আফটার ডার্ক
যে যাই বলুক, এমনকি আমি নিজেও যতই যা বলি না কেন, হারুকি মুরাকামির
লেখাতে এমন একটা ম্যাজিক আছে যেটাকে অস্বীকার করা যায় না। কোথাও, বর্তমান বিশ্বে তিনি
অন্যান্য লেখকদের থেকে বেশ খানিকটা আলাদাই। ‘After Dark’ পড়তে পড়তে আমার সেটাই মনে
হচ্ছিল।
এক রাতের গল্প
– রাত - মানুষকে সাহসী করতে পারে; মানুষকে দুঃখী করতে পারে; মানুষকে ভীতু করতে পারে;
মানুষকে নিজের ভেতরে ঢুকতে সাহায্য করতে পারে; মানুষকে অন্যের ভেতরে ঢুকতেও সাহায্য
করতে পারে।
রাত আমার বড়ো প্রিয়।
দুই বোন। মারি
আর এরি। এরি ঘুমিয়ে আছে কয়েকদিন ধরে, টানা। মারি রাত্রেবেলা শহরে শহরে ঘুরে বেড়াচ্ছে,
একা। মারি বাস্তব, এরি পরাবাস্তব। দুই বোনে সুসম্পর্ক নেই। অথচ কাছে আসার এক আকুতি
আছে। সম্পর্কের এই এক সমস্যা। কে আগে এগিয়ে এসে শান্তিপ্রস্তাব দেবে, তার ওপরে অনেক
কিছু নির্ভর করে। এই শান্তিপ্রস্তাব পাওয়ার আগেই, এক রাত্রে, ঘটে যায়, অনেক কিছু। সেই
নিয়েই উপন্যাস ‘আফটার ডার্ক’। মানুষ একে অপরের থেকে কতটা বিচ্ছিন্ন, এমনকি তারা খুব
কাছাকাছি থেকেও। মানবিক একাকীত্ব এবং বিচ্ছিন্নতার গভীর এক অন্বেষণ ‘After Dark’।
মুরাকামির লেখনী
এখানে সিনেমাটিক, যেন আমরা একটি ক্যামেরার চোখ দিয়ে এই রাতের শহর এবং মানুষের জীবনের
ছোট ছোট অংশ দেখছি। কিন্তু এই দেখার মধ্যে একটা শীতল দূরত্ব আছে। এই দূরত্বই মুরাকামির
বইয়ের কেন্দ্রীয় থিম। আমরা চরিত্রগুলোর খুব কাছ থেকে কিছু মুহূর্ত দেখতে পাই, কিন্তু
তাদের পুরোপুরি বোঝা যায় না। আমাড়া বুঝি যে অন্য মানুষকে পুরোপুরি বুঝতে পারা অসম্ভব,
বিশেষত এমন রাতের অন্ধকার পরিবেশে যেখানে বাস্তবতা এবং কল্পনা মিলেমিশে একাকার হয়ে
যায়।
মুরাকামি প্রায়শই
বাস্তব এবং কল্পনার মধ্যেকার সীমানা মুছে দেন। তার অধিকাংশ লেখাতেই এটা দেখা যায়। এরি’র
ঘুমের দৃশ্য, যেখানে সে অদ্ভুতভাবে এক ঘরে আটকে থাকে এবং এক অদ্ভুত পুরুষ তাকে নিরীক্ষণ
করে, তা এক উদ্ভট পরাবাস্তবতার প্রতিফলন। এরি শারীরিকভাবে জীবিত, কিন্তু তার মানসিক
উপস্থিতি যেন অন্য কোথাও। কোথায়? কে বলতে পারে তা? এরি নিজেও কি তা জানে? এক ধরনের
অদ্ভুত দুনিয়ার সাথে মানুষের সংযোগের ইঙ্গিত, যেখানে বাস্তবতা একেবারে ভেঙে পড়ে।
যেখানে মানুষ অন্যভাবে নিজেকে দেখে।
‘ফাঁকা সময়’ বা
‘লিমিনালিটি’ — গল্পের
একটা বড়ো ব্যাপার। যেখানে চরিত্রগুলো রাতের ভেতরে ভাসমান, অপেক্ষায় থাকে। কীসের অপেক্ষা?
জীবনের পরবর্তী পদক্ষেপের অপেক্ষা। এই সময় তাদের জীবনে কোনো বড় কিছু ঘটে না, কিন্তু
এই শূন্য সময়ই জীবনের আসল প্রশ্নগুলোর মুখোমুখি দাঁড়ানোর সুযোগ দেয়। এই ফাঁকা সময়ে
চরিত্রগুলো নিজেদের একাকীত্ব, ভয় এবং অস্তিত্বের সঙ্কট নিয়ে লড়াই করে। তেৎসুয়ো,
কাওরো, শিরাকাওয়া – সময়ের সাথে সাথে একে-অপরের কাছে আসতে থাকে কিন্তু কখন যে একে অপরের
রসায়নে পরস্পর পরস্পরের অন্তরে আলোকবর্তিকা প্রেরণ করছে, বুঝতেও পারে না। তারপর এই
লড়াই সহজ হয়ে যায়।
আসলেই, দিনের শেষে,
মানুষ মানুষের জন্য।
এরি এবং মারি চরিত্র
দুটি সম্পূর্ণ ভিন্ন প্রান্তে দাঁড়িয়ে থাকে। এরি সম্পূর্ণ প্যাসিভ, অচেতন ঘুমে আটকে
আছে, তার জীবনের উপর কোন নিয়ন্ত্রণ নেই। মারি সক্রিয়, রাতে বেরিয়ে বিভিন্ন মানুষের
সাথে যোগাযোগ করছে, কাজ করছে। আমরা কি সত্যিই সক্রিয়ভাবে জীবনের সিদ্ধান্ত নিই, নাকি
এমন সময়ও আসে, যখন আমরা শুধু প্রবাহের সঙ্গে ভেসে যাই, এবং জীবনের উপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে
ফেলি? এ প্রশ্নের উত্তর কে দেবে? কেউ না। মুরাকামিও দেন নি। এখানেই মুরাকামি রহস্যময়।
মুরাকামির
After Dark সরাসরি কোনো সমাধান দেয় না। রহস্যময় এবং প্রশ্নবিদ্ধ এক উপন্যাস। এরি
কেন অদ্ভুতভাবে ঘুমাচ্ছে? সেই পুরুষটি কে যে তাকে পর্যবেক্ষণ করছে? মারির রাতের অভিজ্ঞতার
পরিণতি কী? এসব প্রশ্নের স্পষ্ট উত্তর নেই, আর এই ধাঁধা আমাকে ভাবায় এবং গল্পের গূঢ়তা
আরো চিন্তনময় করে তোলে। আমি বই মাঝপথেই থামিয়ে ভাবতে শুরু করি। আসলেই মুরাকামি পাঠকদেরকে
এমন এক অভিজ্ঞতায় নিয়ে যেতে চায়, যেখানে তারা নিজেরাই উত্তর খুঁজে নেয়।
আমি কি উত্তর খুঁজে পেয়েছি?
এই উপন্যাসে, প্রতিটি চরিত্রই এক অর্থে
নিজের পরিচয় খুঁজছে। মারি রাতের অন্ধকারে বেরিয়ে পড়েছে, যেন সে তার নিজের অস্তিত্বের
কোনও অংশ খুঁজছে। এরি তার ঘুমের মাধ্যমে বাস্তবতা থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলেছে,
যেন সে পালিয়ে গেছে। জীবনের কিছু সময় আসে, যখন আমরা নিজেদের পরিচয় নিয়ে গভীর প্রশ্ন
করি, এবং সেই মুহূর্তগুলো সাধারণত আসে যখন সবকিছু শূন্যতায় ভরা থাকে — যেমন রাতে, যখন শহর নীরব এবং ধীরে
চলছে। টোকিও নিজের মতো করেই বয়ে চলেছে শহুরে উন্মত্ততায়।
মারি যে চরিত্রগুলোর সংস্পর্শে আসে,
তারা প্রত্যেকেই কিছু না কিছুভাবে জীবনের মূলধারার বাইরে অবস্থান করছে। এই প্রান্তিকতা
সম্পর্কের এক নতুন মাত্রা এনে দেয় — তারা সবাই জীবনের কিছু গুরুত্বপূর্ণ
অংশ থেকে বিচ্ছিন্ন। এই সম্পর্কগুলো ক্ষণস্থায়ী, অগভীর, কিন্তু তারপরও সেই একাকীত্বের
অনুভূতি থেকে মুক্তির চেষ্টা দেখা যায়। তার পরিনাম কখনো বীভৎস, কখনও শান্ত। আমি অবাক
হয়ে যাই পড়তে পড়তে।
বইয়ের শেষ পর্যায়ে এসে গেছি যে!
বহুমাত্রিক উপন্যাস। বহুমাত্রিক চেতনালব্ধ
অনুভূতি। ততোধিক ম্যাড়ম্যাড়ে অনুবাদ। পড়তে মন্দ লাগবে না। অন্তত আমাকে যদি এত কিছু
ভাবিয়ে থাকে, আপনাকেও, অন্তত, ভাবাতে পারে।
====================
আফটার ডার্ক
হারুকি মুরাকামি
অনুবাদকঃ তানজীম রহমান, ওয়াসি আহমেদ
বাতিঘর প্রকাশনী
মুদ্রিত মূল্যঃ ২০০টাকা
ছবি কৃতজ্ঞতাঃ ইন্টারনেট
Comments
Post a Comment