অঙ্কের জগৎ ও অধ্যাপকের প্রেম

 


প্রথমেই অনুবাদের বিষয়ে আগে বলে নেওয়া উচিত। অভিজিৎ মুখার্জির এই অনুবাদ এক কথায় দুরন্ত অনুবাদ। খুব কম অনুবাদ আমাকে অভিভূত করে। এটা তার মধ্যে একটা। এমনকি তার ‘সমুদ্রতটে কাফকা’-ও আমাকে এতটা অভিভূত করতে পারে নি। মূল জাপানী থেকে অনুবাদ এই বইটা আমাকে মারাত্মক রকমের ধাক্কা দিয়ে গেছে। এবং তা মূলত অনুবাদের কারনেই। মাতৃভাষায় সার্থকভাবে কেউ যদি আমার কাছে সাহিত্য নিয়ে আসে তাকে আমি শ্রদ্ধা করি। অনুবাদের ব্যর্থতায় আমাদের যে কি হাল তা শারদীয়া পত্রিকাগুলো দেখলেই বোঝা যায়। ডোবার জল ফিল্টার করে কাহাতক খাওয়া যায়? মাঝে মাঝে মনে হয় ঝর্না নামুক, তার মিস্টি জল পান করে জীবনটাকে একটু আদর দিই। অনুবাদ প্রমাণ করে দেয়, আধুনিক বাংলা সাহিত্য প্রথাগত ভাবের বাইরে ভাবতে ভুলে গেছে।

      ইয়োকো ওগাওয়ার এই বই ইংরাজীতে পড়লে ঠিক কতটা ভালো লাগত আমার সন্দেহ আছে। আচ্ছা আমার ব্যকগ্রাউন্ড সায়েন্স ছিল বলেই কি আমার এই বইটা ভালো লাগল? সেটাও একটা বিষয় হলেও বাংলা ভাষায় এর সার্থক প্রয়োগ আমাকে আনন্দ দিয়েছে অনেক বেশি।

      যাদের ব্যাকগ্রাউন্ড অঙ্ক আছে, তাদের এই বইটা আরও বেশি ভাল লাগবে। আর যারা অঙ্ক থেকে প্রাণপনে বাঁচতে চান, তারা এই বইটাকে, হয়তো এড়িয়ে যেতে পারেন। আমি জানি না, ইয়োকো ওগাওয়া কীভাবে এই উপন্যাসের নির্মান করলেন? বিস্ময় বটে।

      দুর্ঘটনাগ্রস্থ একজন ষাটোর্ধ অঙ্কের অধ্যাপক, যার স্মৃতি থেমে আছে ১৯৮৫ সালে, যার বর্তমান স্মৃতির ধারকত্ব মাত্র আশি মিনিটের, এমন অধ্যাপকের সান্নিধ্যে আসেন এক গৃহপরিচারিকা এবং তার দশ বছরের পুত্র। অধ্যাপকের আলাপের একমাত্র মাধ্যম অঙ্ক। জীবন যে কি বিষয়াদময় এবং যন্ত্রণাময় তার এক জাজ্বল্যমান উদাহরন এই উপন্যাস। অঙ্কের অধ্যাপক রোজ সকালে উঠে প্রথমেই জানতে পারেন, তার আগের দিনের কোন স্মৃতি নেই। সেই ভয়াবহতার মুখোমুখি হয়ে, ধাতস্থ হয়ে উঠেই তাকে মুখোমুখি হতে হয় পরিচারিকার, যাকে সে দেখেছে প্রতিদিন, কিন্তু আর মনে নেই। ফলে প্রতিটি দিন, পরিচারিকাকে পরিচয় দিতে হয়, সে কে। আর তাদের আলাপ শুরু হয় অঙ্কের মধ্যে দিয়ে।

      তার পায়ের জুতোর মাপ কত?

      যে যে বিষয় ভালোবাসে, সে কি সেই বিষয়টার মধ্যে দিয়েই পৃথিবীটাকে দেখতে চায় না? সেটাই তো বেঁচে থাকার একমাত্র প্রেরণা। অধ্যাপক অঙ্কের মধ্যে দিয়ে জগতটাকে দেখতে পায়। প্রতিটা সংখ্যা, প্রতিটা চিহ্নের মধ্যে অ্যাবস্ট্রাক্ট সৌন্দর্যের কি অপার্থিব মহিমা! অধ্যাপকের কাছে পুরো বিশ্ব ঈশ্বরের অঙ্কের একটা খাতা। যার কয়েকটা পাতা মানুষেরা দেখতে পেয়েছে, আর দেখতে পেয়েছে বলেই এতটা পথ আসতে পেরেছে।

      সেই অঙ্কের মধ্যে অবগাহন করেছেন তিনি। লেখিকা খানিকটা খানিকটা করে আমাদের অবগাহন করাচ্ছেন। আমি অবগাহনে বিস্মিত হচ্ছি।

      উপন্যাস এইটুকু হলে এত কথা বলার থাকত না। যে নারী পরিচারিকা হয়ে এসেছেন, তার জীবন অন্য খাতে বইছে। সমাজ তার প্রতি সুবিচার করে নি। ছেড়ে যাওয়া প্রেমিকের প্রেমজ সন্তানকে আঁকড়ে ধরেই তার পথ চলা। সেই পথের এক মোড়ে দেখা এই অধ্যাপকের সাথে। জীবনে বেঁচে থাকার যে এক অক্লান্ত পরিশ্রম, প্রফেসর আর তার অঙ্কের যাদুবাস্তবতা সেই পরিশ্রমের বিশ্রামাশ্রয়।

      সম্পর্ক এক অদ্ভুত জিনিস। শুধুমাত্র নারী-পুরুষের কিছু প্রথাগত সম্পর্কের মধ্যে নিজেদেরকে খুঁজে বের করার বাইরে যে অনেক বড়ো একটা পৃথিবী রয়েছে, আর সেই পৃথিবীতে যে কত রকমের অকথিত সম্পর্কে আছে সেটার কথা ভাবতে গেলেই আমার কেমন যেন একটা অনুভূতি হয়। সমাজ আমাকে যে সম্পর্কগুলোর মধ্যে সীমাবদ্ধ করে দেয়, তার বাইরের সম্পর্কে আমরা অশুচিতা দেখি। সে কেবল ভয়ের দৃষ্টি। সমাজের দ্বারা ছাড়পত্র না পাওয়ার পাঁচিলের মধ্যে থাকা এক ভীরুতা। আমাদের বেঁচে পথ আটকে দেয়।

      এই উপন্যাস সেই অকথিত সম্পর্কের একটা। সমাজ তাদের ভুল বোঝে বটে, কিন্তু আটকে রাখতে পারে না। একসময় নিজেদের ব্যক্তিত্বই সেই সম্পর্ককে এক শুদ্ধতাবোধের মধ্যে দিয়ে নিয়ে যায় সামনের দিকে। সেখানে কোন ভয়ের কারন নেই, আছে ভয়ের বিকৃত ত্রাস, যার কোন মূল্যই নেই।

      এই উপন্যাস একটি শুষ্কং কাষ্ঠং উপন্যাস। তার একটা বড়ো কারন, অঙ্ক। গাণিতিক সৌন্দর্য একটা বড়ো অংশ জুড়ে রয়েছে। আর রয়েছে বেসবল খেলা। এই দুইয়ের যাতাকলে পড়ে, পিষে গিয়ে, যারা উপন্যাসটাকে দেখতে পাবেন, তারা বিস্মিত হবেন এই ভেবে যে, এমনভাবেও একটা উপন্যাসকে রচনা করা যেতে পারে?

      ইয়োকো ওগাওয়া আমায় বিস্মিত করলেন।

===============

অঙ্কের জগৎ ও অধ্যাপকের প্রেম

ইয়োকো ওগাওয়া

অনুবাদকঃ অভিজিৎ মুখার্জি

যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় প্রকাশনা

মুদ্রিত মূল্যঃ ৪৫০ টাকা

ছবি কৃতজ্ঞতাঃ সমর্পিতা

Comments

Popular posts from this blog

যে বুকে আগুন জ্বলে

শারদীয়া আনন্দবাজার পত্রিকা সম্পর্কে

জেরক্স কপির উন্নত ভার্সানে ‘আবার প্রলয়’ এসেছে