দ্য গেস্ট ক্যাট

 


      তাকাশি হিরাইড – নাম শুনেছেন? আম শুনিনি।

      জাপানী এই লোকটির লেখা হাতে গোনা। কবি (check)-সাহিত্যিক এই লেখকটির এই বইটা আমার হাতে এসে পড়ল। আর আমি পড়া শুরু করলাম তৎক্ষণাৎ। কেন? জাপানী সাহিত্য আশেপাশে চোখে পড়লেই আমি পড়ে ফেলছি যে! জাপানী সাহিত্য মানেই তো আর কাজুও ইশিগুরো কিম্বা হারুকি মুরাকামি নয়!

      দ্য গেস্ট ক্যাট প্রকাশিত হয়েছে ২০১৪ সালে। বাংলাদেশে অনুবাদ হয়ে গেছে, ২০২৪ সালে। কপিরাইট ইত্যাদির কথা বাদ দিন। ওদের ওখানে বইটি পড়ার লোক আছে। এতএব অনুবাদ হয়ে পাবলিশ হয়েছে। আমাদের এখানে পড়ার লোক নেই। তাই কিস্যু হয় নি, হয় না। সোজা হিসাব।

      এই বইয়ের গল্পটা কি? টোকিওর একটি নিরিবিলি পাড়ায় বসবাসরত এক দম্পতি, যারা পাশের বাড়ির একটি ছোট্ট বিড়ালের সাথে বন্ধুত্ব গড়ে তোলে। সেই বিড়ালের নাম চিবি, এবং সে মাঝেমধ্যে এই দম্পতির বাড়িতে আসে। চিবির এই ছোট্ট উপস্থিতি তাদের জীবনে একধরনের প্রশান্তি ও সংযোগের অনুভূতি এনে দেয়। চিবি কাউকেই ধরা দেয় না। সে কেবল আসে আর যায়। এই যাওয়া আসার মাঝের সুখদুঃখের গল্প, উপন্যাসের মূল বিষয়বস্তু।

      একে এক কথায় কি বলে?

      ক্ষণস্থায়ীত্ব - মোনো নো আওয়ারে (Mono no Aware), ‘মোনো নো আওয়ারে’ বলতে জাপানি সংস্কৃতিতে অস্থায়ী বিষয়গুলোর সৌন্দর্যের প্রতি একধরনের অনুভূতি বোঝায়। ‘মোনো’ মানে জিনিস বা বস্তু, এবং ‘আওয়ারে’ মানে অনুভূতি বা আবেগ। যে কোন জিনিসের ক্ষেত্রেই জিনিসগুলোর প্রতি এক ধরনের মৃদু, দুঃখময় অনুভূতি, যখন আমরা বুঝতে পারি যে এগুলো চিরস্থায়ী নয় এবং সবকিছু একদিন হারিয়ে যাবে।

      জাপানী সাহিত্যে এই বিষয়টা কি সাংঘাতিকভাবে প্রতিফলিত। এখানে তার প্রতিফলন – একটা বেড়াল। আজকের ব্যস্ত জীবনে, ‘মোনো নো আওয়ারে’ আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে জীবনের ছোট ছোট মুহূর্ত, যেগুলো আমরা প্রায়ই উপেক্ষা করি, সেগুলোই আসলেই মূল্যবান। আমাদের ধীরস্থির হয়ে বেঁচে থাকার এবং প্রতিদিনের ক্ষুদ্র সৌন্দর্যগুলো উপভোগ করার গুরুত্ব শেখায়।

      আমি কি তার আভাস পেয়েছি? আমরা কি সবাই তার আভাস পাই না? “কূলহারা কোন্‌ রসের সরোবরে / মূলহারা ফুল ভাসে জলের 'পরে। / হাতের ধরা ধরতে গেলে   ঢেউ দিয়ে তায় দিই যে ঠেলে-- / আপন-মনে স্থির হয়ে রই, করি নে চুরি। / ধরা দেওয়ার ধন সে তো নয়, অরূপ মাধুরী॥” রবীন্দ্রনাথ, গীতবিতান, প্রেম, ৩১৯

      রবীন্দ্রনাথও ঠিক এই কথাটাই আমাদের শেখাতে চেয়েছিলেন। আমরা নিতে পারি নি সে কথা স্বতন্ত্র। কিন্তু তার লেখনীর পাতায় পাতায় এই ছেড়ে যাওয়ার উদাসীনতা আমায় টেনে টেনে নিয়ে যায় সেই নদীর পাড়ে, যেখানে বসে আমার অপেক্ষা, কখন এক অনিন্দ্য সন্ধ্যায় আমার জন্যে নৌকা আসবে।

      আমি অপেক্ষায় আছি।

      আরেকটা দারুন ব্যাপার এই উপন্যাসে পেয়েছি, তানাবাতা উৎসব। উৎসবের পেছনের গল্পটা আগে বলে নিই, “গল্পটি মূলত দুই তারকা, ওরিহিমে (বুননের রাজকুমারী) এবং হিকোবোশি (গরু পালক), বা ‘ভেগা’ এবং ‘অল্টেয়ার’ তারকাকে নিয়ে। ওরিহিমে দক্ষ বুননের জন্য বিখ্যাত ছিলেন, আর হিকোবোশি ছিলেন গরু পালক। পরস্পরের প্রেমে মগ্ন হয়ে, তারা নিজেদের কাজ উপেক্ষা করে। শাস্তিস্বরূপ দেবরাজ ওরিহিমের বাবা তাদের আলাদা করে দেন, ‘মিল্কি ওয়ে’ বা ‘আকাশগঙ্গা’র দুই প্রান্তে তাদের স্থান দেন। তবে, তাদের প্রেমে অভিভূত হয়ে দেবরাজ বছরে একবার, ৭ই জুলাই, তাদের মিলনের সুযোগ দেন, যদি আবহাওয়া অনুকূল থাকে এবং আকাশ পরিষ্কার থাকে।” তানাবাতা উৎসবে লোকজন তাদের ইচ্ছা ও প্রার্থনাগুলো রঙিন কাগজের টুকরোয় (যাকে ‘তানযাকু’ বলা হয়) লিখে বাঁশের ডালে ঝুলিয়ে রাখে। এই ইচ্ছাগুলো বিভিন্ন বিষয়ে হতে পারে শিক্ষা, সম্পর্ক, স্বাস্থ্য, সাফল্য ইত্যাদি। তারা মনে করে, আকাশের তারারা তাদের প্রার্থনাগুলো পূরণ করবে।

      খুব মজার না?

      তাকাশি হিরাইডের এই লেখা আমার মনে যে খুব একটা প্রভাব ফেলে তা নয়। অনুবাদের কারনে, না কি গল্পের প্রেজেন্টেশানের জন্য, তবে মনো নো আওয়ারে আমাকে, বিশেষ করে, আবার ভাবতে বাধ্য করে, নিজের দিকে ফিরে আসতে বলে। সে বলে, দূরে বহুদূরে / গাইছে বাউল একতারায় / মন পাখী তুই ঘরছাড়া / এবার ঘরে আয়…

==============

দ্য গেস্ট ক্যাট

তাকাশি হিরাইড

অনুবাদকঃ নিজাম উদ্দিন অপু

বেনজিন প্রকাশন

মুদ্রিত মূল্যঃ ২০০ টাকা

ছবি কৃতজ্ঞতাঃ ইন্টারনেট

Comments

Popular posts from this blog

যে বুকে আগুন জ্বলে

শারদীয়া আনন্দবাজার পত্রিকা সম্পর্কে

জেরক্স কপির উন্নত ভার্সানে ‘আবার প্রলয়’ এসেছে