স্নো কান্ট্রি



১৯৬৮ সালে প্রথম সাহিত্যে নোবেল পেলেন এশিয়ার দ্বিতীয় যে জাপানী ব্যক্তিটি, তিনি কাওয়াবাতা ইয়াসুনারি। জাপানের সাহিত্য জগতের যে কয়েকজন দিকপাল জন্মেছেন কাওয়াবাতা তাদের অন্যতম। কাওয়াবাতার নাম আগে শুনিনি, পড়া তো অনেক দূর অস্ত।

আমাদের এখানে জাপানী সাহিত্য নিয়ে আমরা মুরাকারি কিম্বা হিগাশিনোর বেশি এগোতে পারি নি। এই কথা বললেই যারা হইহই করে এগিয়ে এসে আরও কয়েকজন জাপানী ধ্রুপদী সাহিত্যিকের নাম শুনিয়ে দেবেন, তাদের কড়জোড়ে বলি, দয়া করে সাহিত্য গ্রুপের সদস্যদের মুখোমুখি হয়ে জিজ্ঞাসা করুন পাঁচজন জাপানী ধ্রুপদী সাহিত্যিকের নাম ও তাদের কটা বই তারা পড়েছেন সে নিয়ে সুচিন্তিত আলোচনা। তাহলেই মালুম পাবেন আমার কথা। আমি স্কুল কিম্বা কলেজ স্টুডেন্টদের তো বাদই দিলাম।

তো, এই কাওয়াবাতার ঠিক কোন উপন্যাস দিয়ে শুরু করব, আমাকে কে বলবে? এতঃপর ইন্টারনেটের স্মরণাপন্ন হলাম, অধিকাংশই সমস্বরে বলল, স্নো কান্ট্রি। গডব্রাদারকে ফোন দিলাম। সে বললে, ‘স্নো কান্ট্রি’ ট্রাই করে দেখতে পারিস।

এতএব, মহাজনো যেনো গত স পন্থাঃ!

      কাওয়াবাতা’র ‘ইয়ুকিগুনি’ থুড়ি ‘স্নো কান্ট্রি’ পড়তে গিয়ে প্রথমেই আমার যা মনে হল, তা হল, তার উপন্যাসে প্রকৃতি এবং মানুষ হাত ধরাধরি করে চলে। এক তুষারাবৃত স্টেশনে এসে গাড়ি থামে। একটি মেয়ে, ইয়োকো, জানালা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে স্টেশান মাস্টারের সাথে কথা বলে, তার ভাইয়ের ব্যাপারে খোঁজ নেয়, যে কি না এই স্টেশানেই কাজ করছে। প্রোটাগনিস্ট চরিত্র শিমামুরা, তার সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়। ট্রেন চলতে শুরু করে। ট্রেনের বাইরের সন্ধ্যাপ্রকৃতির আর ভেতরে নারীপ্রকৃতির টানাপোড়েনে শিমামুরার মন এক অদ্ভুত জগতে প্রবেশ করে।

      আমি যেন রবীন্দ্রনাথ পড়ছি, মনে হয়।

      “In the depths of the mirror the evening landscape moved by, the mirror and the reflected figures like motion pictures superimposed one on the other. The figures and the background were unrelated, and yet the figures, transparent and intangible, and the background, dim in the gathering darkness, melted together into a sort of symbolic world not of this world. Particularly when a light out in the mountains shone in the center of the girl's face, Shimamura felt his chest rise at the inexpressible beauty of it.

The montain sky still carried traces of evening red. Individual shapes were clear far into the distance, but the monotonous mountain landscape, undistinguished for mile after mile, seemed all the more undistinguished for having lost its last traces of color. There was nothing in it to catch the eye, and it seemed to flow along in a wide, unformed emotion. That was of course because the girl's face was floating over it. Cut off by the face, the evening landscape moved steadily by around its outlines. The face too seemed transparent—but was it really transparent? Shimamura had the illusion that the evening landscape was actually passing over the face, and the flow did not stop to let him be sure it was not.”

এ গল্প শিমামুরা আর ইয়োকো’র নয়। এ গল্প শিমামুরা আর কিমোকো’র। কিমোকো একজন গেইশা। গেইশা কি? “a Japanese girl or woman who is trained to provide entertaining and lighthearted company especially for a man or a group of men.” আমাদের এখানে বাঈজি-ই জাপানে গেইশা

কাওয়াবাতার উপন্যাসে এক অনাদিকালের বিষন্নতা গ্রাস করে। সম্পর্কে, মনে, এমনকি লোকসমাজে। তুষারাবৃত এই গ্রাম যেন বহির্বিচ্ছিন্ন। এখানে মানুষ আটকে আছে এক অদ্ভুত একাকীত্বের মধ্যে। শিমামুরাকে সেই একাকীত্ব দিশেহারা করে উদভ্রান্ত করে তোলে। কিমোকো এই শুভ্র বিষাদের টানাপোড়েনে নিজেকে ক্ষয় করতে থাকে আস্তে আস্তে।

কিমোকো সুন্দরী, তার সৌন্দর্য আস্তে আস্তে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে বয়স এবং জীবনযুদ্ধের কারনে। একাকীত্ব, বিষন্নতা আর জটিল সম্পর্কের মধ্যে দিয়ে কিমোকো হারিয়ে যাচ্ছে নিজের মধ্যে নিজেই। তা টের পায় শিমামুরা। তা টের পায় ইয়োকো। জটিল সম্পর্কের এই যে যাত্রাপথ, কাওয়াবাতা লিখতে চেয়েছেন তার কথকতা।

কাওয়াবাতার উপন্যাসে বিশাল কোন গল্প নেই। এক সহজ সরল সাদামাটা গল্প। কিন্তু নির্জন ধুসর শীতল প্রকৃতির মধ্যে মানুষের সম্পর্কের মধ্যেকার শীতলতাকে এমন সুন্দরভাবে কয়জন লিখতে পেরেছেন? কাওয়াবাতা পেরেছেন। কাওয়াবাতা এই প্রকৃতি বর্ননার মধ্যেই প্রতীক এবং রূপক বর্ননা করেছেন। ঋতু পরিবর্তনের সাথে সাথে প্রত্যেকেরই আস্তে আস্তে পরিবর্তন হচ্ছে। সম্পর্কের জটিলতা বাড়ছে, অথচ তার মধ্যেও একাকীত্বতা, বিচ্ছিন্নতা ফল্গুধারার মতো বয়ে চলেছে প্রত্যেকের অন্তরে অন্তরে।

এই উপন্যাসের আরেকটা বড়ো সমস্যা জাপানী সংস্কৃতি এবং ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট। তাদের আনন্দোৎসব জনজীবনের ছোটখাটো আচার-অনুষ্ঠান সম্পর্কে পাশাপাশি পড়ে নিতে থাকলে কাওয়াবাতার জাপানকে বুঝতে সুবিধা হবে। 

কাওয়াবাতার ‘স্নো কান্ট্রি’ অনির্দেশ্যতা এবং ক্ষণস্থায়িত্বের কথা বলে। কাওয়াবাতার চরিত্রগুলো কি সেই কারনেই খানিক দিশেহারা? তারা কি জানে তারা কি করছে? কেন করছে? তারা নিজেদের সাথে লড়তে লড়তে কোথাও যেন ক্লান্ত হয়ে হাল ছেড়ে দেয়। কাওয়াবাতার শিমামুরা কোন সম্পর্কেই টিকে থাকতে পারে না। টোকিও থেকে এই অজ গ্রামে চলে আসে, এমনিই। সে তার স্ত্রী-সন্তানদের  সাথেও যেমন বেশিক্ষণ থাকতে পারে না, আবার কোমাকো-র সান্নিধ্যও বেশি পছন্দ হয় না। কোমাকো-ও এমনই এক দ্বন্দ্বে ভোগে। সে জানে, তার ক্ষণস্থায়ী, অথচ, জীবন অনেক বড়ো। ব্যর্থ। এই অপুর্ণতা এবং অসম্পূর্ণ প্রেম তাদের বিছিন্ন করে রাখে সারা উপন্যাস জুড়ে, এক কাব্যিক নান্দনিকতায়।

আর এই নান্দনিকতার রূপকার কাওয়াবাতা আমায় মুগ্ধ করে রাখে। আমি তার পরের উপন্যাস খুঁজি। অপেক্ষায় থাকি তার আরেকটা লেখা হাতে পাওয়ার জন্য।

=====================

Snow Country

Yasunari Kawabata

অনুবাদক: Edward G. Seidensticker

Penguin Publication

মুদ্রিত মূল্যঃ 499/-

ছবি কৃতজ্ঞতাঃ সমর্পিতা

Comments

Popular posts from this blog

যে বুকে আগুন জ্বলে

শারদীয়া আনন্দবাজার পত্রিকা সম্পর্কে

জেরক্স কপির উন্নত ভার্সানে ‘আবার প্রলয়’ এসেছে