One Hundred Years In Solitude

 


বিভূতিভূষণের ‘পথের পাঁচালী’ কিম্বা সত্যজিৎ রায়ের ‘অপু ট্রিলজি’, Ryūnosuke Akutagawa-র ‘রসোমন’ কিম্বা Akira Kurosawa-র ‘রসোমন’। সাহিত্যের হাত সিনেমা ধরেছে অনেকবার, সিনেমা ‘কাল্ট’ আখ্যা পেয়েছে। ক্লাসিক সাহিত্যকে সিনেমায় প্রকাশ করার সুবিধা এই, সাহিত্য নিজেই সিনেমার ৮৫ শতাংশ কাজ করে দেয়। বাকি থাকে একটা নিখুঁত চিত্রনাট্য। সংবেদনশীল অভিনয়।

      গন্ডগোলটা কি হয় জানেন? যদি সিনেমা সাহিত্যের সেই এসেন্সটাকে ধরতে ব্যর্থ হয়। আবার অনেক সময় উল্টোটাও ঘটে। অতি সাদামাটা একটা সাহিত্য সিনেমার হাত ধরে ‘কাল্ট’ হয়ে গেছে, এমন উদাহরন খুব একটা কম নয়।

      One Hundred Years In Solitude-এর সমস্যা কিন্তু ভয়ঙ্কর। একে বইটা শুধু তার জন্মলগ্ন থেকেই ‘ক্লাসিক’ নয়, ‘কাল্ট’ নয়, রীতিমতো বাইবেলের পরেই সর্বাধিক বিক্রীত বই; তার ওপর ‘পাটা’ কোন গল্প নয়, স্তরের পর স্তর এক-একবার পড়লে আবিস্কার করা যায়; সেই সাথে ম্যাজিক রিয়েলিজমের এমন এক চূড়ান্ত উদাহরণ সারা বিশ্ব সাহিত্যে হাতে গোনা আছে; এমনকি স্বয়ং লেখকের সন্দেহ ছিল, এই উপন্যাসকে সার্থক সিনেমায় রূপান্তরিত আদৌ করা সম্ভব কি না।

      কিন্তু সিনেমার ক্ষমতা, বিশেষত টেকনিকাল ক্ষমতা এই সময়ে, এক অনন্য সাধারণ পর্যায়ে পৌছে গেছে। যখন সারা মাকোন্দো জুড়ে ফুলের বৃষ্টিপাত হয়, সেই ফুলের মধ্যে দিয়ে José Arcadio Buendía-র দেহ নিয়ে যাওয়া হয় সেমেটারিতে, মনে হয় না তা অবিশ্বাস্য; কিম্বা José Arcadio-র দরজা থেকে রক্তের একটা সরু স্রোত একটু একটু করে এগিয়ে এসে Úrsula Iguarán-র পায়ের কাছে এসে থেমে যায়, যেন শেষ বিদায় চায়, বুঝতেই পারি না, মাকোন্দো কখন মার্কেজের রূপক থেকে ক্যামেরার ফ্রেমের বাস্তবে ধরা দিয়েছে। সিনেমায় এখন এটা সম্ভব।

      বাকী রইল ‘এসেন্স’। একই অনুভূতিকে দুটো ভিন্ন মাত্রার শিল্পের মধ্যে দিয়ে প্রকাশ করার মধ্যে এই একটাই জিনিস, আমার মনে হয়, কাজ করে। সেটা যদি অনুপস্থিত থাকে, তাহলে ‘Based On’ শব্দটার কোন মানে থাকে কি? Alex García López-এর One Hundred Years In Solitude সেক্ষেত্রে সসন্মানে উত্তীর্ণ হয়ে গেছে।

      এই সিরিজের অনেক আগে আমি বইটা পড়ে ফেলেছি। Gabriel García Márquez-এর মৃত্যুর পরে পরেই আমার হাতে আসে তরুণ ঘটকের অনুবাদ। পড়তে পড়তে পদে পদে ঠেক খেয়েছি। বয়স আর লেখনীভঙ্গিমা আমার ক্ষেত্রে বাধ সেধেছে। তবুও, শেষ করেছি। মিশ্র প্রতিক্রিয়া হয়েছে। কিন্তু ভুলতে পারি নি। গল্পের কিছু কিছু দৃশ্য আমাকে এখনও তাড়া করে বেড়ায়। তার কারণ একটাই, সার্থক ক্লাসিক সাহিত্য একজন মানুষের মনে, এমনকি বালিকা হৃদয়ে, ছাপ রেখে যেতে বাধ্য। ঠিক সেই জায়গাতেই Márquez সার্থক।

      এই ওয়েব সিরিজটা আমাকে সেই জায়গা থেকে একধাপ এগিয়ে নিয়ে গেল। বয়স বেড়েছে, উপন্যাসের মধ্যেকার পরিবারের জটিল কাঠামো না ছাড়িয়ে এ উপন্যাসের চিত্রগ্রহণ করা সম্ভবপর ছিল না। ফলে সেই স্পষ্টতা আমাকে অনেকটা সাহায্য করেছে। এর সাথে, এই কয়েক বছরে, আমি কলম্বিয়া কিম্বা লাতিন আমেরিকার ইতিহাসের সাথেও একটু একটু পরিচিত হতে পেরেছি। Márquez-এর জীবনের অনেক ঘটনার সাথে পরিচিত হয়েছি। ফলে এইবার, ইতিহাসেও আমি খানিকটা আলোকপ্রাপ্তা হয়ে দেখতে বসেছিলাম। সিনেমায় সমান্তরালে এই সমস্ত কিছুই এত নিখুঁতভাবে দেখানো হয়েছে যে, আমার কাছে মাকোন্দো জীবন্ত।

      কতটা নিখুঁত? একটা উদাহরনই যথেষ্ট। এই উপন্যাসটার চিত্ররূপ দিয়েছেন পাঁচজন মিলে! José Rivera, Natalia Santa, Camila Brugés, Albatrós González এবং María Camila Arias, পাঁচমাথা এক হয়ে একটা চিত্রনাট্য দিতে পেরেছে মানে, বোঝাই যায়, এর পিছনে কি বিপুল পরিমাণে পরিশ্রম আছে।

      অভিনয় নিয়ে বলার কিছুই নেই। আমার মনে হয়েছে, প্রত্যেকেই, বই থেকে উঠে এসেছে। যখন উপন্যাসটা পড়েছিলাম, মনে আছে, Úrsula Iguarán-চরিত্রটা আমার মনে ছাপ ফেলেছিল সবচেয়ে বেশি। তাকে যেন মনে হয়ছিল, মহাভারতের ভীষ্ম পিতামহের মতন। সমস্ত উত্থান-পতন তাকে নিজের চোখে দেখে যেতে হয়েছিল, একেবারে শেষ পর্যন্ত। অথচ, মাকোন্দোর সৃষ্টি ও স্থিতিতে তার অবদান সবচেয়ে বেশি। অবদান নীরব বলেই আরোও বেদনাবহ হয়ে ওঠে চরিত্রটা।

      Úrsula-র এই চরিত্রে Marleyda Soto-র দানবিক অভিনয় কিম্বা তরুণী Susana Morales Cañas-এর অবিশ্বাস্য অভিনয়, কোনটাকেই ফেলে দেওয়া যায় না। প্রথম দৃশ্য থেকেই আমাকে মুগ্ধ করে রাখে। জীবনের পরতে পরতে ঘটনা পরম্পরায় Úrsula যেভাবে পরিণত হয়, দুজনের অভিনয়ে তা এত সাঙ্ঘাতিকভাবে দেখতে পাই যে, আমি কোন ভাষা খুঁজে পাই না। আরেকটা চরিত্র, সম্ভবত মেঘে ঢাকা থাকবে। তা হল Loren Sofía-র Amaranta। বিষাক্ত শীতল হৃদয় যে কি তীব্রতায় চারপাশটা ধ্বংস করে তা চোখে-মুখে-দেহবিভঙ্গিমায় এমন শিউরে ওঠা অভিনয় করা যায়, ভাবতে পারি না। Loren Sofía-র অভিনয় ঢেকে যাবে Diego Vásquez, Marco Antonio González Ospina, Akima, Janer Villarreal এর পাশে।

      Claudio Cataño এই সিরিজের সবচেয়ে বর্ণময় চরিত্র। এবং তা একদম যথাযথ। তার অভিনয় নিয়ে আলোচনা হবে প্রচুর। আমি তার কথায় যাব না। আমি আরেকজনের কথায় আসব, Viña Machado। উপন্যাসে Pilar Ternera চরিত্র আসলেই সবচেয়ে দুর্ভাগিনীর চরিত্র। মাকোন্দো-র জনপদবধূ Buendía পরিবারের অন্যতম ধারক ও বাহক, কিন্তু, সমাজে সে পরিত্যক্ত। শুধু পরিত্যক্তই নয়, তার সন্তানেরা জানেও না, তাদের আসল মা কে। অথচ মা জানে! চোখের সামনে তাদের বড়ো হতে দেখে। কিন্তু তাদের ধরাছোঁয়ার উপায় নেই। সেই যন্ত্রণাকেও পেরিয়ে গিয়ে তারই সন্তান Arcadio যখন একসময় তার কাছে আসে, তার সেই অসহায়তা বুকের মধ্যে মোচড় দিয়ে যায়; আবার, এই Pilar Ternera-ই এক সময় বন্দুকের মুখের সামনে গর্জে ওঠে, যখন সারা মাকোন্দো বন্দুকের ভয়ে চুপ; আবার এই Pilar Ternera-ই একমাত্র চরিত্র, যে ভবিষ্যৎ দেখতে পায়, সে জ্যোতিষী। সে জানে কি ঘটতে চলেছে। সে মাকোন্দোর উত্থান পতনের দ্রষ্টা। একটা চরিত্রের এতগুলো স্তরকে একটা মানুষের মধ্যে ফুটিয়ে তোলা কি কঠিন ব্যাপার, না?

      সব মিলিয়ে এই সিরিজের গভীরতা কোন পর্যায়ের? আমি একটা উদাহরণ দিয়ে বুঝিয়ে দিই? আট পর্বের এই সিজনটার আমি একবারে পর পর দুটো পর্ব দেখতে পারি নি। আট দিনে আটটা পর্ব শেষ করেছি। এই সিরিজের এক-একটা পর্বের ইমপ্যাক্ট এমনই, যে একটু ধাতস্থ না হয়ে পরের পর্বে যাওয়া যায় না।

      এখন আমি পরের সিজনের অপেক্ষায়…

====================

One Hundred Years In Solitude

Directed by: Alex García López

Cast: Claudio Cataño, Diego Vásquez, Marleyda Soto, Viña Machado, Loren Sofía, Janer Villarreal, Akima, Moreno Borja, Ruggero Pasquarelli

OTT: NETFLIX

Comments

Popular posts from this blog

যে বুকে আগুন জ্বলে

শারদীয়া আনন্দবাজার পত্রিকা সম্পর্কে

জেরক্স কপির উন্নত ভার্সানে ‘আবার প্রলয়’ এসেছে