দ্য মাস্টার অফ গো

 


এই বই পাঠের মুহূর্তে, খেলার উন্মাদনায়, একটা প্রশ্ন উঠে আসে। খেলাটা কি একটা শিল্প, সত্যিই?

      যারা খেলার হার-জিতটাকেই প্রাধান্য দেয়, তাদের যতজনাই বলুক না কেন, সে দর্শক হোন কিম্বা খেলোয়াড়, মনে মনে তারা শিল্পানুগামী নন। আমাদের প্রতিবেশী দেশদুটিকে ক্রিকেট খেলা নিয়ে মারাত্মক রকমের আগ্রাসনের কথা মাথায় রাখলে আমার কথাটা পরিস্কার হয়ে যাবে।

      এখন, যারা এটাকে শিল্প বলে মানেন, তারা পরিস্কার জানেন, খেলায় হার-জিতটা বড়ো কথা নয়। ও চলতেই থাকবে। বড়ো কথা তুমি খেলাটা কিভাবে খেলছ। খেলাটাকে কতটা এনজয় করছ। সেখানেই খেলার সার্থকতা।

      যারা এই পন্থায় বিশ্বাস করেন, অত্যন্ত দুঃখের সাথেই বলতে হচ্ছে, তাদের বেশিরভাগই একটু পুরোনোপন্থী। অর্থাৎ কি না, তারা বলেন, আগেকার দিনে খেলার একটা স্পিরিট থাকত, এখন আর তা মানা হয় না। এখনকার দিনে জয়টাই শেষ কথা বলে।

      ঠিক এই বিতর্ক থেকেই কাওয়াবাতার এই উপন্যাস, ‘দ্য মাস্টার অফ গো’-র নির্মাণ

      এই উপন্যাস পড়তে হলে ‘গো গেম’ সম্পর্কে একটা সম্যক ধারনা থাকা দরকার। ইউটিউব আমাকে পর্যাপ্ত সহায়তা করেছে। না হলে ১৯ × ১৯ বোর্ডের এই খেলাটিতে ঠিক যে কি হচ্ছে, আর কেনই বা কোন একটা চালের জন্যে আমি উত্তেজিত হব, বুঝতে পারব না। চীন থেকে আমদানীকৃত এই খেলাটা জাপানে খুব জনপ্রিয় খেলা। এই খেলার একটাই লক্ষ্য, একটা নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে অপরের থেকে নিজের এলাকার পরিমান বাড়ানো। এই খেলায় এক-একটা চাল এক-এক সময়ে এতটাই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে যায় যে, একটি চালের পেছনে অনেকক্ষণ, কখনও কখনও কয়েক ঘন্টাও লেগে যায়।

      এই উপন্যাস ১৯৩৮ সালের একটি গো গেম-কে কেন্দ্র করে লেখা। সত্যি ঘটনা। সেই সময়ে কাওয়াবাতা ছিলেন সাংবাদিক। প্রায় দেড় বছর ধরে, হ্যাঁ হ্যাঁ, দেড় বছর ধরেই, একটি গো গেম চলেছিল তখনকার মাস্টার হনিনবো সুজাই এবং তার চ্যালেঞ্জার কিতানি মিনোরুর মধ্যে। সেই খেলা ‘কভার’ করার দায়িত্বে ছিলেন সাংবাদিক কাওয়াবাতা। তিনিই পরে এই খেলাটাকে, পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে লেখেন, ঘটনাপরম্পরায়, ১৯৫১ সালে।

      এমনকি বোর্ডের চালগুলোকেও ছবির মতো করে পাতার পর পাতা ধরে আছে। যাতে পাঠক সময়ের সাথে সাথে খেলাটার জটিলতা, সৌন্দর্য এবং মাধুর্যের ব্যাপারটা বুঝতে পারেন। ফলে খেলাটার সম্পর্কে, আবার বলছি, প্রাথমিক ধারনা থাকাটা অবশ্যই জরুরী।

      দিনের শেষে এই উপন্যাসটা লেখার উদ্দেশ্য কিন্তু ঐ একটাই। ‘গেম অফ স্পিরিট’ বলে যে কথাটা আছে, যা আবহমানকাল ধরে একটা খেলাকে শিল্পের পর্যায়ে উত্তীর্ণ করেছে, সেটাই কি বিপন্ন? মাস্টার খেলাটাকে খেলতে চায়, চ্যালেঞ্জার খেলাটাকে জিততে চায়। এর মারাত্মক দ্বন্দ্বের উত্তর কি?

      ‘ট্রাডিশান’ এবং ‘মডার্নিটি’-র এই দ্বন্দ্বটি আমাকে সবচেয়ে বেশি ভাবায়। ক্রিকেটে দেখছি T20 এবং T10 এর আবির্ভাব হয়েছে। শুধু তাই নয়, খেলাতে খেলোয়াড় নামছে খেলতে নয়, জিততে। জেতার উন্মাদনা খেলার অ্যাড্রিনালিন স্রোতটাকে আটকাতে পারছে না। খেলোয়াড় এবং দর্শক – কি মারাত্মকভাবে উন্মত্ত হয়ে পড়ছে! এই উন্মত্ততার একটা বড়ো উদাহরণ ভারত ও পকিস্থান, ইংল্যান্ড ও অস্ট্রেলিয়া।

      উন্মাদনার কারনে খেলায় ন্যায়-অন্যায় অনেক সময়েই নীতিমালার বাঁধ মানে না। ফলে কয়েক দশক আগের নিয়মমালা আজ আর এক নেই। তার মধ্যেও অনেক পরিবর্তন আনতে হয়েছে। যদি সত্যি খেলাটা খেলা হিসাবেই রয়ে যেত তাহলে কি নিয়মের ব্যাপক পরিবর্তনের প্রয়োজন ছিল? কাওয়াবাতার লেখায় এই প্রশ্নটা উঠে আসে।

      অনেক নীতি আমরা উল্লঙ্ঘন করি না। গেম স্পিরিটের জন্যেই করি না। নীতিমালায় আছে জেনেও করি না চট্‌ করে, কিম্বা বলা ভাল, করিই না। উদাহরন হিসাবে ‘মানকড’ নিয়মের কথাই ধরা যাক না। অনেক দিন ধরেই তো এই নিয়ম আছে। রবিচন্দ্র অশ্বিন কিম্বা দীপ্তি শর্মা যেভাবে খেলাটাকে নিজেদের আয়ত্তে আনার জন্য বা বলা ভাল, জেতার জন্য এই কাজটি ঘটালেন, সারা বিশ্ব জুড়ে ছিছিকার হলেও, আমরা জানি, তা নিয়মের মধ্যেই আছে। কিন্তু এমন অনেক উদাহরন আছে, যেখানে ‘গেম অফ স্পিরিট’-টাকে বজায় রাখার জন্য, সুযোগ পেয়েও প্রতিপক্ষকে আউট করে নি, কিম্বা, অন্তত এক-আধবার ব্যাটসম্যানকে বোলার সতর্ক করছেন।

      এমন আরেকটা উদাহরণ একদিবসীয় বিশ্বকাপ ক্রিকেটে শ্রীলঙ্কার অ্যাঞ্জেলো ম্যাথিউসের সেই মারাত্মক টাইম আউট! বাংলাদেশকে প্রয়োজনীয় জয় আনিয়ে দেয় বটে, কিন্তু, তা নীতিবহির্ভূত না হওয়া সত্ত্বেও গেম অফ স্পিরিটের ভাবাবেগকে আহত করে।

      আমি এই উপন্যাসের গো গেমের মধ্যেকার গেম অফ স্পিরিটের উল্লঙ্ঘনকে জেনেবুঝেই আলোচনায় আনছি না, কারন, আমি ধরে নিচ্ছি, এ লেখার সিংহভাগ পাঠক ‘গো গেম’ জানেন না বলে আলোচনায় এলে সম্যক উপলব্ধি করতে পারবেন না।

      কাওয়াবাতা ঠিক এই জায়গাটাতেই মারাত্মক প্রশ্নটি এনেছেন। খেলার সৌন্দর্য অথবা জয় --- কোনটা বেশি জরুরী? এবং, ঠিক এখান থেকেই মর্ডান মেন্টালিটির দিকে একটা সূচ্যাগ্র তীর ছুরে দেন তিনি।

      তবে, কাওয়াবাতা, শুধু এইটুকুমাত্রেই সীমাবদ্ধ থাকেন নি। বিষয়টাকে আরেকটু বড়ো আঙ্গিকে দেখলে অন্যান্য ক্ষেত্রেও তো এই বিতর্ক থেকেই যায়। আধুনিকতা কি আমাদের এগিয়ে দিচ্ছে, না কি কোথাও অনেক পিছিয়ে দিচ্ছে?

      ‘মনুষ্যত্ববোধ’ এই প্রশ্নতার মাপকাঠি। আমরা কি আধুনিকতার নামে মনুষ্যত্বকেই জলাঞ্জলী দিচ্ছি? না কি মনুষ্যত্ববোধের সংজ্ঞাটাই পালটে গেছে সময়ের সাথে সাথে?

      ‘লিগ্যাসি’ আর ‘মরালিটি’ কোথাও যেন ‘মনুষ্যত্ব’ নামক বৈশিষ্ট্যটির মাপকাঠি নির্নায়ক হয়ে দাঁড়াচ্ছে। যেখানে Dignity এবং Value Of Life একটা বড়ো প্রশ্নচিহ্নের সামনে এসে দাঁড়াচ্ছে। আমি আসলেই কি চাইছি আমার জীবনে? আমি আসলেই কি হতে চাই, বা পেতে চাই? জয়, না সার্থকতা? এর উত্তর এককথায় দেওয়া এখন অনেক কঠিন ব্যাপার। বিশ্বযুদ্ধোত্তর জাপানে কাওয়াবাতা দেখতে পারছিলেন, কিভাবে পাশ্চাত্য উন্মাদনা জাপানকে গ্রাস করছে। তার বহমানতা জাপানের চিরায়ত চেতনাপ্রবাহকে শুধু প্রশ্নই করছে না, কোথাও যেন জনপ্রিয়তার মাপকাঠিতে অনেক পেছনেও ফেলে দিচ্ছে। সেই জায়গায় দাঁড়িয়ে এই খেলাকে কেন্দ্র করে একটা ঘটনা কাওয়াবাতার শুধু মাস্টারস্ট্রোকই নয়, জাপানী জনজীবনের পরিপ্রেক্ষিতে একটা বড়ো প্রশ্ন, যা কোন না কোন সময়ে, কখন না কখনও সকল দেশেই এসে ধাক্কা মেরেছে।

      কাওয়াবাতা ঠিক এই জায়গাটাতেই আবার প্রশ্ন রাখেন, মাধুর্য বড়ো কথা, না জয়ী হওয়া?

===============

The Master Of Go

Yasunari Kwabata

Translated By: Edward G. Seidensticker

Vintage International

Printed Price: 625/-

ছবি কৃতজ্ঞতাঃ সমর্পিতা

       

Comments

Popular posts from this blog

যে বুকে আগুন জ্বলে

শারদীয়া আনন্দবাজার পত্রিকা সম্পর্কে

জেরক্স কপির উন্নত ভার্সানে ‘আবার প্রলয়’ এসেছে