ব্যাস

 


মহাভারত নিয়ে অনেক লেখা হয়েছে, হচ্ছে এবং হবেও। কিন্তু কটা লেখা মনে দাগ কাটে? বিশেষত বাংলায়? চরিত্র চিত্রণ হয়ে চলেছে প্রচুর। কিন্তু সে সমস্তই আপন মনের মাধুরী মিশিয়ে তৈরী। সেই মাধুরীর সাথে যদি আমার মনের মাধুরী মিলে যায়, সুন্দর লাগে বৈ কি। কিন্তু মহাভারতের মধ্যস্থিত যে দর্শনবোধ, তার গুঢ় খবর কে দেয়?

     শাহজাদ ফিরদাউস দিয়েছেন, বলা ভাল, তার লেখা পড়তে পড়তে আমার মনে হচ্ছিল, এ যেন তিনি আমাদের জন্যে লিখছেন না। তিনি লিখছেন নিজের জন্য। যেন লিখতে লিখতে তিনি বুঝতে চেষ্টা করছেন মহাভারতের ভারতাত্মাকে। শুধু তাই নয়, তিনি যেন কোথাও, সেই তৎকালীন সমাজের মূলধারার সাথে পরিচিত হতে চাইছেন, সেই সাথে তাকে কাটাছেঁড়াও করতে চাইছেন। এবং, সেই একই সমাজের অত্যাধুনিক প্রতিনিধি, এই আমরা, এই সময়ে দাড়িয়েও মহাভারত যে কতটা ‘রেলিভ্যান্স’, সেটাও দেখাতে চাইছেন।

     তিনি যে চরিত্রটিকে নিয়ে তার এই মহাভারতের সূচনাপর্বকে নির্মাণ করার চেষ্টা করেছেন, সেই চরিত্রটি হলেন ব্যাসদেব, মহাভারতের আখ্যানকার। ব্যাস সম্পর্কে মহাভারতেও কি খুব বেশি কিছু জানা যায়? না। ব্যাস মহাভারতের শুধু কথকই নন; মহাভারতের জীবনগাঁথা নির্মাণের হোতা, মহাভারতের বংশধারা নির্মানের পুরোধা; বংশধ্বংশের নীরব অসহায় দর্শক; তৎপরবর্তী নির্মানের থেকে সরে এসে, সমাজ তথা জীবন দর্শনের গাঁথা আলেখ্য নির্মানের পুরোধা। এক ব্যাস, তার কতো বিভিন্নতা!

      ব্যাস জীবনকে জানতে চেয়েছেন, জীবনকে খুঁজতে চেয়েছেন ঈশ্বরে। শাহজাদ ফিরদাউসের ‘ব্যাস’ জীবনকে খুঁজতে গিয়ে বারে বারে মানুষের মধ্যে চলে যান। উদাসীন সন্ন্যাসী মানুষের সংসারে সারবস্তু খুঁজতে চান। শাহজাদের ব্যাসের চোখে মানুষই শেষ কথা বলে। শাহজাদের ‘ব্যাস’ মানুষের মধ্যেই নিজের সাধন উপলব্ধিকে বিলিয়ে দিতে চায়। শাহজাদের ‘ব্যাস’ মানব দরদী, মানব উদাসী নন। স্নেহবন্ধনকে অস্বীকার করেন না। আবার তাতে জড়িয়েও পড়েন না। অথচ এই দুই দ্বন্দ্বের মাঝে প্রতিনিয়ত পিষ্ট হন।

      শাহজাদের ‘ব্যাস’ মনে করেন, “মানুষের ভাষা এখনও অপরিণত। তাই আমরা পরস্পরের মনোভাব কখনো সঠিকভাবে উপলব্ধি করতে পারি না। তাই অকারণে ভুল বুঝি, ভুল বোঝাই। তাই সংঘাতের জন্ম হয়। আমাদের অপরিণত ভাষা আমাদের চিন্তাজগৎকে অস্বচ্ছ অবস্থায় রেখেছে। ফলে আমাদের মস্তিষ্কের সুপ্রয়োগ এখনো সম্ভব হয়নি। যদি আমরা আমাদের ভাষাকে আরও পরিণত করে তুলতে পারি তাহলে আমাদের চিন্তা-ভাবনা আরও স্পষ্ট এবং যথাযথ হবে। ঠিক একইভাবে ভাষার দিক থেকে এবং ব্যক্তির দিক থেকে দৃষ্টি সরিয়ে সমষ্টির দিকে তাকাও। সমষ্টির অবস্থানের দিকে তাকাও। সমগ্র ভুখন্ডের দিকে তাকাও। বিচ্ছিন্ন ব্যক্তির মতোই আমাদের বিশাল ভূখন্ড ছিন্ন বিচ্ছিন্ন, অগ্রন্থিত, অদৃঢ় ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত। অদৃঢ় ভূখন্ডের ভিত্তি দৃঢ় করতে হবে। সমগ্র মানুষকে তার বিচ্ছিন্নতা থেকে যেমন সংঘবদ্ধ করা প্রয়োজন তেমনি সমগ্র ভূখন্ডের বিচ্ছিন্নতাকে ঐক্যবদ্ধ করা প্রয়োজন।”

      আমি যখন এই সময়ে দাঁড়িয়ে সমগ্র ভারতবর্ষের দিকে তাকাই, বুঝতে পারি, কি নিদারুন এক সত্যি কথার মুখোমুখি হয়েছি আমি। ‘বিচ্ছিন্নতাবাদ’ শব্দটার সাথে আমাদের তো আর নতুন করে পরিচয় করতে হবে না। আর ভাষার দৈন্যতা, কোন এক নির্দিষ্ট ভাষাভাষীর সঙ্কীর্ণতার ফলে ভাষার ক্রমসংকোচন, কী নিদারুনভাবেই না চোখে পড়ছে। আমার কষ্ট হয়, আমার ভালো লাগে না।

      শাহজাদের লেখার মধ্যে অহেতুক টানা-হ্যাঁচড়া নেই। যতটুকু লিখলে তার বক্তব্য প্রতিষ্ঠা করা হয়ে যায়, তিনি ঠিক ততটুকুতেই তার লেখা শেষ করেন। এই উপন্যাস এমন কিছু বড়ো নয়। ‘নভেলা’র কাছাকাছি। কিন্তু তার ভেতরে তার চিন্তাধারার যে গতিবিধি, তা মাঝে মাঝে আমাকে থমকে দেয়। এই মুহূর্তে একটা ঘটনা মনে পড়ে যাচ্ছে, বালক ব্যাস তার পিতাকে জিজ্ঞাসা করছে, “রাজার কি কাজ?”

      “পরাশর কৃষ্ণের হাত ধরে আবার হাঁটতে শুরু করেন। হাঁটতে হাঁটতে তিনি বলেন, শাসন।

      কৃষ্ণ (ব্যাসের আরেক নাম কৃষ্ণদ্বৈপায়ন) বুঝতে না পেরে জিগ্যেস করে – শাসন কি?

      পরাশর – প্রজাদের সোজা করা!

      কৃষ্ণ – প্রজারা তো সোজাই আছে।

      পরাশর – তাহলে তাদের একটু বাঁকিয়ে নিয়ে আবার সোজা করা।”

 

      আমি পড়তে পড়তে চমকে উঠি। এত স্পষ্টভাবে আজকের সময়ে দাঁড়িয়ে এত নিদারুন সত্যিটাকে বলা যায়!

      বলা যায়।

      শাহজাদ ফিরদাউস, অন্তত, বলার চেষ্টা করেছেন।

 

===============

 

ব্যাস

শাহজাদ ফিরদাউস

খোয়াবনামা প্রান্তজনের কথা

মুদ্রিত মূল্যঃ ৩০০ টাকা

ছবি কৃতজ্ঞতাঃ ইন্টারনেট

 

Comments

Popular posts from this blog

যে বুকে আগুন জ্বলে

শারদীয়া আনন্দবাজার পত্রিকা সম্পর্কে

জেরক্স কপির উন্নত ভার্সানে ‘আবার প্রলয়’ এসেছে