালা ধারণ করিত। তখন ভগবান পূর্বাহ্ণ সময়ে নিবাসন পরিধান করিয়া পাত্র-চীবর ধারণপূর্বক ভিক্ষান্ন সংগ্রহের জন্য শ্রাবস্তীতে প্রবেশ করিলেন। ভগবান শ্রাবস্তীতে ভিক্ষান্ন সংগ্রহ করিয়া, পিণ্ডাচরণ হইতে প্রত্যাবৃত্ত হইয়া, ভোজনের পর শয্যাসন শামলাইয়া, পাত্র-চীবর গ্রহণ করিয়া যেখানে চোর অঙ্গুলিমাল ছিল, তদভিমুখে দীর্ঘপথের যাত্রী হইলেন। তখন গো-পাল, পশুপাল, কৃষক ও পথিকগণ যেদিকে ডাকাত অঙ্গুলিমাল আছে সেদিকে দীর্ঘপথের যাত্রীরূপে ভগবানকে দেখিতে পাইল। তাহারা ভগবানকে বলিল, “শ্রমণ, ওপথে যাইবেন না। শ্রমণ, ওপথে অঙ্গুলিমাল নামক দস্যু আছে। সে গ্রাম ধ্বংস করিতেছে। সে মানুষদিগকে বধ করিয়া অঙ্গুলির মালা ধারণ করে। শ্রমণ, ওই পথে (যদি) বিশ, ত্রিশ, চল্লিশ, পঞ্চাশজন পর্যন্ত দলবদ্ধ হইয়া গমন করে; তাহারাও চোর অঙ্গুলিমালের হস্তে, হত হয়।

এইরূপ উক্ত হইলেও ভগবান তূষ্ণীম্ভাবে চলিতে লাগিলেন।

দ্বিতীয়বার, তৃতীয়বারও পূর্ববৎ বলা হইল।

(৩৪৮) দস্যু অঙ্গুলিমাল ভগবানকে দূর হইতে আসিতে দেখিল, দেখিয়া তাহার এই মনে হইল, “ওহে, আশ্চর্যের বিষয়, অদ্ভুত ব্যাপার, এই পথে দশ পুরুষ পঞ্চাশ পুরুষও দলবদ্ধ হইয়া চলে, তাহারাও আমার হাতে হত হয়; অথচ এই শ্রমণ একাকী, অদ্বিতীয় সাহসপূর্বক যেন আসিতেছেন। যদি আমি এই শ্রমণের জীবননাশ করি, তবে ভালো হয়।তৎপর দস্যু অঙ্গুলিমাল ঢাল-তলোয়ার (অসিচর্ম) লইয়া, তীর-ধনু সংযোজিত করিয়া ভগবানের পশ্চাৎ পশ্চাৎ ধাবিত হইল। তখন ভগবান এই প্রকার ঋদ্ধি অভিসংস্কার সংস্করণ (যোগবিভূতি) করিলেন যে, যাহাতে দস্যু অঙ্গুলিমাল সর্বশক্তিতে দৌড়াইয়াও স্বাভাবিক গতিতে গমনশীল ভগবানকে ধরিতে সমর্থ না হয়। তখন দস্যু অঙ্গুলিমালের এই মনে হইল, “ওহে, বড়ই আশ্চর্যের বিষয়, বড়ই অদ্ভুত ব্যাপার, যে আমি পশ্চাদ্ধাবন করিয়া ধাবমান হস্তীকে ধরিয়াছি,… ধাবমান অশ্বকে,… ধাবমান রথকে,… ধাবমান মৃগকে ধরিয়াছি। অথচ এখন স্বাভাবিক ভঙ্গিতে গতিশীল এই শ্রমণকে সর্বশক্তিতে দৌড়াইয়াও আমি ধরিতে সমর্থ হইলাম না। সে স্থিত অবস্থায় ভগবানকে বলিল, “স্থির হও, শ্রমণ, স্থির হও।

অঙ্গুলিমাল, আমি স্থির আছি, তুমি স্থির হও।

 

আমি স্তব্ধ হয়ে যাই। “স্থির হও” এই শব্দটার মধ্যে যেন কত যুগযুগান্তের আরাম সঞ্চিত আছে বলে মনে হয় আমার। স্থির হতেই তো চাই। আমি স্থির হতে চাই। একদণ্ডের জন্যে হলেও সুস্থির হতে চাই। মন পাগলের মতো। কোথায় যে কখন থাকছে, আমার নিজের কাছেও স্পষ্ট নয়। এই অস্পষ্ট মন নিয়ে আমি কি করি? আমার মন কখন যে আমার অন্ধকারগুলোকে সামনে নিয়ে এসে তার সার্থকতা প্রতিষ্ঠা করে আমি নিজেই বুঝতে পারি না। অঙ্গুলিমালেরও ঠিক তাই হয়েছিল।

শাহযাদ ফিরদাউস এই অশান্ত মনের তড়িৎ-চলনটাকেই আমাদের সামনে তুলে ধরেছেন। এই উপন্যাসে আমি কোন অতিনাটকীয়তা পাই নি (একদম পাই নি বললে ভুল হবে। সিংহের উপখ্যানটাই তো যথেষ্ট অতিনাটকীয়)। কেবলমাত্র একজন মানুষ তার নিজের অন্ধকারের সাথে লড়াই করতে করতে একসময় তার হাতেই নিজেকে সঁপে দেয়। এক অন্ধকার থেকে সে আরও বড়ো অন্ধকারে নিক্ষিপ্ত হয়।

এবং, ঠিক এই কারণেই, আমাদের গৌতম বুদ্ধকে প্রয়োজন, বড়ো প্রয়োজন।

আর সবচেয়ে অবাক করা ব্যাপার, এ সবই হয় কীসের জন্য? জ্ঞানের জন্য। জ্ঞান যে আমাদের সবসময়ে আলো নিয়ে আসে, তা নয়। অসতর্কতায় আমরা জ্ঞানের পাঁকে ডুবে যাই --- শব্দজালম্‌ মহারণ্যম্‌ --- আদি শঙ্করাচার্য বলেছিলেন।

এই অসতর্কতাকে সতর্ক করতেই শাহযাদ অঙ্গুলিমালের এক কল্পিত কহিনীকে জীবন্ত করে তোলেন। আমি জীবন্ত অঙ্গুলিমালের সাথে সাথে এগিয়ে যাই… বুদ্ধের দিকে…

 

===============

অঙ্গুলিমাল

শাহযাদ ফিরদাউস

খোয়াবনামা প্রান্তজনের কথা

মুদ্রিত মূল্যঃ ২২৫/-

Comments

Popular posts from this blog

যে বুকে আগুন জ্বলে

শারদীয়া আনন্দবাজার পত্রিকা সম্পর্কে

জেরক্স কপির উন্নত ভার্সানে ‘আবার প্রলয়’ এসেছে