বিফোর দ্য কফি গেট্স কোল্ড
“All that we are is the result of what we have thought” ~ Gautama Buddha
জীবন বড়ো অদ্ভুত। আমারই তৈরী যে জীবন
আমি যাপন করছি, এক-একসময়, আমার মনে হয়, সেই জীবনটাকে যদি, আমার ফেলে আসা বয়সের কোন
একটা পর্যায় থেকে আবার শুরু করতে পারতাম! আমি কি তাহলে একই ভুল করতাম? হয়তো বা, হয়তো
না। একই ভুল না করতে হলে আমার মধ্যে সেই ভুলের বোধটা তো থাকতে হবে। অর্থাৎ, আমি কোথাও
চাই অতীতে ফিরতে, বর্তমানের ‘বোধ’ নিয়ে। মানুষ একই ভুল দুইবার করতে চায় না। প্রেমে
পড়লে আলাদা ব্যাপার। কিন্তু বাস্তবের কঠিন রাস্তায় সে চলতে চায়, অন্য আঙ্গিকে।
আমরা সবাই কি তাই-ই
চাই না?
আমাদের সবারই এমন
একটা অতীত আছে, যে অতীতের কোন একটা জায়গাকে আমরা পরিবর্তন করার আকাঙ্ক্ষা মনে মনে পোষণ
করি। মনে করি, যদি জীবনটাকে অন্যভাবে শুরু করা যেত! মনে করি, যদি আমার হাতে ক্ষমতা
থাকত, তাহলে একটু অন্যভাবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করা যেতে পারত আজ। কিম্বা আমরা কোথাও যেন
এক অনন্ত জীবন চাই, যে জীবনে বয়সের পরিবর্তন অতি ধীর। যেন বা, এ জীবনের পরিবেশকে একটা
সময় শেষ করে দিয়ে, সকল দেনা চুকিয়ে দিয়ে, অন্য এক জীবন নতুন করে শুরু করব। এবং তা আমার
পরিকল্পনামতো।
কিন্তু হায়… মৃত্যুই
বাস্তব পরিণতি। আমাদের প্রতিদিন মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত হওয়ার কথা, আমরা জীবনের জন্য
নিজেকে বিকিয়ে বিকিয়ে চলেছি।
“No matter
what difficulties people face, they will always have the strength to overcome
them.” লিখছেন Toshikazu Kawaguchi, কোথায় লিখছেন? Before The Coffee Gets Cold উপন্যাসে।
টোকিও। একটা কফিশপ।
তিনজন আছে কফিশপে – কাজু (মজার কথা, লেখকের নাম তোশিকাজু, এটা কি সমাপতন?), নাগারে
আর কেই। একটা বিশেষ চেয়ার। যে চেয়ারে বসলে চলে যাওয়া যায় অতীতে, কিম্বা ভবিষ্যতে। তবে
শর্ত আছে বেশ কয়েকটি ---
১। যারা এই কফিশপে এসেছে, কেবল তারাই দেখা করতে পারবে; .
২। যতই চেষ্টা করা যাক না কেন, বর্তমান কোনভাবেই পরিবর্তিত
হবে না;
৩। অতীতে গিয়ে কোনমতেই চেয়ার ছেড়ে ওঠা যাবে না;
৪। সময় নির্দিষ্ট এবং সংক্ষিপ্ত – যতক্ষণ না তোমার সামনে রাখা
কফিভর্তি কাপটা ঠান্ডা না হচ্ছে, ঠিক ততক্ষণই; এবং
৫। তোমাকে অপেক্ষা করতে হবে। কারন সেই চেয়ারে বসে থাকে একটা
ভুত। সে যে মুহূর্তে উঠে বাথরুমে যাবে, ঠিক সেই মুহূর্তেই তোমাকে বসে পড়তে হবে, অন্যথা
ভুতকে জোর করে নড়াতে গেলে তুমি অভিশপ্ত হয়ে পড়বে।
আর হ্যাঁ, কফি
ঠান্ডা হয়ে গেলে আর ফিরে আসা যাবে না। অনন্তকাল তোমাকে এই চেয়ারে বসে থাকতে হবে, ওই
ভুতটার মতো। কারন ভুতটাও যখন কফিটা খেয়ে ফিরে আসতে চেয়েছিল, ততক্ষণে কফি ঠান্ডা হয়ে
গিয়েছিল। সে অনন্তকালের জন্য ওই চেয়ারে আটকে আছে। তার কাছে কোন অতীত নেই, কোন বর্তমান
নেই, কোন ভবিষ্যতও নেই।
মডার্ন জাপানী
গল্পে এখনও অদ্ভুতভাবে একটা স্টোরিলাইন ক্রিয়েট করার ক্ষমতা আছে। আমাদের এখানে ‘চা-আড্ডা’
টাইপ কত চা-শপ গড়ে উঠেছে, কিন্তু বাংলা সাহিত্য চা-আড্ডা-য় নেকুপুষু প্রেম কিম্বা পর্দার
আড়ালে পরকীয়া করার বাইরে, অথবা বৃদ্ধদের অতীত স্মৃতিচারণ করে খুব একাকীত্বে কষ্ট পেয়ে
পেয়ে জীবনধারন করছে টাইপ গল্প ছাড়া ভাবার ক্ষমতায়, অন্তত এখনকার লেখকেরা আসেন নি।
তো এই হল গল্প।
কিন্তু এটা আসলেই গল্প নয়। এটা গল্পের আবরণ।
চারটে গল্প এখানে
আছে। ধীরলয়ে চলা গল্প। এক-একটা সময় ধৈর্যহারা লাগে। যেন ইচ্ছা করেই অনেকটা ফেনানো হচ্ছে।
পাতা বাড়ানোর জন্যে, অথবা এটাই স্টাইল, যাই হোক না কেন, বিরক্তিকর হয়ে ওঠে কখন কখনও।
চারটে গল্পের প্রত্যেক প্রটাগনিস্ট চরিত্র ফিরে যেতে চায় – অতীতে কিম্বা ভবিষ্যতে।
কারন?
অতীতের অনুশোচনা এবং নিজেকে ক্ষমা
করা, ভালোবাসা এবং হারানোর ভয়, নিজেকে খুঁজে পাওয়া এবং জীবনের অর্থ খোঁজা, নিজের
ভয় ও দ্বন্দ্বকে মেনে নেওয়া।
মানুষ হারায়। জীবনের বাঁকে বাঁকে অনেক
কিছুই হারায়। ক্ষণকালের জন্য, চিরকালের জন্য। এমন কিছুও আমরা হারিয়ে থাকি, যা হাতের
নাগালে থেকেও নেই। দ্বিতীয় গল্পটা আমার মনকে নাড়িয়ে দিয়ে গেছে প্রবলভাবে। কোহতাকে,
নার্স, রোজ কফিশপে আসে। দেখে একটা লোক বসে আছে, ফুসাগি। ফুসাগি কোনদিনও কোহতাকে চিনতে
পারে না। সে অপেক্ষা করে কখন ভুতটা চেয়ার ছেড়ে যাবে, আর সে বসবে। কারন তার স্ত্রীকে
একটা কথা বলার ছিল, সে সেটাকে তার সাথে বয়ে নিয়ে বেড়ায়, একটা চিঠি লিখে এনভেলাপের মধ্যে
ভরে। সে সেটা স্ত্রীকে অতীতে গিয়ে দিতে চায়। সে জানে না, এই কোহতাকেই তার স্ত্রী। ফুসাগি
অ্যালঝাইমার রোগে আক্রান্ত।
এ গল্প কোহতাকের। তার অতীতে ফেরার।
চিঠিটা পড়তে চায় সে। জানতে চায় তার স্বামী ভুলে যাওয়ার আগে তাকে ঠিক কি বলতে চেয়েছিল।
প্রেম কখনো মানুষকে বাঁধে কি? হ্যাঁ, আবার না-ও। এই গল্প বড়ো মন কেমন করা গল্প। কিন্তু
চরম ফাঁকিবাজি এই গল্পেই ধরা পড়েছে। স্বামী সেই চিঠিটা নিয়ে এখনও কফিশপে আসে। এটা জানার
পরেই কোহতাই সিদ্ধান্ত নেয় অতীতে গিয়ে চিঠিটা নেবে। তার কি কোন প্রয়োজন ছিল? কেই জানে,
কাজু জানে, এমনকি তাদের কারনে এখন কোহতাকেও জানে চিঠিটা ফুসাগির কাছে সযত্নে এখনও রক্ষিত
আছে।
সোজা হিসেব --- বাড়ি যাও, স্বামীর
অন্যমনষ্কতার সুযোগে চিঠিটা হাতিয়ে পড়ে নাও। ব্যাস… হয়ে গেল। এর জন্যে অতীতে যাওয়ার
প্রয়োজন ছিল কি? এই গল্পের এটা একটা বড়ো ফাঁকি। অথচ, তা সত্ত্বেও পড়তে অসাধারণ লাগে।
চোখে জল এনে দেওয়ার মতো গল্প চতুর্থ
গল্প। আমার ফেভারিট। কেই, কফিশপের মালিকের স্ত্রী। সন্তানসম্ভবা। কফিশপে ঘটে যাওয়া
সমস্ত ঘটনার সাক্ষী। একসময় জানতে পারে তার হাতে আর সময় বেশি নেই। সে সন্তানের জন্ম
দিতে গিয়ে মারা যেতে পারে। সকলেই চায়, সে অ্যাবরশান করুক, কেই চায় না। কেই জানে, সে
অতি সাধারণ মেয়ে। সারা জীবন সে তার ভগ্নস্বাস্থ্য নিয়ে লড়তে লড়তে মনে রাখার মতো কিছুই
করতে পারে নি। এই একটা কাজ সে করে যেতে চায়। একটা প্রাণকে সে ধারণ করতে চায়। নিজের
প্রাণের বিনিময়ে। কেবল তার মনে একটাই ইচ্ছা, তার মেয়ে কি তাকে ভবিষ্যতে মনে রাখবে?
কি আকুতি তাই না? আমাকে কি কেউ মনে
রাখবে? পৃথিবী কি আমাকে মনে রাখবে? উত্তরঃ না। আর আমার আপনজনেরা? হয়তো বা, হয়তো না।
জীবন জলের মতো, কেবল বয়ে চলে। কোন এক পরিত্যক্ত ঘাটের ইঁটের পাঁজরে সে নিজেকে কখনও
আবদ্ধ করে রাখে না। এই না রাখার মধ্যেই ক্ষণিক থাকার আনন্দ। ক্ষণকালের মধ্যেই সম্পর্কের
চিরকালের বেদনার্ত আবেদন। এই চতুর্থ গল্পের ভিত্তি শুরু হয়েছে তৃতীয় গল্প থেকেই, কিন্তু
এসে মিলেছে চতুর্থ গল্পে। আমার চোখ জলে ভরে ওঠে উপন্যাস শেষ হওয়ার সাথে সাথে।
ওভাররেটেড উপন্যাস। তবুও, বড়ো মন কেমন
করা উপন্যাস। উপন্যাস পড়ার সাথে সাথে, আমার চারপাশের সম্পর্কগুলোর প্রতি আমি যেনো কোথাও
একটা টান অনুভব করি। তারা আমার কাছে মূল্যবান। এই অসীম বিশ্বে আমি কি কোথাও আছি? আমার
কি কিছুমাত্র মুল্য আছে? যদি থেকে থাকে তো সে ক্ষণিকের। আর তা কেবলমাত্র এদের কাছেই।
এদের মধ্যেই আমার যাবতীয় আমিত্ব। আর তার বাইরে যেটা আছে, সেটার অস্তিত্ব নেই। সেটা
চিরকালের মধ্যে মিশে থাকে। তাকে ধরা যায় না। তাকে ধরা দিতে হয়। সে কেমন করে?
ভেতরের দিকে একটা পথ আছে। বাইরের আঘাত
বারবার সেই পথের ঠিকানা বলে যায়। কিম্বা কোন মহাপ্রাণ কখনও কখনও কারো কারো ক্ষেত্রে
এসে তার ঠিকানা বলে যান।
আমি সেই পথনির্দেশের অপেক্ষায় থাকি…
==========================================
Before The Coffee Gets Cold
Toshikazu Kawaguchi
অনুবাদকঃ Geoffrey Trousselot
প্রকাশকঃ Picador Publishers
মুদ্রিত মূল্যঃ 550/-
ছবি কৃতজ্ঞতাঃ ইন্টারনেট
Comments
Post a Comment