হাজার সারস

 


হাজার সারস – জাপানী সমাজে এর বৈশিষ্ট্য কি? বলা হয়, কোন মানুষ যদি অসুস্থ হয়ে পড়ে তাহলে, তাকে তার পরিচতেরা মোট নয়শো নিরানব্বইটা কাগজের সারস বানিয়ে একটা বাক্সে করে উপহার দেয়। যাতে করে সে সুস্থ হয়ে ওঠার পর একটা সারস নিজেই বানিয়ে নিয়ে সারসের সংখ্যা এক হাজার করে ফেলতে পারে। জাপানে সারস সৌভাগ্য এবং দীর্ঘজীবনের প্রতীক। তারা বিশ্বাস করে, এতে করে ব্যক্তিটি হাজার বছর বাঁচবেন।

কাওয়াবাতার এই উপন্যাসের ‘সারস’ অতীতের অপরাধবোধজনিত বিষন্নতা নামক অসুস্থতা থেকে বেরিয়ে আসার কামনা করে। সেই হাজারটি সারস আছে য়ুকোকি’র রুমালে। সাদা স্বচ্ছ রুমালে। যাকে দেখলেই কিকুজি বুঝতে পারে না, য়ুকোজিকে তার আপন অস্বচ্ছ, দ্বন্দ্ব এবং ক্ষোভপুর্ণ জীবনের সাথে যুক্ত করা উচিৎ হবে কি না।

কাওয়াবাতার গল্পের মধ্যে আছে প্রকৃতি। আছে মানুষের সম্পর্কের এক জটিল দ্বান্দ্বিক পরিকাঠামো। আর আছে জাপানী সংস্কৃতি।

এই পর্যায়ে উপন্যাসের অধিকাংশটা জুড়েই রয়েছে চা-উৎসবchanoyu’ বা ‘sado’ নামে যাকে জাপানে অভিহিত করা হয়। চেনা পরিচিত মানুষেরা বিশেষ দিনে এক জায়গায় বসে একত্রে চা-পান করেন। আমাদের এখানে পারিবারিক বিজয়া সন্মেলনীর মতো। গৃহকর্তা নিজের চা-পাত্র, চা এবং       বাঁশের কাঠি নিয়ে চা বানান। অপরাপর অতিথিরা তাদের নিজস্ব চা-পাত্র নিয়ে আসেন। সেই পাত্র তাদের খুব প্রিয়, অনেক অনেক পাত্র হয়তো কয়েকশো বছরের পুরোনো। তাদের কাছে তা ঐতিহ্যের বিষয়। তারা চা-পান করেন, গল্প গুজব করেন, হয়তো বা পুরোনো স্মৃতিচারনও করেন। তাদের কাছে এটা ‘wabi-sabi (beauty in imperfection) এবং mono no aware (awareness of impermanence)। নয়শো শতকের জেন বুদ্ধিস্টদের মন্দির থেকে জাপানের সমাজে চা-পানের প্রথা প্রবাহিত হওয়ার উদ্দেশ্য হল - Harmony (Wa), Respect (Kei), Purity (Sei), Tranquility (Jaku)

আমার এই গৌড়চন্দ্রিকা করার কারণ হল, জাপানী সংস্কৃতি কাওয়াবাতার উপন্যাসে মিশে রয়েছে, প্যারার পর প্যারা জুড়ে। সেটার সম্বন্ধে ধারনা না থাকলে উপন্যাসের গতিপ্রকৃতি জানাটা একটু মুশকিল।

সম্পর্কের দ্বন্দ্বটা ঠিক কোথায়? কোথায় রয়েছে সৌন্দর্যের পাশাপাশি স্মৃতিকাতর অপরাধবোধ? গল্পের মূল চরিত্র কোকুজিকে চা-উৎসবে আহ্বান করে কুরিমোতো চিকাকো, তার বাবা মি. মিতানি-র প্রাক্তন রক্ষি*। উদ্দেশ্য কোকুজির সঙ্গে য়ুকিকোর ঘটকালি করা। কোকুজির বাবা এবং মা দুজনেই মৃত। কোকুজির মধ্যে বাবার প্রতি আকর্ষণ ও বিকর্ষন দুটোই আছে। কারণ শুধু চিকাকোই নয়। কোকুজি উৎসবে যোগ দিতে এসে দেখে সেখানে শ্রীমতী ওতা ও তার মেয়ে ফুমিকো উপস্থিত, অনাহুতো অতিথি হিসাবে। কোকুজির মন বিষাদগ্রস্থ হয়ে পড়ে, কারণ শ্রীমতী ওতা তার বাবার বাল্যবন্ধুর বিধবা পত্নী এবং তার বাবার অপর এক রক্ষি*। কোকুজি তার মায়ের মৃত্যুর পর প্রায় চার বছর ধরে এদের সাথে কোন সম্পর্ক রাখে নি। কিন্তু আজ একটা উৎসব তাকে এমন এক সন্ধিক্ষণে এসে ফেলে যে তার মন এক ভয়ঙ্কর দোলাচালে এসে পড়ে। ফেরার পথে প্রৌড়া শ্রীমতী ওতা এবং যুবক কোকুজি একটি সরাইখানায় রাত্রিযাপন করে, যেখানে তাদের মধ্যে যৌ* সম্পর্ক স্থাপিত হয়। কোকুজি এবং ওতা --- দুজনের মধ্যেই এরপর তাড়া করে ফেরে অপরাধবোধ, একাকীত্ববোধ, দ্বন্দ্ব --- আর তাড়া করে ফেরে ইয়ুকোকির হাজার সারসের রুমাল। গল্প শুরু ঠিক এইখান থেকে।

সম্পর্ক বড়ো ভয়ঙ্কর। সে তো আমাদের পরিকল্পিত পথে চলে না। যে কামনা অবদমিত, সেই কামনাই সৌন্দর্য এবং বিশুদ্ধতার সামনে এসে এমন এক সত্য-দ্বন্দ্বের সৃষ্টি করে যে, সেই বীভৎসতার আগুনে পুড়ে যেতে যেতেও মনে হয় না যে, কোন ভুল আছে সে সম্পর্কে। উপন্যাসের প্রথমার্ধে কুকিজোর বাবার অতীত কুকিজোকে তাড়া করে বেড়ায়। ওতার সৌন্দর্যে তার বাবা স্বাভাবিকভাবেই সাড়া দিয়েছিল, সে নিজেও যখন সাড়া দিয়ে ফেলে, তখন, বুঝতে পারে না তার বাবা তাদের পরিবারের প্রতি ন্যায় করেছিলেন, না অন্যায়। সেই সৌন্দর্যের স্বাদ সে নিজেও পেয়েছে যে! ওতা তার আকাঙ্খার পূর্ণতা দিয়ে কোকুজিকে বোঝাতে গিয়েছিল, তার বাবার কোন দোষ ছিল না। কিন্তু নিজের ভেতরের সুপ্ত বাসনা প্রেমিক পুত্রের মধ্যেও পূর্ণতা পেতে দেখে সে নিজে দিশেহারা হয়ে যায়। কোনটা উচিৎ আর কোনটা অনুচিত – এই দ্বন্দ্বে সে ছারখার হয়ে যায়। উপন্যাসের দ্বিতীয়ার্ধে শ্রীমতী ওতার কর্মকৃত ভয়ঙ্কর মুগ্ধতার প্রভাব কোকুজি আর ফুমিকোকে (ওতার কন্যা) ছিন্নবিচ্ছিন্ন করে দিতে থাকে। কোকুজি সবিস্ময়ে দেখে, সে ফুমিকোর মধ্যে শ্রীমতী ওতা-র সেই সৌন্দর্যকে পাচ্ছে, সেই অমোঘ কামনা, যা তার শ্রীমতী ওতা পেয়েছিলেন তার বাবা মিতানি-র থেকে কোকুজি-র প্রতি।

মাঝখান থেকে হাজার সারস এসে কোকুজিকে দিয়ে যায় স্নিগ্ধতার খোঁজ, মুক্তির খোঁজ, শুদ্ধতার খোঁজ, য়ুকিকোর খোঁজ।

কিন্তু মানুষের জীবন তো অত সহজ নয়! খুঁজে পেলেও তাকে পাওয়া হয় কি?

আমাদের প্রত্যেকেরই অতীত আছে। সেই অতীতে আছে অপরাধবোধ, সেই অতীতে আছে সুখ। আমরা সুখের কাছে ফিরে যেতে চাইছি বটে, কিন্তু কখন যেন অপরাধ-স্মৃতি পেছন পেছন এসে আমাদের সমস্ত সত্ত্বাটাকে নাড়া দিয়ে যায়। আমাদের প্রশ্ন করে নীতি ও ন্যায্যতা নিয়ে, আমাদের বিবেকবোধের সাথে ক্রমাগত লুকোচুরি খেলে। আমরা তখন কি করি?

এমনও হয়, যে অপরাধবোধের ভাগী আমরা কোনমতেই নই, পুর্বপুরুষকৃত সেই অপরাধকে আমাদেরকেই বয়ে বেড়াতে হয়। আমরা না চাইতেও আমাদের পুর্বপুরুষের সেই ভয়ঙ্কর অ-সামাজিক কাজকে অন্যায় মেনে মাথা নীচু করে কিম্বা ব্যক্তিগত ক্ষোভের মধ্যে নিরুত্তর থাকি। অথচ, এও দেখা যায়, অন্যায় যাকে বলা হচ্ছে, তা সেই মুহূর্তের পরিপ্রেক্ষিতে হয়তো অন্যায় ছিল না। দুজন মানুষ কোন প্রয়োজনে একে অপরের কাছে আসে? তা কে বলতে পারে। এ তো কোন লাম্পট্যের চিরায়ত ধারা নয়। আর তাই প্রয়োজনটাকে কোথাও হয়তো লঙ্ঘণ করা যায় না। প্রয়োজনেই মানুষ বাসা বাধে, প্রয়োজনেই মানুষ সামাজিক হয়। কিন্তু সমাজ যখন প্রয়োজনের মানদণ্ড তৈরী করে তখন, প্রয়োজনকে হয় গলা টিপে মেরে ফেলতে হয়, নয় অন্য কোন প্রয়োজনের মধ্যে মিশিয়ে দিতে হয়, নয় প্রয়োজন মিটিয়ে নিয়ে নিজেকে অসামাজিক বলে প্রতিপন্ন করতে হয়।

আমার অবাক লাগে, ‘মিনিমালিস্ট’ কাওয়াবাতা কি অসাধারণ কাব্যিক ভঙ্গিমায় এই যন্ত্রণা এবং সুখের বিবশতার কথা লিখছেন! কত কথা বাদ দিচ্ছেন, কিন্তু সেই কথাগুলো দুটো প্যারার মাঝখানে কি সাংঘাতিকভাবে জাজ্বল্যমান!

এর মধ্যে জেগে থাকে হাজার সারসের রুমাল। সে বলে তুমি সুস্থ হও। এই দ্বন্দ্ব তোমাকে অসুস্থ করে তুলছে। পরিবর্তনশীল জগতে এই দ্বন্দ্বের মধ্যে বাস করা তোমাকে মানায় না। তুমি বেরিয়ে এসো। শুদ্ধতা এবং সরলতার মধ্যে এসো। চিরন্তন বিষন্নতা এবং একাকীত্ব থেকে নিজেকে মুক্ত করো। জীবনের সরল সম্পর্কগুলোকে অযথা জটিল কোরো না। জীবনের জটিল সম্পর্কগুলো, যা অতীত হয়ে গেছে, তাকেও টেনে হিঁচড়ে সরল করতে চেও না। স্মৃতি থেকে ফেরো। নিজের সত্ত্বাতে ফেরো। নিজেকে দেখো, নিজেকে জানো। ঠিক তেমনটিই, যেমনটি তুমি...

অপরাধবোধ থেকে জন্মানো মানসিক দুর্বলতা মানুষকে অবশেষে ধ্বংসই করে। অপরাধবোধকে জাগিয়ে রাখার অর্থই নিজেকে দুর্বল করা। বিফলতা, ভ্রম থাকিলেই বা; গরুকে কখনও মিথ্যা কথা বলিতে শুনি নাই, কিন্তু উহা চিরকাল গরুই থাকে, কখনই মানুষ হয় না। অতএব বার বার বিফল হও, কিছুমাত্র ক্ষতি নাই;” স্বামী বিবেকানন্দের কথা মনে পড়ে। কেবল এর পরের কথা আমার নিজের উপলব্ধি, তা নিয়ে ঘরের কোনে পড়ে থাকাটাও আমায় মানায় না। যদি তাই হয়, তাহলে এক ভুল আমি আবার করব, বারবার করব; এক ক্ষমা আমি আবার চাইব, বারবার চাইব, কিন্তু তবুও যেন শেষ হবে না আমার অপরাধের; এবং এক সময়ে ধ্বংস এইভাবেই আমি হয়ে যাব। শ্রীমতী ওতা তার এক বড়ো উদাহরণ। ফুমিকো অন্য আঙ্গিকের উদাহরন।

কাওয়াবাতা এই ভগ্ন এবং দ্বান্দ্বিক হৃদয়ের আখ্যান এক অদ্ভুত প্রকৃতির পেলবতার মধ্যে দিয়ে লিখে গেছেন। আমার আবার পড়তে ইচ্ছে হয়। বারবার পড়তে ইচ্ছে হয়।

সন্দীপ ঠাকুর ও এইকো ঠাকুরের অনুবাদ চমৎকার, কেবল কতকগুলো বানান ভুল চোখকে পীড়া দেয়।

===================

হাজার সারস

ইয়াসুনারি কাওয়াবাতা

অনুবাদঃ সন্দীপ ঠাকুর ও এইকো ঠাকুর

সাহিত্য অকাদেমী

মুদ্রিত মূল্যঃ ৮০ টাকা

ছবি কৃতজ্ঞতাঃ সমর্পিতা

Comments

  1. লেখার মাঝখানে কোকুজি টাকে কুকিজো পড়লাম, সঠিক কোনটা একটু কারেক্ট করে নেবেন, আর দোলাচাল এবং প্রৌড়াく guess

    ReplyDelete
    Replies
    1. I guess দোলাচল এবং প্রৌঢ়া সঠিক বানান হবে, just check it,
      এবং বাকিটুকু অত্যন্ত সুন্দর ভাবে উপস্থাপন করেছেন, সময়াভাবে পড়া হয়ে ওঠে না, আজ আপনার এই রিভিউ টা পড়বার পর বইটি পড়বার ইচ্ছে হলো, আশা করি খুব শিগগিরই সেই ইচ্ছে পূরণ করবো,
      শুভকামনা রইলো।।

      Delete

Post a Comment

Popular posts from this blog

যে বুকে আগুন জ্বলে

শারদীয়া আনন্দবাজার পত্রিকা সম্পর্কে

জেরক্স কপির উন্নত ভার্সানে ‘আবার প্রলয়’ এসেছে