অন্তর্বাসনা

 


লেখকদের প্রত্যেকটা লেখাই সন্তানসম --- মহাজনেরা বলেন। কিন্তু সব সন্তানের প্রতি কি মায়ের সমান টান? সব লেখাকেই কি লেখক প্রাণপ্রিয় আখ্যা দেন? মায়াময় এ জগতে সেই লেখাই সাধারণ গড়পড়তা লেখকদের কাছে বেশি মান পায়, যে লেখা খুব সহজেই সাধুবাদ পাবে, জনগণমানসে নিজের জায়গা অধিকার করবে, চেনা পথ চেনা ছক ধরে। বিতর্কিত লেখা, সাধারণ লেখা থেকে বেরিয়ে এসে একটু অন্য ধরনের লেখা, কিম্বা অন্য ধরনের চিন্তা-ভাবনা, তার প্রতি লেখকের একটা অনুকম্পাবোধ থাকে। লেখক ভাবেন, আহা রে! এই লেখাটা লিখতেও আমি কত না রাত জেগেছি, কিন্তু, লেখাটা তার প্রাপ্য মর্যাদা পেল না! অথচ এর গুণীজনে সমাদৃত হওয়ার সমস্ত গুণ এর ছিল...

      আসুরী, কারবাঁ, দহনপুরুষ, পরস্বকায় --- এইগুলো লেখিকা সুপর্ণা চ্যাটার্জী ঘোষালের জনপ্রিয় লেখা। আর একটি মাত্র বই-ই তার দুয়োরাণী – অন্তর্বাসনা। প্রচারের আড়ালে, আলোচনার আড়ালে, হয়তো বা একদিন ‘আউট অফ প্রিন্ট’ হয়ে জনমানসের আড়ালে চলে যাবে। দুর্ভাগ্য বইটার। দুর্ভাগ্য লেখিকার।

      প্রত্যেকটা লেখার পেছনেই একটা পরিশ্রম থাকেই থাকে। কিন্তু কি বিষয় লেখক বাছছেন সেটাও একটা বড়ো ব্যাপার। তিনি কি সময়ের স্রোতের উল্টোদিকে ভাবছেন? তিনি কি এমন একটা বিষয় নিয়ে লিখতে চাইছেন যা প্রয়োজনীয়, কন্টেম্পোরারি? তিনি কি এমন বিষয় নিয়ে লিখতে চাইছেন যা অনেক মানুষের কাছে পাঠ্যপুস্তক হয়ে থাকবে? তেমন তেমন বিষয় নিয়ে পরিশ্রম করলে লেখক সার্থক হন। তেমন বিষয় নিয়ে পড়াশোনা করে পাঠকও সার্থক হন। বই জনপ্রিয়তার অর্থ শুধু চড়া দামে বিকানো না, পঁচিশ বছর পরে যেন তা নিয়ে আলোচনা হয় এমন বিষয় নিয়েও কথা বলা।

      ‘অন্তর্বাসনা’ অনায়াসে এই গোত্রে পড়তে পারত। এই বই ফ্যাশান ডিজানিং নিয়ে বিশেষত যারা পড়েন, তারা অনায়াসেই পাঠ্যপুস্তক করার কথা ভাবতে পারেন। বিশেষত মাতৃভাষায় এমন ঋদ্ধ করা লেখা আমি এই সময়ে দাঁড়িয়ে খুব একটা মনে করতে পারছি না। কিন্তু নাম ও প্রচ্ছদ যেভাবে লোক টানবে, বইয়ের বিষয়বস্তু রসিক নাগরের ক্ষেত্রে ততটাই হতাশ করবে। এ বই জ্ঞানার্জনের বই। এ বই বাৎসায়নের নব সংস্করণ নয়। এ বই অন্তর্বাসের ‘ইতিহাস, ভূগোল ও বাণিজ্য’।

      আমরা ছোট থেকে বড়ো হয়েছি অন্তর্বাসের অতি প্রয়োজনীয়তার সাথে। আমার ছোটবেলা সোনার চামচ মুখে নিয়ে কাটে নি, এখনও না। ফলে আমাদের অন্তর্বাসের সাইজ কিম্বা প্যাটার্নে খুব একটা পরিবর্তন ঘটে নি। রঙের পরিবর্তনও না। ‘আসুন স্ট্র্যাপ খুলি’-র প্রথম প্যারাটা আমার কাছে এতটাই পরিচিত যে, পড়তে পড়তে এক টুকরো নিজেদের ইতিহাস ও স্মৃতিকণাগুলো কাঠের ফাটলের আড়ালে থাকা স্ফুলিঙ্গের মতো উড়ে উড়ে এসে আবার মিলিয়ে যেতে লাগল।

      বিস্ময়কর লেখা। প্রবন্ধ হো তো অ্যায়সা। অন্তর্বাসের কত বড়ো ইতিহাস বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে রয়েছে! একটা একটা করে তার পরত খুলে সামনে ধরা, স্কেচের সাথে সাথে সেগুলোকে বোঝানোর চেষ্টা এবং তা অধিকাংশেই সফল। লেখিকার পাঠ এবং তা আত্তিকরণ করে আমাদের সামনে প্রস্তুত করা --- তার লেখার ও পড়াশোনা করার গভীরতা চেনাবার পক্ষে এই একটি বই যথেষ্ট।

      লেখিকার লেখার মধ্যে একটা উগ্রতা আছে। সেটা লেখিকা নিজস্ব সম্পদ। তার অনেক পোস্টেও আমি এটা খেয়াল করেছি। আমার তাতে খুব একটা কিছু এসে যায় না। কিন্তু সেটাকেই লেখনশিল্পের মধ্যে টেনে আনাটা বিস্ময়কর। তিনি জানেন মহিলাদের অন্তর্বাস নিয়ে কথা বলতে চলেছেন। সেখানে ঢাক ঢাক গুড় গুড় চলবে না। সেখানে তাকে তার ছন্দেই বলতে হবে। সেই বলাটাই এখানে আমার যথাযথ বেশ লেগেছে।

      মাত্র পাঁচটা বই এবং ইন্টারনেট সহযোগে এই বইয়ের নির্মান আমার কাছে একটা উদাহরণ হয়ে রইল। আমরা মেয়েরা যদি স্মার্ট হতে চাই আমাদের অত্যন্ত প্রয়োজনীয় দৈনন্দিন ব্যবহৃত পোষাকটি সম্পর্কে কেনই বা না আমরা আরেকটু ঘনিষ্ঠভাবে পরিচিত হবো না? কটা মানুষ আর ইংরাজী পড়তে পারে, কিম্বা পড়তে পারলেও সহজাত বোধে সেটাকে আত্মস্থ করতে পারে? আমাদের কাছে এই বই কিন্তু একটা বড়ো সহায়ক, জ্ঞানের ক্ষেত্রে।

      এই বইয়ের পর্যায় চারটি। ইতিহাস, বিভিন্নতা, বানিজ্য, উপসংহার। অন্তর্বাস কিভাবে মৃত্যুর কারণ হতে পারে, সেখান থেকে শুরু করে অন্তর্বাস কিভাবে *যৌ*ন* আনন্দের মহার্ঘ্য মহাস্ত্র হয়ে ওঠে - তার ইতিহাস, তাকে সার্থক রূপ দেওয়ার বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠা, তাকে বিশ্বের নানা প্রান্তে ছড়িয়ে দেওয়ার ভূগোল - সব সব সব - এই বইতে আছে। সুন্দরভাবে। অহেতুক না ফেনিয়ে। অহেতুক না বাড়িয়ে। অহেতুক না সুড়সুড়ি দিয়ে।

      লেখিকার অন্যান্য বইয়ের বিজ্ঞাপন আমি দেখেছি। আমায় তা খুব একটা আকর্ষণ করে নি। চিরায়ত বিষয় নিয়ে অহেতুক কচাকচি আমার পছন্দ নয়, তা যত রসিয়েই লেখা হোক না কেন। আর ‘অন্তর্বাসনা’ পড়ার পর, লেখিকার মেধা ও লেখার ক্ষমতার যে পরিচয় আমি পেলাম, তাতে করে ওই সমস্ত বই পড়া মানে দই-মিস্টির পরে নিম-বেগুন ভাজা খাওয়া।

বরং, আমি অপেক্ষা করব, এমনই, অন্য কোন গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে আরেকটা উপযোগী গ্রন্থের। লেখিকা আমার মননে কেবলমাত্র এই বইটার জন্যেই থাকবেন, যতদিন না আরেকটা এরকম কোন গ্রন্থে তিনি তার এমনই জাত চেনান।

=================================

অন্তর্বাসনা

সুপর্ণা চ্যাটার্জি ঘোষাল

বইচই পাবলিকেশান

মুদ্রিত মূল্যঃ ২৯৯/-

Comments

Popular posts from this blog

যে বুকে আগুন জ্বলে

শারদীয়া আনন্দবাজার পত্রিকা সম্পর্কে

জেরক্স কপির উন্নত ভার্সানে ‘আবার প্রলয়’ এসেছে