স্বর্ণমন্দির
৪ জুলাই, ১৯৫০ সাল। কিয়োটো শহর, জাপান।
কিঙ্কাকুজি স্বর্ণমন্দির। সন্ন্যাসী হায়াশি ইয়োকানজি।
ইতিহাস বড়ো অদ্ভুত। মানুষের এমন অনেক
কাজের সাক্ষী সে, যা আপামর একটি মানব সমাজে গভীর প্রভাব ফেলে। ইউকিও মিশিমার ক্ষেত্রেও
তাই হয়েছিল। কারন ঐ দিন ঐ মন্দিরটা ঐ সন্ন্যাসী পুড়িয়ে দিয়েছিল। হায়াশি নিজে স্বীকার
করে, মন্দিরের অতুলনীয় সৌন্দর্যের প্রতি তার মুগ্ধতা এবং এই সৌন্দর্য ধরে রাখার মধ্যে
তার নিজের অক্ষমতা তার ভেতরে এক তুমুল মানসিক দ্বন্দ্ব তৈরি করেছিল। সে মন্দিরের নিখুঁত
সৌন্দর্যকে একধরনের বোঝা হিসেবে দেখতে শুরু করেছিল এবং মনে করত যে ধ্বংসের মাধ্যমেই
একমাত্র তার এই যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব।
সৌন্দর্য আর ধ্বংস --- কারোর মনে কেন
সমপর্যায়ে আসে? আমরা তাকে বলি বিকৃতমনস্ক। কারন, শুধুমাত্র একটা সৌন্দর্যই নয়, যে কোন
সৌন্দর্যকেই সে ক্ষতবিক্ষত কিম্বা ধ্বংস করতে চায়। তার সাধারণ কাজে, সম্পর্কে এমনকি
*ন*তা*য়ও। সে সেইসব অন্ধকারকে আপন করে পেতে চায়। তার আশেপাশের মানুষজনের থেকে সরে এসে
নিজেকে অন্য ‘এক মানুষ’ বলে ভাবে। এবং সেই অন্য মনুষ্যত্ব তাকে দিয়ে অন্য এক পৃথিবী
তৈরী করিয়ে নিতে চায়, যা আপামর মানবসমাজের জন্য মঙ্গলের নয়। যে চরিত্রের মধ্যে দিয়ে
এই প্রতিফলন ঘটেছে তার নাম মিজোগুচি।
মিশিমার এই ‘স্বর্ণমন্দির’
উপন্যাসটা পড়তে পড়তে আমি আশ্চর্য হয়ে যাচ্ছিলাম। আর কি সুন্দর অনুবাদ! অভিজিৎ মুখার্জির
অনুবাদ এতটাই সাবলীল যে, বিশেষ্যগুলোকে পাল্টে দিলে তা বাংলা উপন্যাসে পরিগণিত হতে
বাধ্য। একেই কি বলে সার্থক অনুবাদ? তিনি শুধু অসাধারণ অনুবাদ করলেন, তাই নয়, ইউকিও
মিশিমা পড়ার জন্যে আমাকে উষ্কেও দিলেন। এই যে আমি এখন ‘কাওয়াবাতা পাঠিকা’ থেকে সরে
এসে এখন ‘মিশিমা পাঠিকা’ হতে চাইছি, এর এক ও একমাত্র কারণ অভিজিৎবাবু। অনুবাদ তো শুধু
করলেই হয় না। তার ‘এসেন্স’ ধরা চাই বৈ কি। আর তা বিদেশী হলে বিষয়টা অনেকটাই কঠিন হয়ে
যায়। সেই কঠিন পর্যায় কি অবলীলায় উতরে গেছেন অভিজিৎবাবু। আমাদের কাজটাও অনেক সহজ করে
দিয়েছেন। আমরাও তার হাত ধরে উতরে নিয়েছি এমন এক উপন্যাসকে। বইটা এক নিঃশ্বাসে পড়ে শেষ
করার মতন উপন্যাস। বছরের শেষ এমন একটা বই দিয়ে হল – ভাবতেই কি ভাল লাগছে।
উপন্যাসটা পড়তে পড়তে আমার মনে পড়ে
যাচ্ছিল ফিওদর দস্তয়েভস্কিকে। যদিও দুজনের তুলনা চলে না, কিন্তু, অন্তত এই উপন্যাসে
মিশিমা অন্ধকারের দিকে চোখ ফিরিয়েছেন, অন্ধকারে হাটার চেষ্টা করেছেন, এবং অন্ধকারেই
উপন্যাসটাকে শেষ করেছেন। তবে এই অন্ধকারটা শুধুমাত্র উক্ত ঘটনার অন্ধকারই নয়, উক্ত
ঘটনাকে কেন্দ্র করে জাপানের অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে উপন্যাসটা লিখেছেন।
জাপান এক সংকটের
মধ্যে এসে দাঁড়িয়েছিল সেই সময়। যুদ্ধ পরবর্তী পরাজিত জাপানী সমাজের এক সাঙ্ঘাতিক সংকট।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর জাপান একটি গভীর পরিচয় সংকটে ভুগছিল। যুদ্ধের পরাজয়, হিরোশিমা-নাগাসাকির
ধ্বংসযজ্ঞ, এবং মার্কিন দখলদারিত্ব জাপানের জনগণের আত্মসম্মান এবং ঐতিহ্যের প্রতি গভীর
প্রভাব ফেলেছিল। মিজোগুচির ধ্বংসাত্মক মানসিকতা এবং তার নিজস্ব দুর্বলতা থেকে মুক্তি
পাওয়ার জন্য মন্দির ধ্বংসের সিদ্ধান্ত একটি বৃহত্তর সামাজিক অস্থিরতার প্রতীক হয়ে দাঁড়ায়।
যুদ্ধ-পরবর্তী জাপানে নৈতিকতার ধারণা অনেকটাই বদলে গিয়েছিল। যারা কাওয়াবাতার The
Sound Of Mountain পড়েছেন তারা এটা আরও ভাল বুঝতে পারবেন। পশ্চিমা প্রভাবের কারণে ঐতিহ্যবাহী
জাপানি মূল্যবোধ এবং সামাজিক কাঠামো দুর্বল হয়ে পড়েছিল। এবং ধর্মের মধ্যে এক মারাত্মক
সংকীর্ণতা ও সেই সাথে আত্মিক দ্বন্দ্বে জাপান জেরবার। মিজোগুচির মতো চরিত্র এই নতুন
প্রেক্ষাপটে নৈতিক সংকটের প্রতিফলন।
এই মিজোগুচির চরিত্র
ঠিক কি ধরনের ডিসঅর্ডার নিয়ে আসে? বেশ কয়েকটা চিহ্নিত করা যায় ---
১। নিহিলিজম্
(Nihilism) - মিজোগুচির মনোভাব নিহিলিস্টিক। সে বিশ্বাস করে যে জীবনের কোনো অর্থ নেই
এবং সৌন্দর্য ধ্বংসযোগ্য। সে মন্দিরের সৌন্দর্যকে ধ্বংস করার মাধ্যমে জীবনের অর্থহীনতাকে
প্রমাণ করতে চায়।
২। ইনফেরিয়রিটি
কমপ্লেক্স (Inferiority Complex) – মিজোগুচি নিজে শারীরিকভাবে স্বাভাবিক নয়। সে তোতলা।
সে দেখতে কদাকার। ফলে নিজেকে শারীরিক এবং মানসিকভাবে অপর্যাপ্ত মনে করে। স্বর্ণমন্দিরের
মতো একটি নিখুঁত সৌন্দর্যের সামনে দাঁড়িয়ে তার নিজস্ব অপূর্ণতা আরও প্রকট হয়ে ওঠে।
ফলে নিজের মনের মধ্যে একটা জটিলতা তৈরী হয়। যদিও, গল্পে, আমরা দেখতে পাই এর শুরু ছোটবেলা
থেকে। তার মায়ের এমন এক কাজ যা তাকে এক রাত্রের মধ্যে পরিবর্তন করে দেয়।
৩। অবসেসিভ কমপালসিভ
ডিসঅর্ডার (OCD) - মিজোগুচি একটিমাত্র চিন্তায় আটকে পড়ে, মন্দির ধ্বংস করতে হবে, একসময়
এটাই তার মনকে নিয়ন্ত্রণ করে। সে মন্দিরের প্রতি অবসেসিভ হয়ে ওঠে এবং অবশেষে তাকে ধ্বংস
ছাড়া অন্য কোনো উপায় ভাবতে পারে না।
৪। থ্যানাটোস
(Thanatos) বা মৃত্যু-প্রবৃত্তি - ফ্রয়েডের তত্ত্ব অনুযায়ী, প্রতিটি মানুষের মধ্যে
দুটি মৌলিক প্রবৃত্তি কাজ করে: এরোস (Eros) বা জীবনপ্রবৃত্তি এবং থ্যানাটোস
(Thanatos) বা মৃত্যু-প্রবৃত্তি। মিজোগুচির ক্ষেত্রে থ্যানাটোস প্রবৃত্তি শক্তিশালী।
মন্দির ধ্বংসের মাধ্যমে সে নিজের মৃত্যু-প্রবৃত্তির একটি চূড়ান্ত প্রকাশ ঘটায়। এটি
তার নিজের অন্তর্দ্বন্দ্ব এবং মানসিক যন্ত্রণাকে চিরতরে নীরব করার একটি প্রচেষ্টা।
৫। কগনিটিভ ডিসোন্যান্স
(Cognitive Dissonance) - মিজোগুচি সৌন্দর্য এবং আত্মঘাতী প্রবৃত্তির মধ্যে একটি অভ্যন্তরীণ
দ্বন্দ্ব অনুভব করে। সে একদিকে স্বর্ণমন্দিরের নিখুঁত সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়, আবার অন্যদিকে
নিজেকে তা ধ্বংস করার জন্য বাধ্য মনে করে।
তবে অবাক লাগে
মিশিমার দক্ষতায়। শুধুমাত্র ভেতরের কারন তো শেষ কথা নয়। বাইরে থেকেও এর ইন্ধন কোন-না-কোনভাবে
আসে। বন্ধু কাশিওয়াগির নিহিলিস্ট মনোবৃত্তির তার এই কাজের বহিঃইন্ধন। কাশিওয়াগির চরিত্র
নির্মাণ এক অদ্ভুত নির্মাণ। কাশিওয়াগির মধ্যে যেন একটুকুও ভালত্বের ছিঁটেফোঁটা অবশিষ্টটুকুও
নেই। কাশিওয়াগি প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষে মিজোগুচিকে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দেয়। আর তাই, কাশিওয়াগির
চরিত্রের ইতিহাস নির্মান মিশিমার এক মারাত্মক নির্মাণ। মিশিমার নজর এড়ায় নি সেটা। আর
এড়ায়নি বলেই এক অন্ধকারে আর-এক অন্ধকার এসে মিশে যায়…
মন্দিরটি ১৯৫৫ সালে পুনর্নির্মাণ করা
হয় এবং বর্তমানে এটি ইউনেস্কোর বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থানের অংশ। মন্দিরের বর্তমান কাঠামো
সেই একই স্থাপত্য শৈলী ধরে রেখেছে যা ধ্বংস হওয়ার আগে ছিল, এবং এটি এখনো জাপানের অন্যতম
সুন্দর এবং জনপ্রিয় পর্যটন স্থান।
পরিশেষে মানুষ সৌন্দর্যের দিকেই তার
হাত বাড়িয়ে দেয়।
====================
স্বর্ণমন্দির
মিশিমা ইউকিও
অনুবাদকঃ অভিজিৎ মুখার্জি
যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় প্রকাশনা
মুদ্রিত মূল্যঃ ৩৫০/-
ছবি কৃতজ্ঞতাঃ ইন্টারনেট
Comments
Post a Comment