দ্য লেক
মানসিক
অসুস্থতা।
বর্তমানে
দাঁড়িয়ে অবশ্যই বড়ো বিষয়। কারণ, মানুষের মন যে কোন ধারায় কখন বয়ে যায়, তা ধরতে
পারা, অনেক সময়, সেই মানুষটির পক্ষেও অসম্ভব। তার একটা অতীত আছে, বর্তমান আছে,
কিন্তু ভবিষ্যৎ? ভবিষ্যৎ সেই মানুষটারই হাতে। শারীরিক অসুস্থতার ওষুধ আছে, মানসিক
রোগের ক্ষেত্রে, রোগীকেও নিজের সাথে লড়তে হয়, ওষুধের পাশাপাশই, অনেক সময়।
গিমপে, এই উপন্যাসের মূল চরিত্র, একজন মানষিক অসুস্থ মানুষ।
‘হ্রদ’ এক শান্ত, স্থির জলাশয়, কিন্তু তার গভীরতার, অনেক ক্ষেত্রে কোন অন্ত পাওয়া
যায় না। শিশুকালে, একদিন এমনই একটি হ্রদে, ভেসে ওঠে, গিমপের বাবার দেহ। হত্যা? না
আত্মহত্যা? কেউ জানে না।
গিমপের মনে
ভয়, পাছে তার মা তাকে ছেড়ে চলে যায়! মামাবাড়ীতে থাকতে সেই কারনেই সে চায় না।
আরেকটা কারণ আছে, মামাতো বোন। ছোটবেলার খেলার সাথীকে সে ভালোবেসে ফেলে।
কিশোরীবেলায় বোনটি বদলে যায়। তার ক্রুরতা ও নিষ্ঠুরতার কারনে গিমপে সেখানেও ব্যর্থ
হয়।
এই হল অতীত।
মেয়েদের ওপরে এমন এক প্রভাব এই দুইজন দিয়ে ফেলে গিমপেকে, যে, বড়ো হয়ে, যখন সে
স্কুলের শিক্ষক হয়, শিকার হয় এক অদ্ভুত মানসিক জটিলতার। মেয়েদের সে তাড়া করতে শুরু
করে। মানে কোন একটা মেয়েকে, যাকে সে হয়তো চেনেও না, তার পিছু নিতে শুরু করে, একসময়
হয়তো সুযোগ বুঝে যেচে কথা বলতে চায়। কিন্তু অচিরেই বুঝতে পারে, মেয়েটি ভয় পাচ্ছে,
সেটাই স্বাভাবিক। কারণ গিমপের মধ্যে কথা বলার তাগিদ থাকলেও সেই তাগিদের মধ্যে থাকে
বিকৃতি, যৌন তাগিদ, মানবিক জটিল আক্রোশ। এবং ব্যাপার হল এই মেয়েদের বেশিরভাগই
কিশোরী, স্কুল-কলেজ পড়ুয়া। তাদের প্রতিই তার আকর্ষণ সবচেয়ে বেশি।
অথচ সে
কোনদিন কোন মেয়েকে আঘাত করে নি, কোন মেয়েকে শারীরিকভাবে নিগ্রহ করে নি। এক অদ্ভুত
টানাপোড়েনের শিকার গিমপে প্রতিবারই এই অদ্ভুত আকর্ষণ ও আক্রোশের লুপে ঘুরে চলে। সে
হয়ে পড়ে একাকী, সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন, বিষাদগ্রস্থ, মুখোশধারী এক লুম্পেন। জীবন
সম্পর্কে শূন্যতাবোধ তাকে তাড়িয়ে নিয়ে চলে। অপরাধবোধ ও আত্মগ্লানি তাকে একটু একটু
করে পিষে শেষ করে দিতে থাকে। বাস্তবতা থেকে সে বারংবার সরে আসে তার ফ্যান্টাসী
জগতে। ব্যার্থ হয়, আবার উদ্যম করে। যৌন অবদমিত অনুভূতি তাকে অস্থির করে তোলে। সে
হয়ে পড়ে একা এবং একা। নিজের অজান্তেই সে হয়ে ওঠে একজন ‘স্টকার’।
গিমিপের এই
চরিত্রের আলো অন্ধকারের কি কোন টার্ম আছে? সাইকোলজিতে? আছে। একে বলা যায় Erotomania,
একে বলা যায় Voyeurism, আমি আরও দুটো টার্ম যোগ করব - Obsessive-Compulsive
Disorder এবং Borderline Personality Disorder. জিনিসগুলো কি?
1, Erotomania : একটি মানসিক বিকার যেখানে
ব্যক্তি ভুলভাবে বিশ্বাস করে যে কোনো উচ্চ মর্যাদার ব্যক্তি বা তার চারপাশের কেউ তার
প্রতি গভীরভাবে প্রেমে পড়েছে। যদিও বাস্তবে সেই ব্যক্তির কোনো প্রেমের অনুভূতি নেই
বা সম্পর্ক নেই। ইরোটোমানিয়া মূলত একতরফা ভালোবাসার ভিত্তিতে গড়ে ওঠা একপ্রকার
"ভ্রম"। এই রোগে আক্রান্ত ব্যক্তি প্রায়ই বিশ্বাস করে যে তার প্রতি অন্য
কেউ প্রেমের ইঙ্গিত দিচ্ছে, যেমন: নির্দিষ্টভাবে তাকানো, কথার ইশারা, বা কোনো সাধারণ
কাজকর্মকে ভালোবাসার নিদর্শন হিসেবে মনে করে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ইরোটোমানিয়া ব্যক্তির
মানসিক ভারসাম্যহীনতার কারণ হয়ে দাঁড়ায়, যার ফলে তাদের স্বাভাবিক সম্পর্কের ক্ষেত্রেও
সমস্যা দেখা দিতে পারে।
2. Voyeurism : গিম্পেইয়ের তরুণীদের অনুসরণ
করা এবং তাদের বিনা অনুমতিতে গোপনে দেখা একটি ধরনের Voyeurism-র লক্ষণ। Voyeurism-এ
আক্রান্ত ব্যক্তি অন্যদের ব্যক্তিগত মুহূর্তগুলো দেখার মাধ্যমে মানসিক তৃপ্তি লাভ করে।
3. OCD: গিম্পেইয়ের পুনরাবৃত্তিমূলক এবং
বাধ্যতামূলক আচরণ, যেমন- বারবার মেয়েদের অনুসরণ করা বা তার নিজের ব্যর্থতার প্রতি অতিরিক্ত
মনোনিবেশ করা, এটাকে OCD-এর লক্ষণ হিসেবে বিবেচনা করা যেতে পারে। যদিও তার ক্ষেত্রে
এই অসুখ বেশি চিন্তাভাবনার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য।
4. BPD: গিম্পেইয়ের নিজেকে নিয়ে অনিশ্চয়তা,
হঠাৎ আবেগের পরিবর্তন, এবং সম্পর্কগুলোতে সমস্যা, এগুলো BPD-এর লক্ষণ হতে পারে। তার
আবেগপ্রবণ এবং আত্মধ্বংসী আচরণ এই রোগের সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ।
গিমপের
জীবনে এইভাবেই একটা প্রেম এসেছিল। স্কুলের ছাত্রী হিসাকো। সে প্রেমও শুধু ব্যর্থই
হয় না, তার স্কুলের চাকরিটিও যায়। তার আগে গিমপে কি করত? যুদ্ধে গিয়েছিল। সেখানে
সে হারায় তার বন্ধুকে, যে তার সেই সময়ের সকল পাপকার্যের সঙ্গী। পাপকার্য কি ছিল?
অনেক। তার মধ্যে একটা তাকে সারাজীবন ধরে তাড়া করে বেড়ায়। তার নিজের সদ্যোজাত সন্তানকে,
যে ছিল একটি মেয়ে, এক বেশ্যার গর্ভজাত, তাকে একরাত্রে অন্য এক বেশ্যাখানার দরজায়
পরিত্যাগ করে।
অর্থাৎ, মা,
বোন/প্রথম ভালোবাসা, প্রেমিকা কিম্বা সন্তান – কোন ক্ষেত্রেই গিমপে সুস্থির হতে
পারে না। তার মানসিক বিকৃতি তাকে কোন একটা জায়গায় থিতু হতে দেয় না। সে তাই পাগলের
মতো তাড়া করে বেড়ায়। তাড়া করে বেড়ায় সৌন্দর্যকে। কাছে আসতে চায়, কিন্তু হাতে পায়
না। তার ভেতরকার অবদমিত বিকৃতির ঝাঁঝে সে নিজেই সেই সৌন্দর্যবোধ থেকে ছিটকে যায়।
পিপাসা মেটে না।
মানসিক
বিকারতার এই অন্ধকারকে বলা যেতে পারে। কাওয়াবাতা বলেছেন। তার একটা ইংরাজীতে অনুবাদ
হয়েছে। সেখান থেকে বাংলা অনুবাদ হয়েছে। অনুবাদ করেছেন দেবব্রত চট্টোপাধ্যায়।
অনুবাদের মান ভালোই। অন্তত আমার কোন সমস্যা হল না। সার্থক কি না, সেটা জাপানী ভাষা
বিশেষজ্ঞরাই বলতে পারবেন। তবে দাম যা করেছে এই বইটার, আনন্দ পাবলিশার্সকে মনে
করিয়ে দেয়। সাড়ে পাঁচশো টাকা! মনে রাখবেন, পৃষ্ঠা সংখ্যা মাত্র ১৯০, আর বইয়ের সাইজ
হাতের তালুর থেকে একটু বড়ো। মনে হয় খুব শিগগিরীই ‘আউট অফ প্রিন্ট’ করে দেওয়ার
বাসনা নিয়ে এই অনুবাদ করা হয়েছে।
কাওয়াবাতার
উপন্যাস খুব বড়ো নয়। ছোট ছোট উপন্যাসের মধ্যে তার কি বিস্তৃতি! আপনাকে বুঝে নিতে
হবে। কাওয়াবাতা সৌন্দর্যের পূজারী। কিন্তু তিনি জানেন সৌন্দর্য আপেক্ষিক। তার অনেক
উপন্যাসেই এটা দেখা যায় যে, সেই আপেক্ষিকতাকে ধরে রাখতে গিয়ে মানুষ কিভাবে একা ও
বিষদময় হয়ে যাচ্ছে। এই উপন্যাসে মানুষ বিকারগ্রস্থ হয়ে পড়ছে। আর বিকারগ্রস্থ
মানুষের উপংহার হয় কি?
এই
উপন্যাসেও হয় নি।
=====================
হ্রদ
ইয়াসুনারি কাওয়াবাতা
অনুবাদকঃ দেবব্রত
চট্টোপাধ্যায়
চিন্তা প্রকাশনী
মুদ্রিত মূল্যঃ ৫৫০টাকা
ছবি কৃতজ্ঞতাঃ সমর্পিতা
Comments
Post a Comment