শারদীয়া ২০২৪
১
লেখিকাকে যখন জিজ্ঞাসা করেছিলাম,
এই গল্পের বিষয়বস্তু কি? উনি উত্তর দিয়েছিলেন, সেটা জানতে গেলে তো পড়তে হবে।
ভাগ্যিস কথাটা বলেছিলেন!
সর্বাণী মুখোপাধ্যায় আমাকে
প্রতিবারই চমকে দেন তার লেখার বিষয়বস্তুর জন্য। এমন অ-সাধারণ সব বিষয়বস্তু বাছেন,
যা একদিক থেকে অস্বস্তিকর, কিন্তু অন্যদিক থেকে প্রয়োজনীয়ও বটে। ‘যো*নিকীট’
উপন্যাসটিতে প্রথম নজর কাড়েন উনি। ওই একটি মাত্র উপন্যাস, যা ওনার লেখা, নিয়ে
লাগামছাড়া হইচই পড়ে গিয়েছিল।
তার কারণ, শিরোনামের অভিঘাত
অধিকাংশ বাংলার তথাকথিত ভদ্র শিক্ষিত পাঠককূল সহ্য করতে পারেননি। বিষয়বস্তুতে
যাওয়া তো আরও দূরের কথা। যারা বইটার মধ্যে আদিম কদর্যতা খুঁজতে গিয়েছিলেন, তাদের
অধিকাংশই হতাশ হয়ে আরও ক্ষিপ্ত হয়েছিলেন, আর বাকিরা বিস্মিত হয়েছিলেন।
আমি বিস্মিত হয়েছিলাম, লেখিকার
সাহস দেখে। লেখিকার লেখার ক্ষমতা দেখে।
তার পরের বছরের এবং এই বছরের
উপন্যাস নিয়ে তেমন কোন আলোচনা হয় নি। কারণ অমন কোন শিরোনাম উনি ব্যবহার করতে পারেন
নি। অথচ, এই উপন্যাসের বিষয়বস্তু নিয়ে লেখার কথা খুব কম লেখক ভাবতে পারেন। লিখেছেন
কজন, আমি জানি না। আমার পড়া এই প্রথম।
লেখার বিষয়বস্তু ইন্টারসে*ক্স, অর্থাৎ
হার্মাফ্রোডাইট, অর্থাৎ উভলি*ঙ্গ মানুষ।
সমাজ একটা ধরাবাধা নিয়ম বেঁধে
দেয়। প্রকৃতির অনুকূলে থাকা অধিকাংশ জীবজগৎ এই সাধারণ বাঁধা পথে চলে আসে। কিন্তু
প্রকৃতিও বেখেয়ালি হয়। সে যখন চিরায়ত পথ ছেড়ে একটি-দুটি গলিপথ তৈরী করে ফেলে, তখন,
সেই পথে হাটা তো দূর অস্ত, সেই পথের দিকে তাকানোটাই অনেকসময় অত্যন্ত অস্বস্তিকর
হয়ে পড়ে। আর দেখতে দেখতে কখন যেন সেই অব্যবহৃত গলিপথটি প্রকৃতিরই দেওয়া নরম ঘাসের
মধ্যে হারিয়ে যায়। সমাজ হাফ ছেড়ে বাঁচে।
উভলিঙ্গ মানুষের অবস্থা LGBTQ+ থেকেও বোধহয়
করুণ। এই
করুণতার একটুকরো চালচিত্রই হল এই উপন্যাস – উদ্বাস্তু শরীর। শরীরই যখন শরীরের
শত্রু হয়ে যায় তখন তাকে সামলায় কোন জন? সেখানে বিকার নেই, লালসা নেই, লোভ নেই,
কামনা নেই, বাসনা নেই, আছে কেবল মনুষ্যত্ব। সেখানে কেবল স্বাভাবিকত্বের থেকে সরে আসা শরীরের ওপর যে
সামাজিক প্রত্যাঘাত নেমে আসে, তার বীভৎসতা রোধ করবে কে?
এর উত্তর খোঁজার প্রয়োজন। আজ না
হোক তো কাল। লেখিকাকে ধন্যবাদ, তিনি প্রশ্নটা আজ তুলেছেন। ভাবীকালের মুখপত্ররূপে
তার কাছে পরের বছরেও এমন উপন্যাস আশা করছি, যা আজকের সমাজে দাঁড়িয়ে এমনই বিষময়,
কিন্তু এর অ্যান্টিডোট খুঁজে বের করার আলোচনাটা শুরু হওয়া, অন্তত, আশু প্রয়োজন।
এই
উপন্যাসের পরিশিষ্ট সেই বার্তাই আনে –
“সত্যিই দুনিয়া চায় না ওদের। তখনও
চায়নি, এখনো চায় না। সমাজ নির্ধারিত নির্দিষ্ট যৌ*নতার লক্ষ্মণগণ্ডীর সীমারেখার
বাইরের মানুষ ওরা। স্বপরিচয়ে বাঁচার গৌরব নেই ওদের। মিলেনিয়াম পার করা সহস্রাব্দের
একুশ শতকের আগুয়ান এই পৃথিবী, টেকনোলজির বৈপ্লবিক অভ্যুত্থান ও মিডিয়া-হাইপের
প্রগ্রেসিভ মডার্ন গ্লোবাল-ভিলেজ – যেখানে আজ গোটা বিশ্বকে একটি সম্প্রদায় হিসেবে
মনে করা হয়, সেখানে বিশ্বের সমস্ত প্রান্তের মানুষ উন্নততম প্রযুক্তির মাধ্যমে
আদর্শগত ভাবে একটি একক সমাজে সন্মিলিত বসবাস করে, যেখানে পারস্পরিক ভাবনা-চিন্তা ও
জ্ঞানের উৎকর্ষের নিরবচ্ছিন্ন আদান-প্রদানে সবাই একে অপরের ওপর নির্ভরশীল এবং
সংযুক্ত – সেই উচ্চমানের পৃথিবীতে দুটি ইন্টারসে*ক্স হার্মাফ্রোডাইট উভলি*ঙ্গের মানুষ, যারা
তাদের অন্তস্তলের পুরুষ ও নারীর সত্ত্বা নিয়ে স্বাভাবিক নারী-পুরুষের সম মর্যাদায়
বাঁচতে চায়, নিশ্চিন্ত জমির শক্ত ভিতের ওপর আত্মবিশ্বাসী পা রেখে তাদের সেক্সু*য়াল
আইডেন্টিটির সন্মান চায়, সেটা ওরা আজও পায়নি। পায় না।”
===============
উদ্বাস্তু শরীর
সর্বাণী মুখোপাধ্যায়
শারদীয়া নবকল্লোল ২০২৪
২
বিনোদ ঘোষাল মৃন্ময়ী’র পর থেকেই
নবকল্লোলে, যাকে বলে বিগ হিট। তারপর থেকেই, হয়তো পরের পর রহস্য উপন্যাস দিয়ে
যাচ্ছেন, আমি জানি না, ভুল হলে মার্জনা করবেন। কিন্তু এই বছরের লেখাটা, অন্ততঃ,
রহস্য উপন্যাস।
রহস্য উপন্যাস, কিম্বা ভুতুড়ে
রহস্য উপন্যাস।
কি আছে এই বইতে?
একজন কলগার্লের সার্ভিস লিস্ট
আছে, কলগার্লটি কিভাবে সার্ভিস দেয় তার বর্ণনা আছে। রগরগে নয় অবশ্যই, কিন্তু সেখান
থেকে ভালো ভাল অলংকরন করা যায়। যদিও এবারের সেই অলংকরনগুলো অতটা সাহস চিত্রকর দেখাননি,
যতটা দেখালে রঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘গোলাপী’ উপন্যাস হয়ে যায়, আর আছে তার লোভ,
উদগ্র লোভ।
এইটুকুই পুঁজি হলে বিনোদ ঘোষাল
হওয়া যায় না। তিনি পুঁজিতে যোগ করেছেন প্রোটাগনিস্ট চরিত্র টুম্পা ওরফে মলি’র অতীত
এবং বর্তমানের সমান্তরালে অতিসচ্ছ্বলতার লোভের শুরু ও শেষ। স্বভাবতই নিজের বাড়ি
থেকে যে যৌ*নতাকে হাতিয়ার করে পথ চলা শুরু, সেই যৌ*নতাই তার সর্বনাশের কারন হয়ে
দাঁড়ায় অবশেষে। এ চেনা ছক। বহু উপন্যাস এমন লেখা হয়ে গেছে।
এই পুঁজিতে যুক্ত হয়েছে একটু আধটু
সাইকোলজি। তার একাকীত্ব তাকে কুরে কুরে খায়। সে ফিরে যেতে চায় তার মায়ের কাছে, সীমাকাকীমা-র
মধ্যে বারবার নিজের পরিজনকে খুঁজতে থাকে। এও চেনা ছক। উপন্যাসে কোন এক চরিত্রকে
ব্যলান্স করবে অন্য এক চরিত্র। মলি’র লোভের ব্যালান্স সীমাকাকীমা। সাইকোলজির চমক
পাই যখন মলি তার বিলাসবহুল ফ্ল্যাটে ঢুকলেই একটা পচা দুর্গন্ধ টের পায়। এই জায়গায়
বিনোদ ঘোষাল চমকে দেন। বেশ ভাল লাগে এই আবহ তৈরী। কারন, একসময় মনে হয়েছিল, হয়তো,
ভৌতিক রহস্যের শুরু এইখান থেকে হবে। কিন্তু না। এ একটা চরিত্রের ডার্ক সাইডকে তুলে
ধরার প্রতীক।
এরপরেই চলে আসে জোহরা। আমার মিস জোজো-কে
মনে পড়ে যায়। জোহরা মলিকে একটা নখ দেয়। এই নখের সাথে মিশে আছে রাশিয়ান ইতিহাস।
মানুষের যেমন ইতিহাস আছে নখরূপী ভুতের একটা ইতিহাস থাকবে। আর তা যদি যৌ*ন প্রকল্পে
থাকা কোন উপন্যাসের অংশ হয়ে থাকে, তাহলে, অবশ্যই সেই ত্যাঁদড় ভুতকে যৌ*নবুভুক্ষু
এক অতীত মানব হতে হবে, এখানে সে নারী। নখ যে পড়বে, সেই হয়ে যাবে... হু হু বাবা...
আর কি বলার আছে?
মলি নামক কলগার্লের হাতে
জোহরারূপী অ্যান্টিক জিনিস বিক্রী করা থুড়ি তান্ত্রিক থুড়ি স্পিরিচুয়াল ম্যাজিশিয়ান
তুলে দেয় রাশিয়ান রানী ক্যাথারিনের নখ। যাকে প্রতি অমাবস্যায় অবশ্যই খাওয়াতে হবে
পুরুষের বী*র্য। আমার কেন জানি না, বারে বারে, ‘অভিশপ্ত নাইটি’ সিনেমার বৃষ্টি
চরিত্রটির কথা মনে পড়ে যায়। যেখানে সেই সাউথ ইন্ডিয়ান পরিচালক নাইটি পরিহিত
তনুশ্রীকে জিজ্ঞাসা করে, ভেতরে কখন যাব? আমার মনে হয়, অভিশপ্ত নাইটি’র এক টুকরো
প্যাকেজ এখানে ঢুকে বসে আছে।
এই হল বিনোদ ঘোষালের প্যাকেজ। এর
মধ্যে চিন্তা করার কোন স্পেস নেই। উনি রাখেন নি। সিনেমাকে উনি পাতায় নিয়ে এসেছেন। কিন্তু
এই কি বিনোদ ঘোষাল? উপন্যাসটার, মোটামুটি ২৫ শতাংশ পড়ার পরে একটা কথাইমনে হচ্ছিল
মলি’র শেষ যেরকম আর কয়েকটা গড়পড়তা উপন্যাসে যেমন হয়, তেমনই হবে, হয়েওছে। কিন্তু
শেষের পরিণামের যে মাধ্যম, আমাকে চমকে দিয়েছে। এমনভাবে একটা শেষের জন্য বিনোদ ঘোষাল
হতে হয়। মাস্টার প্যাঁচ পড়েছে একদম শেষ পৃষ্ঠায়। তার আগে পর্যন্তও আমি পড়ছিলাম
ক্যাসুয়ালি। শেষ পৃষ্ঠার শেষ কয়েকটা প্যারা আমাকে ব্যোমকে দিয়েছে।
কিন্তু ব্যাস... ওইটুকুই। ওখানেই
বিনোদ ঘোষাল তার জাত চিনিয়ে দিয়েছে।
অবশ্য, আমার, উপন্যাসটা পড়ার পর, বুকের
ভেতর থেকে একটা দীর্ঘশ্বাস পড়ল। মলিটা কি বোকা! আজকালকার যুগের মেয়ে। নখ ট্র্যান্সপ্ল্যান্ট
করাতে পারছে, ফ্ল্যাটেই একটা ‘বার’ রয়েছে, অথচ সিমেন সংরক্ষণ করার কোন ব্যবস্থা
নেই! এটা করলে তো আর চিন্তাই ছিল না। অবশ্য ‘মাসাকু’ বাসী খাবার পছন্দ নাও করতে
পারে। যদিও উপন্যাসে তা উল্লেখ নেই, আবার উল্লেখ আছে বললেও স্পষ্ট কিছু বলা হয় না।
কারন মলি’র মাথায় প্রশ্নটাই আসে নি, আর এ নিয়ে পরীক্ষা নিরীক্ষাও করে নি। আর
যেখানে ফোনে আজকাল রিমাইন্ডার দেওয়া যায়, কিম্বা এতদিনের সতর্কতা যেখানে অভ্যাসে
বদলে গেছে, সেখানে অমাবস্যা ভুল হয়ে যায় কি করে?
এতটা
ভাবলে উপন্যাস এভাবে শেষ করা যেত না। আর যেত না বলেই মলির এই বোকামীর সামনে আমি
চুপ করে যাই।
===============
নখ
বিনোদ ঘোষাল
শারদীয়া নবকল্লোল ২০২৪
৩
পৌরাণিক আখ্যান কিম্বা উপন্যাস
কিম্বা ঔপন্যাসিকা – লেখার সুবিধা আছে। কল্পনার জায়গা খুবই কম, খালি বিভিন্ন পুরাণ
/ রামায়ণ / মহাভারতে থাকা চরিত্রের গুণগাথাগুলোকে ঠিকঠাক একত্রিত করে এক জায়গায়
আনতে হবে। এবং নির্মাণ ঘটাতে হবে একটি পুর্ণ আখ্যানকে।
ডঃ
পূর্বা সেনগুপ্তের লেখা কোন উপন্যাস আমি এর আগে পড়ি নি। কৌতুহল ছিল ভয়ানক। তার
লেখা ছোটছোট আখ্যান বিশেষত সাপ্তাহিক বর্তমানে পড়েছি। কিন্তু উপন্যাস? ন্যাঃ। মনে
পড়ে না। আমার দেখার ইচ্ছা ছিল লেখিকার এই নির্মাণ কতটা আবেগপ্রসূত আর কতটা পুরাণ
অনুসারি।
তার এই
উপন্যাসের চরিত্র মহামতি ভৃগু। মহর্ষি ভৃগু-র নির্মানকার্য সহজ নয়। কারণ ভৃগুর চারিত্রিক
ঘটনার ঘনঘটা বিভিন্ন পুরাণে বিচ্ছিন্নভাবে রয়েছে। শুধু তাই নয়, ভৃগুকে আমরা এমন
একজন ঋষিরূপে দেখি, যিনি আপামর ভারতবর্ষের ভোল বদলে দিয়েছিলেন। শুধু তাই নয়, তাকে
আদিঋষির এক ঋষি হিসাবে ধরা হয়। ফলে সেই ‘আদি’ এক্কেরে রাজামৌলির আদিপুরুষেরও আদি।
যার ক্ষেত্রে পুরাণ সসম্ভ্রমে তার কথা স্মরণ করে। সংহিতা, অগ্নিতত্ত্ব কিম্বা
অক্ষর নির্মানের নায়ক এই ভৃগুর জীবন কেমন ছিল? তার মনগতি কোথা থেকে কোনদিকে যেত
তার ঠিকানা খুঁজে নিয়ে তাকে পরপর বিন্যাস করে নির্মান করা বেশ অ-সহজসাধ্য। তবে
লেখিকা যেখানে পূর্বা ভট্টাচার্য, গবেষিকা হিসাবে যাকে আমি শ্রদ্ধা করি, তার কাছে
এ কাজ খুব কঠিন হওয়ার কথা নয়।
“ভারতের
ঋষিকুলের মধ্যে ভৃগু এক উল্লেখযোগ্য চরিত্র। ব্রহ্মপুরাণ, ব্রহ্মাণ্ড পুরাণ,
বিষ্ণু পুরাণ, মৎস্য পুরাণ, পদ্মপুরাণ এবং মহাভারতের আদিপর্বের মধ্যে এই চরিত্র
বিভিন্নভাবে বর্ণিত হয়েছে। সেই বর্ণনাগুলিকে আধার করে এই উপন্যাস লিখিত হয়েছে।”
লিখছেন লেখিকা। তিনি ভৃগুকে জন্মান্তরবাদে ফেলে দিয়ে জাতিস্মর প্রতিপন্ন করেছেন।
না হলে উপন্যাসের নির্মাণ সম্ভব ছিল না। কোথাও ওই একজন ভৃগু দুটি ভৃগুচরিত্র হয়ে
একে অপরের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে পড়ছিল।
তবে
এখানে, বলা যায়, লেখিকা একটা ভুল করেছেন। অষ্টম পর্বের শুরুতেই অরুন্ধতীকে ঋষি বশিষ্ঠের
স্ত্রী বলে উল্লেখ করেও পরের প্যারাতেই তাকে ঋষি অত্রির স্ত্রী বলে উল্লেখ করেছেন।
ছোট্ট ভুল, কিন্তু একটু... ওই একটুই...
পুরাণের
আখ্যান শুনতে ভালো লাগে, পড়তেও ভাল লাগে। যা আমার দেশের জল-মাটি-বাতাসের মধ্যে
থেকে লালিত পালিত তার প্রতি মমত্ব থাকাটাই স্বাভাবিক। এই ঋষি ভৃগু-র জীবনালেখ্য পড়তে
বেশ ভাল লাগল। ভাবনা চিন্তার বেশি জায়গা নেই। লেখিকা ঘটনার পর জোর দিয়েছেন,
সাইকোলজি নিয়ে মাথা খাটাতে যান নি। তার কাজ সেটা ছিলও না। ফলে পাঠ উপভোগ্য। এর
বেশি কিন্তু আশা করা অনুচিত।
তবুও
মানুষ ভৃগু থেকে কিছু প্রশ্ন উঠেই আসে। নরলোকের ঋষি যখনই সংসারি হয়েছেন, তখনই
সংসারের কর্মকান্ডে জড়িয়ে পড়ে কৈফিয়তের নখরাঘাতে জর্জরিত হয়েছেন। আমার মাঝে মাঝে
মনে হয়, পুরাণের অনেকটা কর্মযোগের ওপর নির্ভরশীল, ভয়ঙ্করভাবে নির্ভরশীল। আর সেই
কারণে ভৃগু-র মধ্যেও দয়া এবং ক্রোধ সহাবস্থান করে। দয়ার প্রভাবে তিনি দেব ও মানবের
কাছে ঈশ্বরতুল্য। অথচ ক্রোধের ক্ষেত্রে তিনি কাউকে রেয়াত করেন না। এমনকি নিজের
পিতাকে পর্যন্ত অভিশাপ দিয়ে দেন, “ভৃগু তখন পিতাকেই অভিশাপ দিয়ে দিচ্ছেন,
ত্রিদেবতার জ্যেষ্ঠ হয়েও যদি এখনও সমালোচনাকে সহ্য করতে না পারেন, তবে আপনার
মাহাত্ম্য ক্ষাপনের কোনো দরকার নেই। নিজের জন্য অহঙ্কার করলেন। তাই আজ থেকে আর কোন
দিন আপনাকে কেউ পূজা করবে না।”
এই
ভৃগুকে ক্রোধান্বিত হয়ে বহুবার অভিশাপ দিতে দেখি। তার অভিশাপ অবশেষে তাকেই জটিল
বেড়াজালে আটকে দেয়। সংসার থেকে সরে এসে যতবার তার গবেষণায় তিনি মন দেন, সংসার তাকে
টেনে নিয়ে আসে কর্মযজ্ঞে। সেই কর্মযজ্ঞের মধ্যে পড়ে তিনি একের পর এক ভুল সিদ্ধান্ত
নেন। তার ভুল সিদ্ধান্তে তার পরিবারের ক্ষতি হয়। আর সেই ক্ষতিই তাকে এক পরিবার থেকে
দূরে সরিয়ে নেয়। অন্য পরিবার ভয়ে কাঁটা হয়ে থাকে, পাছে তার অবস্থাও পূর্বাপর হয়।
ঋষি
ভৃগুর দুই নারী - ঊষনা এবং পুলমা। ঊষনা
ভৃগুর ‘অক্ষর’ প্রণয়নের উৎসাহিকা। কিন্তু দৈত্যগুরু শুক্রাচার্য তার পুত্র হওয়ার
কারনে সেই মহা আবিস্কারের ভাগ হতে বঞ্চিত। আর পুলমা ভৃগুসংহিতার উৎসাহিকা। সে
ভৃগুর একান্তিকা হওয়ার কারনে এই মহান আবিস্কারের প্রেরণাদাত্রী হিসাবে চিরস্মরণীয়।
লেখিকার এই উপন্যাস মূলত এই দুই বিপরীত কান্ডের মধ্যে প্রশ্ন তোলে ভৃগুর
বিরুদ্ধেই। পুরাকালে নারী যে পুরুষের ঐকান্তিক ইচ্ছার সহায় এইটাই বড়ো বিষয় ছিল।
এইখান থেকেই প্রশ্ন ওঠে, লেখিকার বয়ানে,
“পুরুষের
মন কি সব সময় কি নিজেকে আবর্তিত করে ঘুরে বেড়ায়! বিশেষ করে সেই পুরুষ যদি
কীর্তিমান হন। মহর্ষি ভৃগু নিজের সৃষ্টিতেই মগ্ন থাকেন। তাঁকে সাহায্য করবার জন্যই
নারী! তিনি কি সত্যি ভালোবাসতে জানেন? না ভালোবাসার প্রয়োজন আছে তাঁর জীবনে?”
এর কোন
উত্তর হয় কি? বিতর্ক হয় তখনও ছিল, এখনও হয়। কিন্তু তাঁর প্রভাব আমরা দেখতে পাই
সমাজে। গার্গী, মৈত্রেয়ীরা বড়ো দ্রুত হারিয়ে গেল বৈদিক সভ্যতার পৃষ্ঠা থেকে। ভারতের
সুবর্ণযুগে রচিত হল ‘মনুসংহিতা’। বৈদিক যুগের নারীস্বাধীনতা আর মৌর্য-পরবর্তী যুগে
নারীঅধীনতার টাইম লাইন আজও আমায় বিস্মিত করে।
=============
ভৃগুর প্রণয়
পূর্বা সেনগুপ্ত
শারদীয়া নবকল্লোল ২০২৪
৪
‘প্যাকেজ’ ব্যাপারটার একটা মারাত্মক মাহাত্ম্য আছে,
ওই যাকে বলে রহস্যময় জাদুকাঠি। যে এই প্যাকেজটার পালস্ ধরতে পারল সে, ওই যাকে বলে
‘রাজা’ হয়ে গেল। আর যে পারল না, তার ঘটি উলটে যাবে।
যেমন,
মুক্তধারা।
একটু
পুরাণ, একটু বাস্তবতা, একটু অমিষ ত্রিপাঠী, একটু ইতিহাস, একটু গল্পকথা, একটু
মুচুমুচু প্রেম – এই সমস্ত কিছু মেশাতে গিয়ে এমন একটা ভেলপুরি হয়ে গেছে, যাকে
খাওয়া গেল না, থুড়ি উপভোগ্য করা গেল না। কেন, তা বলছি।
মুক্তধারার
বিষয়বস্তু, ভগীরথের গঙ্গা আনয়ন।
পুরাণের
ভগীরথ ইক্ষ্বাকু রাজবংশের রাজা, সগরের পৌত্র, তাদের পিতৃপুরুষকে উদ্ধার করার
জন্যেই মূলত গঙ্গা আনয়ন, এই হল পৌরাণিকী। এখানে, ভগীরথ একজন বাপ-মা হারা, ঋষি
ভরদ্বাজ পালিত এক সাধারণ মানুষ যে পড়াশোনার ‘প’-ও জানে না বললেই হয়। এখানে দেখা
যায় সকাল হলেই সূর্যপ্রণাম করে ‘ওঁ জবাকুসুমসঙ্কাশং...’ ইত্যাদি বলে।
ইক্ষ্বাকু
রাজবংশ অনেক সময় ধরে রাজত্ব করে ভগীরথ পর্যন্ত এসেছিলেন, অর্থাৎ, তারা, যাকে বলে,
বনেদি রাজবংশ। ইক্ষ্বাকু বংশের ধুমাধাড়াক্কা পরিচয় রামায়ন-মহাভারতে আছে, যারা
দেখার দেখে নিতে পারেন। এখানে মেহেরগড় সভ্যতা ভূমিকম্পে জলস্ত্বর সরে যাওয়া কিম্বা
অন্যত্র চলে যাওয়ার কারনে সিন্ধু সভ্যতায় স্থানান্তর, এবং তারপরে পশ্চিমের
যুদ্ধবাজ অসভ্যের আক্রমণে সেখান থেকে সরস্বতী নদীতীরে সরে আসার ইতিহাস বলা হয়েছে।
আমার প্রশ্ন, এই ‘পশ্চিমের যুদ্ধবাজ’ কারা? আর্যদের কথা বলছেন কি? ইতিহাস তো অন্তত
তাই বলে। সেক্ষেত্রে লেখকের লেখা অনুসারে ভগীরথ ‘অনার্য’। কারন তাদের সরে আসতে
হয়েছে সরস্বতী নদীতীরে। এদিকে আবার জঙ্গলে রাক্ষস-পিশাচ আছে। আমরা আজ জানি, তারাই
ভারতের প্রকৃত আদিবাসিন্দা এবং ‘অনার্য’। লেখক ঠিক কি জানেন জানি না।
ভগীরথের
সমসাময়িক কথাবার্তায় ভাষার কি ব্যবহার হতে পারে? দেবভাষা ছিল বলেই জানি। বাচিকে
অবশ্যই তার অপভ্রংশ কিছু। তো সেই দেবভাষার খানিকটা প্রয়োগ থাকতেই হয়, অন্তত এই
ধরনের উপন্যাসে। অন্তত তাঁর প্যাটার্ন থাকলে ব্যাপারটা বাস্তবচিত হয়। আমরা কি
দেখছি? একটা জায়গা তুলে দিলে বোঝানোটা সুবিধার হবে,
“হঠাৎ
কিছু একটা চোখে পড়তেই থমকে গেল ভগীরথ। একটি মানুষ দুটি উট নিয়ে চলছে। এদের কোন
নির্দিষ্ট আবাস নেই। ... ডাক দেয় ভগীরথ, ও উট-সওয়ারি। জনহীন প্রান্তরে মানুষের ডাক
শুনে থমকে যায় উটওয়ালা। মুখ ফেরাতেই দেখতে পেল ভগীরথকে। সেও ডাক দিল, হ্যাঁ বাবু।
এদিকে কোথায়?”
আমি
মনে মনে বলি, ও বাবা! এ যে খাঁটি বঙ্গদেশীয় টোন যে! উটওয়ালা বাবাজি ১৯৫০ থেকে এক
ধাক্কায় পথ হারিয়ে চার-পাঁচ হাজার বছর আগে চলে গিয়েছে হারিয়ে গিয়েছে দেখছি! ‘উট-সওয়ারি’!
ডাকটা বড্ড কানে লাগে আমার। আমাদের এখানে টোটো চলে। তার ড্রাইভারকে কি আমি ডাকব, “ও
টুকুটুক সওয়ারি, বাটখাড়ার মাঠের দিকে যাবে হে?” যাই হোক, ডায়ালগগুলো বড্ড চোখে
লাগে। এমনকি নামও। এখানে লোকের নাম সনৎ, অংশু ইত্যাদি। আমাদের পাড়ায় এমন নামের
অনেক লোক আছে। পাঁচ হাজার বছর আগে এমন নাম, তাও আবার সাধারণে? হত বুঝি?
যাই
হোক, উপন্যাসে ফিরে আসি। এখানে ভরদ্বাজ মুনি স্বপ্ন দেখে, সরস্বতী শুকিয়ে যাচ্ছে।
ভগীরথকে স্বপ্নে দেখা দিয়ে বলে, হিরো বটেক তুমি, বেরোও এবার এখান থেকে। নদী আনো।
ভগীরথ আর গ্রামের লোক দেখে কয়েক ঘন্টার ঝড়ে গ্রাম মরুভূমি হয়ে গেছে। মরুভূমির
সম্প্রসারণ ক্ষমতা এখনকার যুদ্ধবাজ দেশদের হিংসেয় ফেলে দেবে। গ্রামবাসীদের নিয়ে
ভগীরথ বের হয়, মোজেসের মতো। ‘জেরুজালেম নিয়েই ছাড়ব শালা’ মনোভাব নিয়ে। এক জায়গায়
ঝর্না দেখে গ্রামবাসী বলে, আমরা এখানেই থাকব তুমি ভাগো। নদী নিয়ে এসো বা যা কিছু,
নিজের কাজ নিজে করো গে যাও। আমরা আর পারছি না। ভগীরথ, আত্রেয়ী আর চারণ গান গাইতে
গাইতে উত্তরের দিকে হাটা দেয়। এক্কেরে মোজেস কেস, ঈশ্বরের ল্যান্ডে তারা ল্যান্ডিং
করতে পারে নি। মিথোলজি তাই বলে।
তো যেটা
বলছিলাম, অত্রিমুনি আদেশ দেয় তাঁর শিষ্য সাধুকে, একটা লোক আসবে, সে যাবে হিমালয়ে
নদী আনতে, এতএব এখানে গেড়ে বসে থাক, পথ দেখাবি তাকে, সে গেড়ে বসে থাকে গুরুর
সমাধিস্থলে আশ্রম বানিয়ে। তাঁর কাছ থেকে পথনির্দেশ নিয়ে আবার হন্টন। এবার লক্ষ্য
জঙ্গলে।
জঙ্গলে
গিয়ে বেদানা খেয়ে তারা ব্যাপক আনন্দ পায়। অজ্ঞাত ফল বটে, কিন্তু কি সুমিষ্ট! সেখান
থেকেই বেদানার প্রচার ও প্রসার। লেখা পড়ে আমার তাই মনে হচ্ছিল। ওদিকে আবার ছায়াপিশাচেরা
জঙ্গলে তাদের ঘিরে ধরে খাবার চায়। ভগীরথ পড়ে মন্ত্র। বিপদমুক্তি মন্ত্র। কি
মন্ত্র? মন্ত্রটা যা ছাপা আছে, সেটা হল ‘মহামৃত্যুঞ্জয় মন্ত্র’। লেখক কি জানেন
মহামৃত্যুঞ্জয় মন্ত্রের আসল উদ্দেশ্য? হয় তিনি ঠিক জানেন, অথবা ইন্টারনেট ভুল জানে,
কিম্বা আমি বাড়াবাড়ি করছি। গল্পের গরু গাছে চরবে ত প্রধন্যা বেটি তোর তাতে কি? আমি
মনে ভাবি, কখন উপন্যাস শেষ হবে রে বাবা, মনে মনে মন্ত্র পড়ি, “ওম ত্র্যম্বকম
যজামহে সুগন্ধিম্ পুষ্টিবর্ধনং...” মোদ্দা কথা রাক্ষস থুড়ি পিশাচ পালায়। জঙ্গলে
আর কিছু হয় না। তারা পৌছায় মাজুলি গ্রামে।
মাজুলি
গ্রামের লোক সবাইও জানে তারা আসছে। কিভাবে? ওই যে বললাম, একটু অমিষ ত্রিপাঠী আছে। যাই
হোক তারা তাদের জন্য অপেক্ষা করছিল। ওখানে একটা দেবতা ছিল, সে মনে হয় হ্যারি
পটারের ‘ডাম্বলডর’। এখানে একটু রূপকথা মিশেছে। যাইহোক ডাম্বলডর বলল, যাও হিমালয়ে।
ওখানে কাক ভূষণ্ডী আছে। সে একটা কাক। সাদা কাক, কালো ঠোঁট। সে মানুষের ভাষায় কথা
বলে, এখানে আবার পুরাণ মাথা ঘুসিয়ে দিয়েছে।
আচ্ছা,
ভগীরথ রাজা হলে ক্ষতি কি ছিল? সাধারণ মানুষকে যদি কাকের কাছে দড়ি-কুড়াল নিতে হয়
তাহলে আর বাকি কি রইল? আর প্রশ্ন এই যে, এই দৈব কুড়াল, তাও আবার চার-চারটে, তোরঙ্গের
মধ্যে! কাক ব্যাটা পেল কোথা দিয়ে? কাক মানুষের গলায় কথা বললে মানুষ ভয় পায় না। অথচ
মেহেরগড় থেকে সরস্বতী নদীতীরে কোন যুদ্ধবাজেরা যেন খেদায় খালি খালি। দেশে কোন রাজা
নেই! তখনকার ভারত যেন এখনকার ভারতরাষ্ট্র হয়ে গেছে -- আমরা সবাই রাজা। মোদ্দা কথা
ঘটনার ঘটমান বর্তমান সোনার কেল্লা-র মুকুলের মতো হয়ে গেছে। কখন যে কোন অবস্থায়
থাকে বলা মুশকিল।
তো যাই
হোক। কাক ভুষন্ডী কেবল থেকে থেকেই বলে, আমার মুক্তি হবেই হবে। নদীর মুক্তিতে তাঁর
মুক্তি – অভিশাপ আছে। এখানে আবার পুরাণ। ত্রিকালদর্শী সর্বজ্ঞ কাকটির ভগীরথদের
কাজে বাধা পড়লেই কেঁদে ভাসিয়ে দেয়, তাঁর মুক্তি পিছিয়ে যাচ্ছে বলে। আমি বলি, অত
তাড়া কীসের। একটা-দুটো বছর আরও অপেক্ষা করলেই বা ক্ষতি কি তোর? এত স্বার্থপর হওয়া
সাজে?
অবশেষে শেষ কুড়ালের কোপ মারল
আত্রেয়ী। কাক ভুষন্ডীর স্বার্থপরতা বোধহয় তাকে উত্যক্ত করেছিল বেশি। ফলে মরেই গেল,
জলে ভেসেই গেল। ভগীরথ হায় হায় করল। কাক ভুষন্ডী মানুষ হয়ে দেখা দিয়ে বলল, “কে
বলেছে তোমার ভালবাসার মানুষ হারিয়ে গেছে? তুমি ভগীরথ। আমি ওর নতুন নাম দিলাম
ভাগীরথী। যুগ যুগ ধরে তোমার আর ভাগীরথীর নাম মিলেমিশে এক হয়ে থাকবে এই জলধারায়।
কেউ তোমাদের বিচ্ছিন্ন করতে পারবে না।” আমি মনে ভাবি, মোলো যা! গঙ্গা ভগীরথ কন্যা বলেই
তো ভাগীরথী! এ যে অন্য কথা বলে! পুরাণ ঘেটে ঘ। প্রধন্যা তুই বাড়ি চ...
কাক ভুষন্ডীর আশীর্বাণী শেষ।
আমার কথাটিও ফুরালো।
===========
মুক্তধারা
চঞ্চলকুমার ঘোষ
শারদীয়া নবকল্লোল ২০২৪
৫
শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় এবং সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায় – বর্তমানের
দুই প্রবীণতম লেখক, আমার প্রিয়। তাঁর মানে এই নয় যে, প্রিয় লেখকের সব লেখাই আমার
প্রিয় হতে হবে, এবং অপ্রিয় হলেও তকে ক্ষমাসুন্দর চক্ষে দেখতে হবে।
কিশোর
ভারতীতে দুজনেই লিখেছেন। প্রথমজন একটি ছোটগল্প এবং দ্বিতীয়জন উপন্যাস।
এনাদের
লেখায় কি যেন একটা থাকে। বহু অভিজ্ঞতার ঝুলি থেকে একটা পুরোনো গন্ধ সাবেককালের
চিরায়ত অনুভূতিকে উথলে দিয়ে যায়। সেই অনুভূতি মানবের অনুভূতি।
অনৈতিকতা
সমাজের এক বড়ো অসুখ। লোভ শেষ করে দিচ্ছে। এ আদিকালের বিষয়। কিন্তু নতুন করে তাকে
বলছে কে? শীর্ষেন্দু বলছেন। গন্ধ। অনৈতিক মানুষের গন্ধ বিষাক্ত। তার গন্ধে মানুষটি
নিজের পরিবার পরিজন থেকে ধীরে ধীরে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। একটা ছোটগল্প। কি কি
মাধূর্যে ভরপুর –
“একদিন
সকালে উঠে হঠাৎ মনে হল, টাকাপয়সা জিনিসটা আসলে কিছু না, আপনার জন মুখ ফিরিয়ে নিলে
মানুষের বড় দুরবস্থা হয়। সেই কোন মহাপুরুষের যেন বলা আছে ‘মানুষ আপন, টাকা পর, যত
পারিস মানুষ ধর’! তা সেই কথাটা মনে হতেই গুটিগুটি বেরিয়ে শ্বশুরবাড়িমুখো রওনা
হলুম।”
আসলেই
মানুষ নিজের পরিজনের কাছেই ফিরতে চায়। নিজের পরিবারকে ভরভরন্ত করতে চায়।
সঞ্জীবও
কি সেটাই চেয়েছেন? নাহলে এতদিনের মেজমামার হঠাৎ করেই বিয়ে হয়ে যায় শ্যামামাসীর
সঙ্গে! মামা সিরিজ আমি যতটুকু পড়েছি সেখানে দুই মামা আর মাসীর বিয়ে হওয়া তো দূর,
বয়স পর্যন্ত বাড়ে না। আমি বেড়ে উঠি। মামারা একই রকম থেকে যান। মাসীও। কিন্তু এবারে
কি যেন একটা হয়ে গেল।
সঞ্জীবের
মামারা এক্কেবারে আটপৌরে মামা। আদর্শ মানুষ, আদর্শ পরিবার। এই পরিবারে ঝগড়া হলেও
যেন মনে হয় রাগ-রাগিনী বাজছে। এই মুহূর্তে দাঁড়িয়ে এম্ন কোন পরিবার আমি মনে করতে
পারি না যেখানে, এমন সুমধুর অশান্তি হয়।
তো সেই
পরিবারে বাইরে থেকে অনেক মানুষ আসে যায়। অনেক ঘটনা ঘটে। অনেক সমস্যার শেষ হয়। এইভাবেই
মামা সিরিজ চলতেই থাকে। মামারা আদর্শ মানুষ। মাসী আদর্শ নারী। এই মামা-মাসীরা
শিশুমনে এমন এক স্বর্গীয় কল্পনার বীজ বুনে দেয় যে, বড় হলে হয়তো মানুষ এমন হলে,
পরিবারের সংগাই বদলে যেত। শিশুমনে কিভাবে সুন্দরের প্রভাব ফেলা যেতে পারে,
সঞ্জীবের ‘মামা সিরিজ’ তার এক জ্বলন্ত উদাহরন। এই পর্যায়ে ছোটমামার বিবাহ দিয়ে
উপন্যাস শেষ।
পড়তে
মন্দ লাগে না, মানে, বড় হয়ে, অর্থাৎ কি না, শিং ভেঙে বাছুরের দলে ঢুকতে মাঝে মাঝে
ভালই লাগে।
==================
গন্ধ – শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়।
যুগলবন্দী – সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
শারদীয়া কিশোর ভারতী ২০২৪
Comments
Post a Comment