বাবা, পুরুষ দিবসে, এ লেখা তোমার জন্য



যারা আমাকে অনেকদিন ধরে জানেন, আমার লেখা পড়েন, তারা জানেন, আমার বাবা-মা’র প্রিয়তম যে, সে আমি নই, আমার ভাই-ও নয়, আমার জ্যেঠতুতো-খুড়তুতো বোনেরাও নয় – সে আমার গডব্রাদার, আমার পিসতুতো দাদাআমি যদি সমগ্র বিশ্বে কাউকে হিংসে করি, একমাত্র তাকেই। বাবা-মা’র ভালবাসায় ভাগ হয়ে যাওয়াটা আমি বরদাস্ত করতে পারি না, কিন্তু বরদাস্ত করতে হয়, কারন যতটুকু ঘাটতি পড়ে, তার অনেকটাই সুদে-আসলে সে কিছুটা মিটিয়ে দেয় আমাকে ভালোবেসে, বাকিটা আমি আদায় করে নিই।

      এত কথা কেন?

      কারণ, আমার পিতাঠাকুর, যার সঙ্গে কেবলমাত্র প্রিন্ট মিডিয়ার সম্পর্ক দৈনিক সংবাদপত্রের মাধ্যমে, তিনি কি না পড়ছেন একটা আস্ত বই! কাজ থেকে ফিরে, চায়ের কাপ নিয়ে, একটু একটু করে চুমুক দিয়ে প্রচন্ড মনযোগী হয়ে পড়ছেন বইটাএবং শুধু তাই নয়, বই পড়তে পড়তে মাঝে মাঝে অন্যমনস্ক হয়ে পড়ছেন, জানলার বাইরে অন্ধকারে তাকিয়ে থাকতে থাকতে কোথায় যেন হারিয়ে যাচ্ছেন! বই যে খুব পড়ছেন, তাও নয়। পড়ছেন একটু একটু করে, বর্ষাকালে গরম ধোঁয়া ওঠা সুস্বাদু খিচুড়ি গরাসে মুখে তোলার মতো করে, কোন তাড়া নেই। শুধু তাই নয়, মায়ের সাথে মাঝে মাঝেই গুটুর গুটুর গল্প করছেন, যা সংসারের হিসাব নিকাশের বাইরে। আমি বা ভাই ঘরে ঢুকলে চুপ করে যাচ্ছেনকেবল চোখে পড়ছে, মায়ের চোখেও কেমন যেন একটা আদুল মেদুল ভাব।

এ কি রে বাবা! হচ্ছেটা কি? এতএব, তদন্ত অবশ্যম্ভাবী।

      বইটার নাম ‘ঝাল লজেন’। লেখক স্মরণজিৎ চক্রবর্তী। আমি দেখলাম আড়চোখে, কায়দা করে। এও জানলাম, প্রেরক আমার গডব্রাদার। বইয়ের প্রচ্ছদ হুবহু টিনটিনের প্রচ্ছদের প্যাটার্নগুলোকে মনে করিয়ে দেয়।

      কিন্তু এটা ঠিক আমার হজম হল না। কি আছে ও বইতে? এত মনযোগ দেওয়ার মতো লেখক স্মরণজিৎ চক্কোত্তি আবার কবে থেকে হলেন! মা’র কাছে শুনলাম, গডব্রাদার বইটা বাবাকে দিয়েছে। বলেছে পড়তে, তার না কি ভাল লাগবে। আমার মাথা ঘুরে যাওয়ার জোগাড়! রবীন্দ্রনাথ না, সুনীল না, এমনকি শংকর-সুনীল-সমরেশ না --- এক্কেবারে স্মরণজিৎ! পাগলা করেছে কি! এদিকে ঝাঁঝেই যে আমার মরণ হওয়ার উপক্রম!

      বাবার কিছু কিছু জিনিসে আমার অধিকার আছে। তার অমন সুন্দর চশমার ফ্রেমটা হাতিয়েছি, তার কয়েকটা গোলগলা এবং গোল-না-গলা-কলারওলা টি-শার্ট হাতিয়েছি, তার কিছু কিছু শার্ট, পছন্দ হলে মাঝে মাঝে পড়েছি (বাড়ীতেই), তার প্যাকেট থেকে, ইয়ে মানে, লজ্জার মাথা খেয়েই বলছি, এক-আধবার সিগারেট নিয়ে টেনেছিওহাজার হোক, আমার বাবা যা যা করে, সেগুলোর মধ্যে যেগুলো আমাকে কৌতুহলী করে তোলে, আমাকেও সেগুলো করতে হবে বৈ কি। এমনকি কিশোরীবেলায়, বাবার অত্তোবড়ো সাইকেলটা চালাতে গিয়ে ড্রেনে গিয়ে পড়েছি, বাবা আর ভাই এসে উদ্ধার করেছেনবাবা চালাতেন বলে কথা, আমি তো চালাবোই! মা বলে, আমি না কি আমার বাবার ফিমেল ভার্সান।

      এতএব, বইটা একদিন চুরি করলাম। শুক্রবার বাবা গেলেন পিসীর বাড়ি। দুদিন থেকে সোমবার কাজ সেরে একবারে ফিরবেন। আমার হাতে তিনদিন সময়। তিনদিন স্মরণজিতের জন্য যথেষ্ট।

     

      “যারা পুরোনো ভাঙা পেন ফেলতে পারে না। ক্লাস টু-তে নীল রঙের হারানো একপাটি মোজার শোকে আজও কাতর হয়। যারা ছোটবেলায় ডনাল্ড ডাক আঁকা টিফিনবক্সের ঢাকনা জমিয়ে রাখে। সবার থেকে লুকিয়ে রাখে কাচের গুলির সেই গুপ্তধন। যারা স্কুলে প্রাইজ পাওয়া নিকেল করা মেডেল রেখে দেয় যত্ন করে। রেখে দেয় ছিঁড়ে যাওয়া প্রথম পড়ার বই। রঙচটা ডায়রির ভাঁজে গোপন সুগন্ধী কাগজের চিঠি, খাম। জমিয়ে রাখে বাসের টিকিট, ট্রামের টিকিট। সেই ‘তার’ দেওয়া লজেন্স আর চকোলেটের র‍্যাপার। বন্ধ হয়ে যাওয়া প্রথম ঘড়ি। ভুল করে ফেলে যাওয়া চুলের ক্লীপ। মায়ের কাঠের বাক্সে খুঁজে পাওয়া ছোট্ট সোনালী সেফটিপিন। ক্ষয়ে যাওয়া গন্ধ রাবার। আর শত চেষ্টা করেও যারা আজও ভুলতে পারে না সেই ফোন নাম্বার।” তাদের---

      স্মরণজিৎ চক্রবর্তী উৎসর্গ করেছেন এদের। আমার বাবা কি এদেরই একজন? আমি পড়তে শুরু করি বইটা...

আমি কোনদিন ছ-কোনা কুড়ি পয়সার মুল্য বুঝতে পারব না; আমি কোনদিন ভোকাট্টা বুঝতে পারব না; বুঝতে পারব না টিকটিকি লজেন্স কিম্বা ট্রাম্প কার্ডের মহিমা; কেরোসিন তেলের ল্যাম্ফো কিম্বা হ্যাজাক বাতির মায়া আমি জানি না; কৃশানু দে-র অতিমানবিকতা কোনদিন দেখবও না; রবীন্দ্র জয়ন্তীতে ভুলে যাওয়া কবিতাকে মনে করার চেষ্টা করা হতবুদ্ধি বালককে আমার কোনদিন আবিস্কার করা হবে না; একান্নবর্তী পরিবারের একটাই উঠানে আমার কোনদিন চড়ুইভাতি করা হবে না; পাঁচদাড়ি অ্যান্টেনা কিম্বা জিলিপি অ্যান্টেনা --- আমি শুনেইছি কেবল; রেডিওর নব ঘুরিয়ে ‘শনিবারের বারবেলা’ কিম্বা ‘দর্শকের দরবারে’ আমি ভাবতেও পারি না; ‘হরেকরকমবা’ কিম্বা ‘নববর্ষের বৈঠক’-এর গল্পই শুধু আমার শোনা হবে; গোল্ডস্পট কোল্ড ড্রিংক্সের বোতলের আইকন কেবল ছবিতেই দেখেছি; যদিও ছাদে মাঞ্জা দেওয়া ইন্টারন্যাশনাল ঘুড়ি-খিলাড়িদের আমি দেখেছি কিন্তু মার্বেল-ডাঙ্গুলি খেলা ছোকরা আমি দেখি নি।

বাবা এসব দেখেছেন। কলকাতার নিকটবর্তী এক মফস্বলে তিনি যখন বড় হচ্ছেন, কিশোরবেলাকার দাড়িগোঁফ গজাবার আগে যখন তার বিস্ময়কর চোখ লোডশেডিং হওয়া রাতের ছাদে কালপুরুষের শিকারী কুকুর খুঁজছে, একটাই হ্যারিকেনের চারপাশে তারা ভাইবোন মিলে পরের দিনের স্কুলের হোম ওয়ার্ক করছেন, তখন তার ওই বড়ো হওয়াটার মধ্যে যে বিস্ময়বোধ লুকিয়েছিল, বড়োভাই, সংসারী এবং আমাদের ছোট্ট সংসারের অধিনায়ক এই মানুষটা সেখান থেকে কোন টিনের বাক্স নিজের জন্যে আনেন নি। সেই টিনের বাক্স তার বুকের মধ্যে অজ্ঞাতবাস করছে। তাকে তিনি হয়তো ভুলেই গেছিলেন। গন্ধ কাগজের গোলাপী পত্রগুচ্ছ বৃষ্টির জলে ভেসে গেছে নৌকা হয়ে, কিম্বা ফেলে আসা ভাড়াবাড়ির দেরাজের অন্ধকারে মিলিয়ে গেছে... তার মুখ হয়তো তার কখনও মনে পড়েও মনে পড়ে না। তার কাছে সে সেপিয়া টোনের মুখের বয়স বাড়ে নি, হয়তো দুপাশে বেণীবাধা সে স্মৃতিমুখ তিনি আজকের স্খলিত শিথিল কাঁচাপাকা চুলের মাঝখানে রঙীন করে দেখতেও চান না। সেই স্মৃতি-বিস্মৃতির মধ্যে যে হারিয়ে যেতে বসেছে তাকে নতুন প্রাণদান করেছেন স্মরণজিৎ চক্রবর্তী, বাবার সমসাময়িক বাবার সহোদর, যা কি না বাবা, কিম্বা তার মতো আরও আরও লক্ষ লক্ষ মানুষের সময়ের প্রতিনিধি। পার্থক্য এই, স্মরণজিৎ লিখতে পারেন, আর আমার বাবা গুছিয়ে সেটা বলতেও পারেন না। কিন্তু স্মরণজিতের লেখার মধ্যে তিনি নিজেকে খুঁজে পান। মায়ের (আমার ঠাকুমা) একটু স্পর্শ, যে স্পর্শের কাঙাল তিনি, আজীবন, শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত কাঙালই থেকে যাবেন, স্মরণজিতের মতো।

পড়তে পড়তে আমি বুঝতে পারছি কেন বাবার এত ভালো লেগেছে।

এ বই ভালো, না মন্দ? খুঁত আছে, না নেই? সেই খোঁজে আমি নেই। আমার বাবাকে তিনি এক জানলা আকাশ দিয়েছেন। এতেই আমি কৃতজ্ঞ। কৃতজ্ঞতায় বিচার হয় না। আমি কৃতজ্ঞ বিচারক হতে গিয়ে অকৃতজ্ঞ কন্যা হতে রাজী নই।

================

বিঃ দ্রঃ – ছবিটা রৌদ্র মিত্র-র টাইম লাইন থেকে নেওয়া। কারণ, বইটা পড়তে আমার আরও দুদিন বেশি লেগেছিল। বাবা ফিরে এসে হন্যে হয়ে খুঁজেছিল। পায় নি। আমি চোর। চোর কি কখনও বামাল সমেত গ্রেপ্তার হতে চায়? পরে খবরের কাগজের ডাঁইতে পুস্তকপ্রাপ্তি হয়ে হারানিধি পাওয়ার মতো বাবা আবার পড়তে শুরু করেছেন। ছবি তুলতে গিয়ে মায়ের কাছে জানতে পারি, বইটা বাবা তার ব্যাগের মধ্যে ঢুকিয়ে রেখেছেনকাজের জায়গাতেও সময় পেলে না কি একটু একটু পড়ছেন এতএব... মাঝখান থেকে আমি মায়ের কাছে ধরা খেয়ে গেলাম। শাস্তি – বেলনের ঠকাস্‌।

================

ঝাল লজেন

স্মরণজিৎ চক্রবর্তী

আনন্দ পাবলিশার্স

মুদ্রিত মূল্যঃ ৪৫০/-

Comments

Popular posts from this blog

যে বুকে আগুন জ্বলে

শারদীয়া আনন্দবাজার পত্রিকা সম্পর্কে

জেরক্স কপির উন্নত ভার্সানে ‘আবার প্রলয়’ এসেছে