বিউটি অ্যান্ড স্যাডনেস
*** বিধিসন্মত সতর্কীকরণঃ রিভিউটা একটু ধীরে ধীরে, সময় নিয়ে পড়বেন, নচেৎ পড়বেন না। জটিল জিনিস, বুঝতে গেলে, সময় দিতে হয়।
এবার শুরু করা
যাক ---
আমি না, সত্যি বলতে, এখনও ঠিক ধাতস্থ
হয়ে উঠতে পারি নি।
এ আমি কি পড়লাম!
কাওয়াবাতা'র Beauty And Sadness আমাকে
যেন ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছে। সম্পর্কের টানাপোড়েন এক জিনিস। কিন্তু সম্পর্কের মধ্যে
এক জটিল ধ্বংসাত্মক অন্ধকার, এক অন্ধ আবেগ ও মারণতৃষ্ণার উদগ্রতা, অতীতের জ্বলন্ত যন্ত্রনা
বর্তমানে কাছের মানুষটার মধ্যে দিয়ে বীভৎসতার আর্তনাদ আমাকে বিহ্বল করে তুলেছে।
ব্যাপারটা আগে বোঝা দরকার।
ষোল বছরের ওটোকো প্রেমে পড়ে বিয়াল্লিশ
বছরের সাহিত্যিক, বিবাহিত এবং এক পুত্রের জনক ওকি'র। ওটোকো প্রেগনেন্ট হয়ে পড়ে। তাদের
সন্তানটি প্রসবের পরে মারা যায়। ওটোকো আত্মহত্যার চেষ্টা করে। ওকি এবং ওটোকোর মায়ের
চেষ্টায় সে বেঁচে ফিরে আসে। ওটোকোকে নিয়ে তার মা চলে যায় টোকিও থেকে অনেক দূরে। ওকি
নিজেদের এই সম্পর্ক নিয়ে একটি বই লেখে, Girl Of Sixteen. বইটি বহুল জনপ্রিয় হয়। লেখকের
স্ত্রী ফুকুমা প্রথমে পাগলের মতো হয়ে গেলেও যখন দেখে এই বইটিই তাদের সংসারের স্বচ্ছলতার
কারণ, মেনে নেয় সব কিছু। ওকি আর ওটোকোর মধ্যে কোন যোগাযোগ থাকে না। এইভাবেই কেটে যায়
অনেক বছর।
অনেক বছর পর, ওকি জানতে পারে ওটোকো
এখন প্রখ্যাত চিত্রশিল্পী। সে দেখা করে, একবেলার জন্য। এবং সে মুখোমুখি হয় ওটোকোর প্রটিজি'র
সাথে, কেইকো তার নাম।
গল্পটা শুরু হয় ঠিক এইখান থেকে, এ
গল্প কেইকোর অন্ধ আবেগ, ভালোবাসা এবং প্রতিশোধের গল্প।
যদি মনে হয়, এ আর নতুন কি? তাহলে কয়েকটা
টার্ম একটু বুঝে নেওয়া যাক। নাহলে বোঝা সম্ভব নয় আমি কেন কেইকো'র কথা লিখতে চাইছি---
১। OLD - Obsessive Love Disorser - ভালোবাসার নামে কেউ যদি
প্রেমাষ্পদকে সম্পূর্ণ নিজের অধিকারে রাখতে চায়, সেক্ষেত্রে সে এই মানসিক রোগের শিকার।
সমস্যার ব্যাপার, এই ক্ষেত্রে, এই রোগী নিজেকেই প্রেমাষ্পদ মনে করে। একধরনের নার্সিসিস্টিক
অ্যাটিটিউড, যাকে Mirror Love বলে, যা পার্টনারের হয়ে নিজে থেকেই সিদ্ধান্ত নেয়। কেইকো
কখন যেন ওটোকো হয়ে যায়। ওটোকো কোন প্রতিশোধের কথা তো দূর, তার অতীত থেকেই বেরিয়ে এসে
যখন নিজের মতো করে জীবনটাকে গুছিয়ে নিয়েছে কেইকোর সাথে, তখন কেইকোর মনে হয় ওটোকোর প্রতিশোধ
নেওয়া উচিৎ। শুধু মনে হওয়াই নয়, কেইকো প্রতিশোধ নিতে বদ্ধপরিকর।
সম্পর্কের মধ্যেকার এই আবেগ বড়ো ভয়ঙ্কর।
নিজের প্রেমাষ্পদেষুকে নিজের করে রাখতে আমি কতদূর অন্ধকারে যাওয়ার কথা ভাবতে পারি?
হত্যা কিম্বা আত্মহত্যা এখানে অনেক দূরের কথা। নিজের সন্মান, নিজের কাজ, নিজের ভালো
লাগা মন্দ লাগা কিম্বা নিজের সমস্ত স্বত্ত্বাকে এক লহমায় বিসর্জন দিয়ে দেওয়া যায়। এমনকি
প্রেমাষ্পদেষুর জন্যে হাসিমুখে এক বা একাধিকবার নিজের দেহকেও বিকিয়ে দিতে দ্বিধাবোধ
করি না। এমনটা কি করা যায়? যায়।
কেইকোর মনে হয়েছিল, ওটোকোর সন্তানকে
সে ফিরিয়ে আনতে পারে, নিজের দেহের মধ্যে দিয়ে। তার জন্যে সে ওকির বিছানায় যেতে কোনরকম
জড়তা নেই। এমনকি সেই সময়েও সে নিজের দেহটাকে ব্যবহার করে মাত্র। সেখানে প্রেম নেই,
ঘৃণা আছে। সেখানে স্নিগ্ধতা নেই, উদ্দেশ্য আছে।
বাবা কিম্বা ছেলে --- কোন একজনকে কেইকো'র
চাই। অর্থাৎ, প্রতিশোধের জন্য সে শুধু টার্গেট খুঁজছে। মানুষের মনে কি এমন বোধ জন্মায়
যে, যাতে করে, সে প্রেমাষ্পদেষুর জন্যে তার পরিবারের যে কোন সদস্যের কাছে কিম্বা তার
বন্ধুবান্ধব, আত্মীয় বা কাজের জায়গায় সে নিজের দেহ বিকিয়ে দিয়ে পারে, হেলায়? এত্তো
ভালোবাসা! এ কি ভালোবাসা? না কি উন্মত্ত বিকৃতি? কেন এই বিকৃতি?
এই অন্ধকারের মধ্যে কেইকো হারিয়ে যায়।
এই অন্ধকারে কেইকোর সাথে আমিও হারিয়ে যাই…
২। Power Dynamics - অতীত মানুষকে ছাড়ে না, সে তার পিছে পিছে
বারবার ফিরে আসে। কাওয়াবাতার উপন্যাসে এ বড্ড বেশি চোখে পড়ে। যখন কেইকো ওটোকোর জীবনে
শিষ্যা হয়ে আসে, কেইকো'র সেই বয়স, যে বয়সে ওটোকো ওকি'র কাছে গিয়েছিল। ওকি'র প্রেমিক
সত্ত্বা ওটোকো'র স্বত্ত্বার মধ্যে ভর করে। তাদের মধ্যে যে সম্পর্ক তৈরী হয়, অবচেতনেই
ওটোকো কেইকোকে দখল করে ওকি'র মতো করে।
নতুন সম্পর্কের মধ্যে অতীতের ট্রমা
যদি কাজ করে, তাহলে তার প্রভাব পড়বেই পড়বে, অবচেতনে হলেও। কারো অতীত যদি বিষন্নতায়
ডুবে যাওয়া অতীত হয়, সে কি বর্তমানকে স্বাভাবিকভাবে নিতে পারে? যে তার জীবনে এসেছে,
তাকে কি তার মতো করে বিশ্বাস করা যেতে পারে? পারে। কিন্তু সকলে কি পারে? না। ওটোকো
পারে নি। সে অতীতের সূত্র ধরে ঠিক একই সম্পর্কে নিজেকে জুড়ে নিয়ে নিজের অধরা সম্পর্ককে
পূর্ণ করতে চাইছে।
ফলে ওটোকোর মনের ভেতরের অপরাধবোধ তাকে
তাড়া করে বেড়ায়। কিন্তু শেষ হয় না। সে বারবার সব দোষ নিজের ঘাড়ে নেয় দোষী না হয়েও।
এই অদ্ভুত এক জটিলতার মধ্যে ওটোকো শান্ত, বিষন্ন, একাকী এবং অসহায়। অতীত এবং বর্তমান
চরিত্রের মধ্যে সমান্তরাল অবস্থান করে বলে মানুষ এই পর্যায়ে বড়ো অসহায় হয়ে পড়ে।
৩। Physical Attraction – যৌ*তার অর্থ কি? কেন যৌ*তা? কজন মানুষ
সারা জীবনব্যাপী স্ট্রেট পার্সোনালিটিতে থাকে? আমার মনে হয়ে অধিকাংশ মানুষ বাইসেক্সুয়াল।
মনে পড়ে, রবীন্দ্রনাথ নিজেকে নারী কল্পনা করে এঁকেছিলেন। যে কোন শিল্পসত্ত্বাতেই, আমার
মনে হয়, অল্পবিস্তর পুরুষ এবং নারী সত্ত্বা একত্রে অবস্থান করে, তাৎপর্যপূর্ণভাবে।
না হলে সে শিল্পের মধ্যে দুই সত্ত্বার মেলবন্ধন করবে কি করে?
আমার মনে হয়, যৌ*তার মধ্যে একটা বড়ো
ব্যাপার কাজ করে তার মানসিক টানাপোড়েন। সেই টানাপোড়েনে সে নিজে কখনও নারী কখনও পুরুষ।
আসল কথা, যে মানুষটিকে তার কাছের কিম্বা প্রাণের মনে হচ্ছে তার সাথে কিভাবে কমিউনিকেট
করা যায়? শারীরিকের থেকেও অনেকটা বেশি।মানসিক ব্যাপারটা কাজ করে। শরীর মনের সাথে সাথে
সাড়া দেয়।
আর তাই, এখানে ওটোকো কিম্বা কেইকোকে
তেমন করে লে*বিয়ান ভাববার কোন কারন নেই, যতই তাদের মধ্যেকার ঘণিষ্ঠতা থাকুক। তাদের
এই শারীরিক আকর্ষণের পিছনে তাদের দুজনের প্রতি দুজনের অন্ধ আবেগ কাজ করে। একজনের ক্ষেত্রে
অতীত ট্রমা ও বর্তমানের একাকীত্বতা, অপরজনের ক্ষেত্রে টিন-এজ কৌতুহল এবং উদগ্রভাবে
কারো কাছে আশ্রিতা থাকবার ইচ্ছা। কারণ এখানেও অতীত কাজ করে, কেইকোর ক্ষেত্রে মা-বাবা নেই, দাদার কাছে সে বোঝা। অর্থাৎ, সে এমন
কাউকে খুঁজছে যে তাকে আপনজনের স্নেহ দেবে। সেই স্নেহকে ধরে রাখতে যতদুর যেতে হয়, সে
যেতে পারে।
এইসবের মাঝেও কাওয়াবাতা আর্ট, বিশেষ
করে পেইন্টিং এবং কবিতা, জাপানের স্থান মাহাত্ম্য ও তার ইতিহাস বলে গেছেন। জাপানের
আর্ট সম্পর্কে একটা ধারনা তিনি দিয়েছেন, বিশেষত চিত্রশিল্পে। কি অগাধ পান্ডিত্য মানুষটার!
আর নিজেকে শুধুমাত্র সাহিত্যেই আবদ্ধ করেন নি। জাপানের ইতিহাস, আর্ট আর কালচার নিয়ে
ক্রমাগত আমাদের ঋদ্ধ করে গেছেন। এই উপন্যাসে এই ভয়ানক জটিলতার মধ্যেও আমি তার এই রিপ্রেসেন্টেশান
দেখে হতবাক হয়ে গেছি। একটা উপন্যাসকে কিভাবে সমৃদ্ধ করা যায়, কাওয়াবাতার Beauty
and Sadness বড়ো উদাহরন।
এই উপন্যাসের আরেকটা বড়ো ব্যাপার হল,
প্রতীকের ব্যবহার। অদ্ভুতভাবে কোন ঘটনার মধ্যে একটা তুচ্ছ ঘটনা কিম্বা প্রকৃতিকে জুড়ে
দেওয়া --- কাওয়াবাতা'র সিগনেচার। এই সিগনেচারের ব্যবহার চরিত্রগুলোর শেডে আরও লেয়ার
ফেলেছে। আর আমি, সেই লেয়ারের মাঝে হারিয়ে গিয়েছি বারংবার।
মানুষ বড়ো জটিল। একই মানুষে আলো এবং
অন্ধকার আছে। আর সে অন্ধকার যে কী মাত্রায় তীব্র, ভাষায় বলা যায় না। কিন্তু কাওয়াবাতা
বলতে পেরেছেন। জটিল থেকে জটিলতর, গম্য থেকে
অগম্যের পথে পাড়ি দিয়েছেন। এবং আমাকে হতভম্ব করে কখন যেন, মাঝরাত শেষ করে, ভোরের পাখির
ডাকে উপন্যাসের সমাপ্তি টেনেছেন, টেরও পাই নি। এখনও যখন, আমি এই লেখাটা লিখছি, মনে
হচ্ছে ডানাকাটা সুন্দরী কেইকো যেন আমার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। আর তার উপস্থিতি আমার শিড়দাঁড়ায় একটা ভয়ের শিড়শিড়ানি জাগিয়ে তুলছে
ক্রমাগত।
শেষ কথা,
আমার এখনও মনে হচ্ছে, আমার পুরোটা বলে উঠতে পারি নি।
==============
Beauty And Sadness
Yasunari Kawabata
অনুবাদক: Edward G.
Seidensticker
Penguin Publication
মুদ্রিত মূল্যঃ ৪৯৯/-
ছবি কৃতজ্ঞতাঃ সমর্পিতা
Comments
Post a Comment