দ্য সাউন্ড অফ দ্য মাউন্টেন


 

কাওয়াবাতা-র এই পর্যায়ের উপন্যাসটি, যেটা আমি পড়ে শেষ করে উঠলাম, সেটা যদি কেউ শুরু করতে চান, তাহলে তাকে দুটো বিষয় একটু মাথায় রাখতে হবে, নচেৎ, এই উপন্যাস দুই-তিন পর্বের মধ্যেই একঘেয়ে লাগতে পারে।

প্রথম বিষয় – যুদ্ধ। আমাদের জেনারেশান যুদ্ধ কি জিনিস, মানে, তার ডায়রেক্ট ইমপ্যাক্ট কি, তা জানে না। আমরা কোনদিন কোন যুদ্ধে সরাসরি অংশগ্রহণ করি নি, এমনকি, ভারত-পাকিস্থান কিম্বা ভারত-চীন যুদ্ধের ভয়াবহ প্রভাব আমাদের জনসমাজে তেমন করে পড়ে নি, অন্তত, ইউক্রেন কিম্বা প্যালেস্তাইনের দিকে তাকালে ব্যাপারটা আরও পরিস্কার হয়ে যাবে।

কাওয়াবাতার এই উপন্যাসটি ধারাবাহিকভাবে যখন বের হচ্ছে, সেই সময়কাল হল ১৯৪৯-১৯৫৪। অর্থাৎ, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জাপান শুধু পর্যুদস্থই হয় নি, সমগ্র জাতি এমন এক সংকটের মধ্যে দিয়ে এরপরের কয়েক দশক অতিক্রান্ত করেছিল যে, তার সামগ্রিক সত্ত্বাটিই একটা ভয়ানক অস্থিরতা এবং অনির্দেশ্যতার মধ্যে দিয়ে গিয়েছিল। সামাজিক পরিকাঠামো, অর্থনৈতিক পরিকাঠামো এবং জাতির মূল্যবোধ --- এই তিনটে জায়গায় চরম দ্বিধা ও দ্বন্দ্বের মধ্যে দিয়ে তাকে চলতে হয়েছিল।

ফলে একটা পরিবারেই মাত্র দুটো জেনারেশানের মধ্যেকার মূল্যবোধের এমন এক দ্বন্দ্ব উৎপন্ন হয়েছিল যে, সেই সংকট প্রকৃতই জাপানের সত্ত্বার সংকট হয়ে দেখা দিয়েছিল।

Wartime and peacetime are not the same thing.’

দ্বিতীয় বিষয় – পাশ্চাত্য প্রভাব। আমেরিকার আন্ডারে চলে যাওয়া মানেই, যুদ্ধবিজিত জাতি হিসাবে, বিজয়ী জাতির প্রভাব অমোঘভাবে তার মধ্যে পড়বেই। ফলে পুর্ববর্তী যে জেনারেশানে তার বিন্দুমাত্র কোন প্রভাব থাকে না, যে জেনারেশান বহুকাল ধরে চলে আসা এক ধারাবাহিক প্রথা ও কাঠামোর মধ্যে দিয়ে এগোচ্ছিল, সেই এখন, মাত্র কয়েক দশকের মধ্যে দেখতে পায়, তার ঠিক পরবর্তী জেনারশানের মধ্যে এমন এক মূল্যবোধ সঞ্চারিত হয়েছে যে, যার প্রথা ও ধারার সম্পর্কে ধারনা তো নেই-ই, তা এক অর্থে বিস্ময়কর এবং সেটাকে বুঝে নিয়ে তার সাথে তাল মিলিয়ে চলাটা এক রকমের অসম্ভব কাজ।

“He left behind notes to their daughter and son-in-law and grandchildren. Here it is in the paper.’ Yasuko began reading again. ‘“Miserable old creatures, living our leftover lives, forgotten by the world? No, we have decided that we do not want to live so long. We quite understand the feelings of Viscount Takagi. People should go away while they are still loved. We shall go now, still in the embrace of family affection, blessed with numbers of comrades and colleagues and schoolmates.” That’s to the daughter and son-in-law. And this is the one to the grandchildren: “The day of Japanese independence is approaching, but the way ahead is dark. If young students who know the horrors of war really want peace, then they must persist to the end in the nonviolent methods of Gandhi. We have lived too long and no longer have the strength to lead and to pursue the way we believe right. Were we to live idly on into ‘The Spiteful Years’, then we would have made meaningless the years we have lived thus far. We want to leave behind memories of a good grandfather and grandmother. We do not know where we are going. We but go quietly off.”’

      অথচ চলা যাচ্ছে না বলেই যে, সেটাকে অস্বীকার করে দেওয়া যায়, এমনটাও নয়। কারণ সেটা যদি এতটাই মন্দ হয়, সেক্ষেত্রে পরের জেনারেশানে এত গভীর প্রভাব এবং অমোঘ প্রভাব রাখতে পারছে কি করে?

      এই দ্বন্দ্বের মধ্যেই পড়ে গেছেন একটি সংসারের প্রমুখ প্রধান সিংগো ওগাটা। বাষট্টি বছরের এই বুড়োর মতাদর্শের সাথে তার পুত্র, সুইচি’র জীবনাদর্শের আকাশ পাতাল তফাত। সুইচি যুদ্ধ দেখেছে, ফিরে এসে (হয়তো বা) তার মধ্যে জীবনের কাছে যেন কোনরকম কোন আশা নেই, কেবল বয়ে চলাটাই সত্য। তার স্ত্রী কিকুকো-র সাথে অনেক দূরত্ব। বরং আরেকটি মেয়ের সাথে তার আশনাই। এবং এই বিবাহ বহির্ভূত প্রেমের মধ্যে তার কোন অপরাধবোধ নেই! কেন? সিংগো সেটাই বুঝে উঠতে পারে না।

      পরকীয়া প্রেমে কি অপরাধবোধ থাকে না?

      তার কন্যা ফুসাকো, তার তিনটি সন্তান নিয়ে চলে আসে বাবার কাছে। কারন, তার স্বামী, আইহারা মদ্যপ, ড্রাগ এডিক্টেড এবং তার অনেক প্রণয়ী আছে। ফুসাকোর মধ্যে তীব্র ক্ষোভ, বাবার প্রতি, কারণ তার বাবাই এই বিয়ে দিয়েছিল। ফুসাকোর মধ্যে কোন অপরাধবোধ দেখতে পায় না, ফুসাকোর মধ্যে সিংগো কোন নারীসুলভ নম্রতা বা নমনীয়বোধ দেখতে পায় না। বরং দেখতে পায়, যে অন্ধকারকে একটা মানুষ জয় করে মানুষ হয়ে উঠবে, ফুসাকো সেই অন্ধকার অর্থাৎ, ঈর্ষা, দ্বেষ, ক্রোধ সমস্তকিছুকে অত্যন্ত স্বাভাবিক করে নিয়ে জীবন কাটাচ্ছে। স্বাধীনতার এই তীব্র আবেগের পরিণতি কি? সিংগো বুঝেই পায় না।

      অথচ এই সিংগোর মধ্যেও এক টানাপোড়েন কাজ করে। সিংগোর স্ত্রী, য়াসুকোকে সে কি সত্যিই বিয়ে করতে চেয়েছিল? না কি তার সুন্দরী দিদিকে, যে দিদি মারা যাওয়ার পর য়াসুকো দিনের পর দিন দিদির শ্বশুরবাড়ীতে থাকতো, দিদির স্বামীকে সঙ্গ দেওয়ার জন্য। সে সমস্ত অতীতকে পেরিয়ে তবুও দুজনে কি সহাবস্থান করে নি? সংসারে সেই সহাবস্থানের মধ্যে প্রেম আসে নি? এসেছে। তবে আজ আর তা আসছে না কেন?

অথচ আজ এত সহজেই বলে ফেলা যাচ্ছে কেন, তুমি চাইলে স্বাধীন হতে পারো। আমার কোন আপত্তি নেই। আমাকে আমার মতো থাকতে দাও। তার ছেলেই বলছে। তার পরের জেনারেশান বলছে, “That was what you were trying to say, was it? Well, I’m not that sort of sentimental fatalist myself. The bullets used to go whistling by my ears, and not one of them touched me. I may have left behind a child or two in the islands or in China. It’s nothing at all, meeting your own bastard and not recognizing it, when you’ve had bullets whistling by your ear. No threat to your life. And then there’s no guarantee that Kinu will have a girl, and if she says it isn’t mine that’s enough for me.”

      তার ছেলের রক্ষিতা একটি সন্তান চায়, জীবনের জন্য, অথচ তার ছেলের বউ নিজে অ্যাবরশান করে, সন্মান নিয়ে বেঁচে থাকার জন্য। অথচ দুটোতেই ছেলে নির্বিকার। অপরাধবোধহীন। জীবন সম্পর্কে এক বোহেমিয়ান দৃষ্টিভঙ্গীর প্রতীক।

      ঠিক এই জায়গাতেই সিংগোর জীবনে ঠান্ডা বাতাস হয়ে আসে কিকুকো, তার ছেলের বউ। বাবা-মেয়ের (পড়ুন শ্বশুর-বৌমা) মধ্যে একটা অদ্ভুত পারস্পরিক সহজাত সম্পর্ক তৈরী হয়। দুজন দুজনকে বুঝতে পারে। একটা অদ্ভুত মেলবন্ধন তৈরী হয়। অথচ দুজনে দুই জেনারেশানের! এখানে কোন সমস্যা নেই।

      দুজনের মধ্যে এমন একটা বিশ্বাসবোধ তৈরী হয় যে, কুকিকো তার মদ্যপ, লম্পট স্বামীকে ছেড়ে যেতে চায় না। মুক্তি পেলেও সে মুক্ত হতে চায় না। সে জানে, তার শ্বশুর তাকে যে নিবিড়তায় বুঝেছে, আর কেউ তাকে এমন করে বুঝতে অক্ষম। আবার বিপরীতে স্ত্রী থাকা সত্ত্বেও সিংগোর একাকীত্ববোধ, এবং এই জেনারেশনের প্রতি কৌতুহল কুকিরোর প্রতি এমন এক মমত্ববোধ জাগিয়ে তোলে যে, নিজেই নিজের মধ্যে এক জটিল রসায় তৈরী করে। যেন, তার এই অন্য পরিবারের মেয়েটিই নিজের মেয়ে, এমনকি তাকে এই পরিবার থেকে মুক্ত করতেও সে চায়। সে স্বপ্ন দেখে। সে স্বপন দেখে সে কুকিরোকে মুক্ত করতে সক্ষম।

      “What was wrong with loving Kikuko in a dream? What was there to fear, to be ashamed of, in a dream? And indeed what would be wrong with secretly loving her in his waking hours? He tried this new way of thinking.

      জীবন যখন বৃদ্ধত্বের নিয়ে এসে মানুষকে ফেলে, তখন ঠিক কিরকমভাবে সে জীবনকে দেখবে? অভিজ্ঞতার ঝুলিতে তখনও কি অনেক অভিজ্ঞতা বাকি থাকবে? একজন বৃদ্ধ জীবনকে কিভাবে দেখে? কোন বিস্ময়ে? কোন অভিভূত মানসিকতায়? কিম্বা কোন নঙর্থক মতদৃষ্টিতে? সিংগো দেখছে। তার যুবক জীবন আর তার বৃধ জীবনে সমাজ, সম্পর্ক সবকিছুই কেমন যেন বদলে যাচ্ছে। কোন দিকে? কোন আঙ্গিকে? কোন মতাদর্শে? এমন পরিবর্তনের মধ্যে বারবার মৃত্যু তার আশেপাশে ঘোরাফেরা করে। তার কাছের মানুষ, বন্ধুরা এক এক করে মারা যায়। সে প্রকৃত অর্থে একা হয়ে যায়।

আর এমনিভাবেই সে শুনতে পায় পাহাড়ের শব্দ। যে পাহাড়ের শব্দ মৃত্যুর দ্যোতক। তাকে কানে কানে বলে যায়, প্রস্তুত হও। যা কিছুই হোক না কেন, মৃত্যুর চেয়ে বড়ো কিছু নেই।

============================

The Sound Of The Mountain

Yasunari Kawabata

অনুবাদক: Edward G. Seidensticker

Penguin Publication

মুদ্রিত মূল্যঃ 499/-

ছবি কৃতজ্ঞতাঃ সমর্পিতা

Comments

Popular posts from this blog

যে বুকে আগুন জ্বলে

শারদীয়া আনন্দবাজার পত্রিকা সম্পর্কে

জেরক্স কপির উন্নত ভার্সানে ‘আবার প্রলয়’ এসেছে