ইয়াসুনারি কাওয়াবাতার গল্প

 


ব্লার্বে দেখছি লেখা আছে, “বিংশ শতাব্দীর বিশের দশকে লেখা প্রথম ছোটোগল্পর সময় থেকে তাঁর মৃত্যুর সময় অব্দি প্রকাশিত গল্পগুলিকে ইয়াসুনারি কাওয়াবাতা ‘তানাগোকোরো নো সোসেতসু’ বলতেন যার অর্থ হল এমন সব গল্প যা তাদের আয়তনের কারণে হাতের তালুর মধ্যে চলে আসতে পারে। কাওয়াবাতার এই হাইকু-সুলভ রচনাশৈলীতে ভাবনার গভীরতা, সূক্ষ্ম-ইশারা বা ইঙ্গিত, মানুষের হৃদয়ের মধ্যেকার অস্থিরতা, তার উপলব্ধি এবং রূপান্তর ধরা দেয়। ধরা দেয় সেইসব মানুষ যাদের কাছে বিচারবুদ্ধির থেকে অনেক সময় অনুভূতি বা কোনও একটি মুহূর্তের উষ্ণতা বেশি প্রাধান্য পায়।

      আমাদের পাঠকদের, মূলত যারা, একটু গভীরে গিয়ে গল্পগুলোকে পাঠাভ্যাস করতে চায়, তাদের সমস্যা শুরু হয় ঠিক এইখান থেকেই। কাওয়াবাতা-র লেখা ছোটগল্পের বই কিন্তু একটা নয়, একাধিক। এর মধ্যে কোন গল্প থেকে কোন গল্পের অনুবাদ হয়েছে, তার কোন নির্দেশিকা নেই। ফলে আমাদের পক্ষে জানার উপায় নেই সে, এই গল্পগুলো পড়ার পর, যাকে বলে, Further Reading, সেটারও কোন বোধগম্যতা নেই, অন্তত এই বই থেকে।

      এই ধরনের বইগুলো আগে আমার কাছে বেশ লাগত। মনে হত, অন্তত অনুবাদ তো হচ্ছে, তাই বা কম কি? কিন্তু আজকাল আমার কাছে হতাশা নিয়ে আসে। তার কারন, আমি এখন কোন লেখকের মানসিকতাটিকে একটু গভীরে গিয়ে অনুভব করতে চাইছি। তাকে পুঙ্খানুপুঙ্খ বুঝতে চাইছি। সেই উপায় বন্ধ। আমি ইংরাজী অনুবাদগুলো নামাই, কিন্তু বোঝার কোন উপায় থাকে না যে, কোন গল্পগুলো আমি পড়ে ফেললাম আমারই মাতৃভাষায়। আমাকে বুঝতে হলে, সমস্ত গল্পগুলো পরে পড়ে বুঝতে হবে।

      কাওয়াবাতাকে নিয়ে পরপর অনেকগুলো লেখা আমি লিখে ফেলেছি। ফলে কাওয়াবাতার লেখার বৈশিষ্ট্য নিয়ে নতুন করে কিছু বলার নেই। যারা উপন্যাস পড়তে অনিচ্ছুক তারা এই ছোট গল্পগুলোতে চোখ বোলাতে পারেন, কাওয়াবাতার ছোটগল্প কাওয়াবাতার নিত্যচিন্তার ফসল। সেই ফসলে এক-একজন চরিত্র এক-একজন ভাব হয়ে ওঠে।

      কাওয়াবাতার গল্প যদি কেউ হঠাৎ করে পড়তে চান, তাহলে হয়তো একটু অন্যরকম লাগতে পারে। ভালো না লাগতেও পারে। আমার মতে, জাপানী সাহিত্যের ঘরানাটা একটু অন্যরকম। আমাদের সাহিত্যে যেহেতু পাশ্চাত্যের প্রভাব অনেক বেশি, সেই কারনে এই ধরনের ‘মিনিমালিস্ট’ লেখার মধ্যে সেই রকমের আনন্দ নাও পেতে পারেন। আর তার সাথে যুক্ত হচ্ছে, সেই সময়ের জাপানী সংস্কৃতি, যা জাপানী সমাজের আয়না, বিশেষত বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তী প্রভাব কাওয়াবাতার গল্পে খুব পাওয়া যায়, এই ছোটগল্পগুলোতেও আছে।

      একাকীত্ব আর পরিবর্তনশীলতা, আমরা জাপানী সাহিত্যে খুব দেখতে পাই। কাওয়াবাতার গল্পেও সেটা আছে। ভাল পরিমানেই আছে। ফলে সেই জায়গা থেকে বিচার করাটা খুব জরুরী।

      অনুবাদ কেমন? আমার মোটামুটি লেগেছে। কেন জানি না, অন্যান্য আর আর অনুবাদের স্বাপেক্ষে আমি এই অনুবাদগুলোর সাথে তেমন করে যুক্ত হতে পারি নি। হয়তো আমার ব্যর্থতা, হয়তো সব অনুবাদ সত্যি অর্থেই সার্থক হয়ে উঠতে পারে নি। হয়তো বিচ্ছিন্নভাবে গল্পগুলো পড়ার দরুন অনুবাদগুলোর সাথে তেমন করে সম্পর্ক গড়ে তুলতে পারি নি। আসলে, উপন্যাস পড়ার সময়ে যেভাবে আমি ‘ফুটনোট’ পেয়েছি, সেভাবে ফুটনোট থাকলে এতটা অসুবিধা হত না।

      কাওয়াবাতা আমার কাছে একটা অভিজ্ঞতা। যারা হারুকি মুরাকামিকে নিয়ে নাচানাচি করেন, তাদের অবশ্যই জাপানী সাহিত্যের দিকে মুখ ঘোরাতে বললে, হয়তো ক্লাসিক সাহিত্যের ক্ষেত্রে, ঘোল খাবেন। সেখানে জাপানকে জানতে জানতে এগোতে হবে। এগোতে থাকলে এক সময় দেখা যাবে, তারা আমাদের মতোই মানুষ, আনন্দে হাসে, দুঃখে কাঁদে। কিন্তু সেই হাসি-কান্নার মধ্যেও একটা এমন কিছু আছে যা বিশ্বাত্মার সাথে আমাদের যুক্ত করে।

      সেই বিশ্বাত্মার জন্য আমার প্রাণ কাঁদতে চায়। কাওয়াবাতা কেঁদেছিলেন। আর কেঁদেছিলেন বলেই আমাদের কাঁদাতে পেরেছিলেন।

      সবশেষে কাওয়াবাতা সম্পর্কে আরেকবার ছোট্ট ইন্ট্রো দিয়ে শেষ করতে মন চাইছে। এই বইয়ের ব্লার্বে যেটা লেখা আছে, সেটাই সবার জন্যে তুলে দিলাম ---

ইয়াসুনারি কাওয়াবাতা (১৮৯৯ খ্রি: - ১৯৭২ খ্রি:) জাপানি ঔপন্যাসিক এবং ছোটোগল্পকার। কাব্যিক, সূক্ষ্ম অনুভূতিসম্পন্ন উপন্যাস ও গল্পের জন্য প্রসিদ্ধ কাওয়াবাতা ১৯৬৮ সালে সাহিত্যের জন্য নোবেল পুরস্কার পান। ঔপন্যাসিক হিসেবে বেশি পরিচিতি পেলেও কাওয়াবাতা বিশ্বাস করতেন তাঁর সেরা লেখাগুলো আদতে আকারে মাঝারি অথবা ছোটো৷ কাওয়াবাতা সারা জীবন ভিন্ন ভিন্ন ফর্ম ও শৈলী নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে গেলেও কোনোরকম তকমার তলায় নিজের লেখাকে ফেলতে চাইতেন না। তার গদ্যে বর্ণিত ছোটো ছোটো ঘটনা আর কাহিনির ভেতরে না বলা কথারা এসে ধরা দেয়। সমালোচকদের মতে এইটাই তার গদ্যের মূল বৈশিষ্ট্য।

======================

ইয়াসুনারি কাওয়াবাতার গল্প

সম্পাদনাঃ গৌতম চক্রবর্তী

আপনপাঠ পাবলিকেশান

মুদ্রিত মূল্যঃ ২১৫/-

ছবি কৃতজ্ঞতাঃ সমর্পিতা

Comments

Popular posts from this blog

যে বুকে আগুন জ্বলে

শারদীয়া আনন্দবাজার পত্রিকা সম্পর্কে

জেরক্স কপির উন্নত ভার্সানে ‘আবার প্রলয়’ এসেছে