ইজু সুন্দরী ও অন্যান্য গল্প




কাওয়াবাতার চিরায়ত প্রশ্ন একটিই বিষয়ে ঘোরাফেরা করে - চিরন্তনী মাধুর্যের অন্তঃস্থিত বিষন্নতা। এই মাধুর্য ও বিষন্নতার মধ্যে তার লেখা বারংবার ঘোরাফেরা করে, এমনকি ছোটগল্পেও।

      অনেক কষ্টে একটা ছোটগল্পের সংকলন জোগাড় করেছি। বর্তমানে Out Of Print. ‘ইজু নর্তকী’ সংকলনের প্রথম ছোটগল্প বলে আমি নামকরণ করেছি ইজু নর্তকী ও অন্যান্য গল্প। এই নামে ইংরাজী অনুবাদে একটা ছোট গল্প সংকলন পাই, যার নাম The Izu Dancer and Other Stories. আমার বিশ্বাস, সেই সংকলনের সঙ্গে এর কোন মিল নেই, কারণ, সেই ছোট গল্প সংকলনে একাধিক জাপানী লেখকের লেখা স্থান পেয়েছে, যার প্রথম গল্পটিই হল এইটি। আমি এই বইটি পড়তে গিয়ে দেখলাম ‘মন্ডল বুক হাউস’ থেকে এই সংকলনটি বেরিয়েছে এবং ১৩৬৭ বঙ্গাব্দেও বানান ভুল, ছাপার ভুল নিয়ে আমি গর্ব করতে পারি। মানে, যারা ‘বানাম’ ভুল ধরার পুলিশ তারা এখন এই পুরোনো বইয়ের ‘বানাম’ ভুল ধরে কেন যে বড়ো বড়ো প্রবন্ধ লিখছেন না আমার মাথায় ঢুকছে না মোটেই। মোদ্দা কথা এই সংকলনটির মধ্যে পাঁচটি গল্পের সমাহার আছে। যার মধ্যে, আমার মতে, হাড় কাঁপিয়ে দিয়েছে একটা গল্প, নভেলা বলা ভাল, প্রসুপ্ত রূপসী – The House Of Sleeping Beauty নামক লেখাটি, যাকে নিয়ে পরে বিস্তারিত আলোচনা করা যাবে।

      জেন বৌদ্ধধর্মে প্রভাবিত কাওয়াসাকি-র বেশ কয়েকটা লেখা পড়ে ফেললাম, একটাই বিষয় বারবার করে ফল্গুধারার মতো প্রবাহিত হতে থাকে তার লেখায়, আর তা হল, যে কোন রূপের মধ্যে মাধুর্য আছে, আর সেই মাধুর্যের পরিবর্তন অবশ্যম্ভাবী। আর সেই অবশ্যম্ভাবী পরিবর্তন নিয়ে আসে বিষন্নতা। কারন সেই মাধুর্যকে ধরে রাখতে গিয়ে আমরা বসবাস করি অতীতে। আর বর্তমানে থাকি অতৃপ্ত। আমাদের মধ্যে সুখ-দুঃখ খেলা করে বেড়ায়। এই ‘ইজু নর্তকী’ গল্পের কথাই ধরুন না, এক যাযাবর পরিবারের তেরো বছর বয়স্কা এক ইজু নর্তকী-কে দেখে মনে ধরে প্রোটাগনিস্ট চরিত্রের। সে তাদের সাথে থাকতে শুরু করে। প্রাণ ভরে দেখতে থাকে মেয়েটিকে। মেয়েটির সঙ্গ তার কাছে দেবদুর্লভ মনে হয়। মেয়েটিরও তাকে বেশ পছন্দ হয়। কিন্তু একসময়ে বিচ্ছেদের সময় আসে। দুঃখ আসে... “অন্ধকার হল। সমুদ্রের গন্ধ। ছেলেটির সান্নিধ্যের উত্তাপ আমার অশ্রু আর অবরোধ মানল না। সারা মাথাটা যেন পরিস্কার জল হয়ে, ফোঁটা ফোঁটা করে ঝরে পড়ছে। এখনি আর কিছুই থাকবে না।”

      এই সৌন্দর্যের মাধুর্য আর দুঃখ-বিষন্নতা কাওয়াবাতার লেখার এক অঙ্গ। বিষন্নতা কখনও কখনও একাকীত্বের দোসর হয়ে আসে। ‘পুনর্মিলন’ যুদ্ধের আগে যে মেয়েটির সাথে পরকীয়া ছিল, যুদ্ধবিদ্ধ্বস্ত সৈনিক যখন আবার তাকে দেখে তার চিরচেনা অচেনা শহরে, সে বুঝতে পারে মেয়েটি আর সেই মেয়ে নেই। দারিদ্রের সাথে যুঝতে যুঝতে, এক মুঠো অন্নের জন্যে লড়তে লড়তে তার আর সেই প্রণয়ের যাচঞা নেই, আছে কেবল টিকে থাকার মর্মান্তিক প্রয়াস। এদিকে সৈনিক যুদ্ধের ভয়াবহতা আর অযুত নিযুত প্রাণনাশ দেখতে দেখতে বুঝতে পারে এ মহাবিশ্বে তার মতো একা যেন আর কেউ নেই, কিছু নেই। সেই একাকীত্বের মধ্যে মেয়েটিকে সহ্য করতে পারে না। রূপহীনা, গুণহীনা মেয়েটি এখন যেন বালাই। তবুও, সেই যে মাধুর্য, সেই মাধুর্যের খোঁজেই সে আবার মেয়েটির সাথে ভেসে পড়ে। দিনের শেষে মানুষ বড়ো একা, অসহায় এবং মানুষই তার সম্বল।

      অথচ অতীত থেকে প্রাপ্ত এই একাকীত্ববোধ, যার মধ্যে প্রেমকে ফেলে এসেছে, তা যে কীভাবে বর্তমানকে প্রভাবিত করে, কাওয়াবাতার লেখায় বারবার উঠে আসে। এখানেও এসেছে। যক্ষ্মারোগাগ্রস্থ স্বামীকে হারিয়ে নতুন করে যখন আবার বিয়ে করে কিয়োকো, অতীতের প্রেম তাকে তাড়া করে বেড়ায়। তার স্বামী ঘরের মধ্যে থেকে তাকে দেখত, বাইরে কাজ করতে। তার হাতে থাকত একটা আয়না। সেই আয়না দিয়ে স্বামী দেখত বাইরের পৃথিবীকে। স্বামী মারা গেলে, স্বামীর বুকে আয়নার কাঁচটা রেখে দাহ করে, রেখে দেয় শুধু ফ্রেমটা। এই ফ্রেমেই নতুন করে আয়না বসায় নতুন বিয়ের পর। কিন্তু অতীতের সেই মাধুর্য তাকে তাড়া করে ফেরে। সেই ভালোবাসার মধ্যে সে নিজের পূর্ণতা পায় বলেই বর্তমান স্বামীকে বর্তমান স্বাভাবিক পূর্ণ জীবনকে সে ভয় পেতে শুরু করে। কোনটা সত্যি? সেইদিনগুলো? না এই দিনগুলো? আমরা কোথায় বাঁচি? অতীতে, না ভবিষ্যতে? বর্তমানে বাঁচতে পারি না বলেই কি এত তুলনা? এত ভয়? এত বিষন্নতা? এত একাকীত্বতা? ‘প্রতিবিম্ব’ গল্পে এই খোঁজটাই বারবার আসে। বারবার আমরা বর্তমানকে অস্বীকার করতে গিয়ে নিজেদেরকে হারিয়ে ফেলি, অসুস্থ করে ফেলি। অনেকে বলে, আগেকারদিনে যা ছিল তা নাকি কত ভাল ছিল। এটা সত্যি কথা, নাকি অতীতে বাঁচতে বাঁচতে আমাদের এমন অবস্থা হয়ে গিয়েছে যে, আমরা বর্তমানে বাঁচতে ভালোই বাসি না, বর্তমানকে বিশ্বাসও করতে পারি না। বাঙালির মধ্যে এ ব্যাপারটা খুব আছে।

      আর আছে বলেই আমরা সংশোধন করার জন্য পাগল হয়ে উঠি। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই অপরকে। আমরা মনে করে আমরাই ঠিক। ফেসবুকে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে যখন খাপ পঞ্চায়েত বসে তখন এই বিষয়টা বেশ মালুম হয়। ‘তিল’ নামক ছোট্ট গল্পটি সেই রকম। স্ত্রী-র গালে তিল। তাকে সে হাত দিয়ে বারবার অনুভব করে। স্বামীর তাতে আপত্তি, এমনকি স্ত্রী-র সন্মতিতে তাকে মারতেও দ্বিধা করে নি। একসময়, বহু পরে, যখন এই অভ্যাস চলে যায়, স্বামীর মনে তখন আর কোন প্রভাব পড়ে না। না ভাল, না মন্দ। অন্যের স্বাধীনতা কেড়ে নিজের অধীনে করার এই যে এক স্বাধীন দেশের স্বাধীন প্রচেষ্টা, যা ঘরে ঘরে চলে আসছে বহু বছর ধরে, তারই আভাস পাই এই গল্পে। যখন মানুষটি সম্পূর্ণ অধীন হয়ে যায়, আমাদের সেই পুতুলটার ওপর আর কোন টান থাকে না। বিজিত বস্তুর প্রতি কবেই বা টান থাকে?

      তবে, এ পর্যায়ের সবথেকে মারাত্মক গল্পটা হল ‘প্রসুপ্ত রমণী’। এই নভেলা সম্পর্কে যত বলব তত কম বলা হবে। বিষয়বস্তুটাই চমকে ওঠার মতো। একটা গ্রামে একটা বাড়ির একটা ঘরে সুন্দরী মেয়েদের নগ্ন ঘুম পাড়িয়ে রাখা হয়। যৌবন হারানো বৃদ্ধরা রাত্রে তাদের কাছে আসে, কেবলমাত্র ঘুমাতে। স্পর্শ করা এবং তাকিয়ে দেখা ব্যতীত আর কিছু করার অধিকার তাদের নেই। এক একদিন এক-একজন এক-এক বয়সের রূপসীদের সাহচর্য লাভ করার লাইসেন্স মেলে। কাওয়াবাতার মাস্টারপীস এই গল্পে সৌন্দর্য ঘুমিয়ে থাকে। বৃদ্ধ এগুচি সেই সৌন্দর্য তার মানবিক বিকৃতির মধ্যে পেতে চায়। পায় না। বরং নিষ্পাপ ঘুমন্ত সৌন্দর্যে সে প্রতিবার বিমোহিত হয়। তার নিজের মেয়েদের কথা মনে পড়ে, যাদের এখন বিয়ে হয়ে গেছে। প্রসুপ্ত রূপসীটিকে সে পরম মমতায় কখন যেন কম্বলে মুড়ে দেয়, যাতে তার ঠান্ডা না লাগে। কারণ সে জানে, এই মেয়েটি, অপাপবিদ্ধ মেয়েটি তার মেয়েদের মতোই অসহায়। আর যখন সকাল হয় এগুচিকে ঘিরে ধরে বার্ধক্যের বিষন্নতা। সে আবার ফিরে পেতে চায় সেই সৌন্দর্যকে। বারবার সে ফিরে আসে সেই বাড়িতে।

      বিকৃতভাব অপাপবিদ্ধ সৌন্দর্যের সামনে অসহায়। এই অসহায়তার ওপরে নিজের বিকৃতিকে প্রতিষ্ঠিত করে রাখার নামই তো ‘রে*প’। এগুচি তা পারে না, একদিন সে এক ষোড়ষীর মুখে দেখতে পায় ভগবান বুদ্ধের হাসি। বুদ্ধের মুখ আর মেয়েটির মুখ মিলেমিশে এক হয়ে যায়।

      কিন্তু সমাজ বড়ো বালাই। সে তো আর এই উত্তোরনের ধার ধারে না। একদিন দুজন ঘুমন্ত মেয়ের মাঝে যখন শুয়ে থাকতে থাকতে আবিস্কার করে যে, ঘুমের ওষুধের ওভারডোজে একটি মেয়ে মারা গেছে, সে সুন্দরের এমন সমাপ্তিতে দিশাহারা হয়ে যায়। এবং ঠিক তখনই, মৃতদেহটাকে সরাতে সরাতে যখন বাড়ির মালকিন বলে ওঠে, “দয়া করে আপনি মাথা ঘামাবেন না। আপনি শুয়ে পড়ুন। কেন ওই মেয়েটা তো রয়েছে।” কথাটা যেন এগুচির গালে ঠাস করে চড় মারে। আমার গালেও যেন সেই চড় এসে পড়ে।

এগুচির কাছে গোটা সমাজ যেন একটা বিভীষিকা হয়ে দাঁড়ায়। যেখানে প্রেম নেই, মূল্যবোধ নেই, করুণা নেই, বোধ নেই, ভালোবাসা নেই। মনুষ্যত্ব নেই। তার বুকের হৃৎপিণ্ডে কেউ যেন অমানবিকতার ছুরি চালিয়ে দেয়। আমার দম আটকে আসে এই পর্যায়ে। রাতের চন্দ্রালোক জানলা বেয়ে নেমে এসে আমার পায়ের পাতা ধুইয়ে দেয়। আমি পড়তে থাকি –

“সিঁড়ি দিয়ে মৃতদেহটা নিয়ে নেমে যাওয়ার শব্দ এগুচি শুনতে পেল।

“এই যে ঘুমের ওষুধ। কাল দেরী করে উঠবেন।”

পাশের ঘরের দরজাটা খুলে সে দেখতে পেল গায়ের চাপাটাপাগুলো, এইসব গণ্ডগোলে পড়ে গিয়েছে, আর খাটের উপর সম্পূর্ণ নগ্ন শুয়ে সেই সুন্দরী মেয়েটি। ওর নগ্ন দেহটা ঝলমল করছে।

সে ওইদিকে তাকাল।”

এই বিভীষিকার সামনে মানুষ অসহায় হয়ে ওঠে। এগুচি হতবম্ভ হয়ে যায়। পরম মমতায় যাকে বুকের মাঝে নিয়ে শুয়েছিল এক ঝটকায় সেই সুন্দর তাকে গ্রাস করে, তাকে ধ্বংস করতে উদ্যত হয়। সমাজের কাছে কি সত্যিই মানুষের উত্তোরনের কোন মূল্য নেই? সমাজ নামক যন্ত্রটিকে চালিয়ে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য তৎপর রাষ্ট্রযন্ত্রটিই কি মানুষের মূল্যবোধের শেষ কথা বলবে? কাওয়াবাতা প্রশ্ন রাখে।

      আমি রাত জেগে তার উত্তর খুঁজে চলি।

 

Comments

Popular posts from this blog

যে বুকে আগুন জ্বলে

শারদীয়া আনন্দবাজার পত্রিকা সম্পর্কে

জেরক্স কপির উন্নত ভার্সানে ‘আবার প্রলয়’ এসেছে