রামপ্রসাদ

 


ঐতিহাসিক চরিত্রের একটা বড়ো সমস্যা যখন সেই চরিত্রের জন্য পর্যাপ্ত তথ্য গবেষকের হাতে নেই। সেই চরিত্র যদি ধর্মের সাথে যুক্ত হয়, তাহলে মুগ্ধ ভক্তকূল তার চরিত্রে অতিমানবিক সব ব্যাপার স্যাপার যোগ করে। সেই অতিমানবিক ব্যাপার স্যাপারগুলোকে ছাড়িয়ে আসল মানুষটাকে বের করে আনা বেশ কঠিন ব্যাপার। এর জন্যে প্রয়োজন একটা জীবন যাপন, একটা সাধনা।

      সাধক কবি রামপ্রসাদের জীবনী যদি কেউ লিখতে চান, তো একই সমস্যা। তথ্য অপ্রতুল, কিছু লোকগুজব আছে, আর আছে অসংখ্য গান, যা মুখে মুখে অনেক পরিবর্তিত। ফলে তাঁর জীবন সম্পর্কে লিখতে গেলে একটা বড়ো সমস্যা --- তথ্য।

      স্বামী বামদেবানন্দ রামপ্রসাদের ওপর লিখতে গিয়ে বলছেন, “অনেক সময় দেখা যায়, মহাপুরুষ বা সাধক মহাজনের জীবনী-সংগ্রহে বিশেষ কিছু পাওয়া যায় না। সেই জন্য অনেকে গ্রন্থ বাড়াইবার জন্য সামান্য ঘটনাবলীকে ফেনাইয়া নাটক বা উপন্যাস লিখিয়া বসিয়া থাকেন। রামপ্রসাদ-জীবনীতেও তাহার ব্যতিক্রম নাই। মহাপুরুষ-জীবনকে উপন্যাস-আকারে সাজাইয়া সাধারণ মানুষের মধ্যে একটা ভ্রান্ত ধারণার সৃষ্টি করা উচিৎ নয়। যতটুকু তথ্য ঠিক মত পাওয়া যায়, সেইটুকুই জনসমাজে ধরিয়া দেওয়া ভাল। জীবনী সংগ্রহ নাই বলিয়া উপন্যাস লিখিব, এ কোন বুদ্ধিমানের যুক্তি হইতে পারে না।” মস্ত বড়ো কথা, ভাববার কথা। যে সাহিত্যিক তাঁর উপন্যাসে অযথা জল মেশাচ্ছেন তাঁর ক্ষেত্রে সে-কথা খাটে বটে, কিন্তু যিনি চরিত্রের ‘এসেন্স’টাকে ধরতে চাইছেন তিনি কি খুব ভুল করছেন? রামপ্রসাদের চরিত্রের একটা প্রভাব আছে। এই লেখকের কথা ধরতে হলে, চৈতন্যচরিতামৃত, রামচরিতমানস, এমনকি শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ লীলাপ্রসঙ্গ বর্জনীয়, কারণ, সেখানেও এমন কিছু কথা লেখা আছে, যা কল্পনার ফসল, সাধারণে কিম্বা অসাধারণেও সম্ভব নয়।

রামপ্রসাদের সময়ের সমাজ তার ওপরে যথেষ্ট প্রভাব বিস্তার করেছিল। বর্গী আক্রমণ, পলাশীর যুদ্ধ, ইংরেজ শোষণ, ছিয়াত্তরের মন্বন্তর --- এ সমস্ত ঘটনাই তার সময়ে সমাজকে দেখতে হয়েছিল, সাধারণ মানুষ কমবেশি ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছিল। তার যন্ত্রণা কি তিনি পান নি? তিনি তো মানুষ। ফলে বামদেবানন্দের রচনায় রামপ্রসাদের চরিত্রটিকে কীরকম দেখাচ্ছে? মা আর তিনি --- যেন আর কিছুই নেই। সাধারণের জন্যে তার কিছু আসে যায় না। দু-একটা বিক্ষিপ্ত ঘটনা ছাড়া, তার এ জীবনী, একটা সময় যাপন, যে সময়ে চরিত্রটি রক্তমাংসের নয়, চরিত্রটি পারফেক্ট হয়ে গেছে।

আবার অনুপম মুখোপাধ্যায়ের সম্প্রতি রচিত ‘রামপ্রসাদ’ রক্তমাংসের মানুষ। কারণ তিনি সময় ও সমাজের সাথে সাথে চলেছেন। তিনি বেশ কয়েকটি জায়গায় কল্পনার আশ্রয় নিয়েছেন। কিন্তু অতিকল্পনা করতে গিয়ে ‘এক গোয়াল ঘোড়া’ হয়ে গেছে। আজু গোঁসাইয়ের সাথে পীরিত আর তান্ত্রিকমতটাকেই তিনি বিসর্জন দিয়েছেন। “মনে হয় না, রামপ্রসাদের তান্ত্রিক আচারের কোন প্রয়োজন ছিল। তিনি গৃহী ছিলেন। তাঁর গানই তাঁর সাধনার পথ ছিল।” চাপের কল্পনা, অদ্ভুত কল্পনা! জোর করে অলীক বলা বাতুলতা, কিন্তু সেটাকে, সাধক পর্যায়ে, গুরু থাকা সত্ত্বেও, অন্তত, তৎসময়ের স্বাপেক্ষে, মেনে নেওয়াটাও যায় না।

তবুও, তার উপন্যাস পড়তে ভালো লাগে। তিনি লিখেছেন, “এই উপন্যাসের এক-একটা পৃষ্ঠা আমার আত্মা অবধি ছিনিয়ে নিতে চেয়েছে। তিনি আজ এক রহস্যময় পুরুষ। ... নিজের রক্তবিন্দু দিয়ে চেষ্টা না করলে সেই সময়টাকে গড়ে তোলা সম্ভব নয়। এই উপন্যাসের প্রত্যেকটা শব্দ আমার সর্বস্ব দাবী করেছে। নিংড়ে নিয়েছে আমাকে। এক ভুতগ্রস্থ ব্যক্তির মতো আমি লিখেছি এই বইতে।”

অতিকথন? ব্লার্ব পড়ে আমার প্রথমে তাই মনে হয়েছিল। কিন্তু পড়তে গিয়ে দেখলাম তা নয়, ‘অতি’শব্দটাকে অনায়াসেই বাদ দেওয়া যায়। যে কোন লেখা পড়তে গেলে তার পেছনের পরিশ্রম চোখে পড়ে। দুই লাইনের মাঝের শূন্যস্থানে ধরা পড়ে কোন তাগিদে লেখক লিখছেন। প্রকাশকের তাগিদে, না কি পূজোসংখ্যার তাগিদে, না কি নিজের তাগিদে! এখানে নিজস্ব তাগিদটাই চোখে পড়ে। পঁচিশটা পর্ব নিখুঁত হিসাবে নির্মিত। রামপ্রসাদ সম্পর্কে কি তিনি লিখবেন, কতটা লিখবেন এবং কোথা থেকে শুরু করে কোথায় এসে থামবেন, তার কাঁটাছেড়ার নির্মান স্পষ্ট বোঝা যায়। আমার মনে পড়ে লিও তলস্তয়ের ‘ওয়ার এন্ড পীস’ মহাউপন্যাসের কথা। প্রতিটা অধ্যায়ের কি নিখুঁত নির্মান! এই লেখক তলস্তয়ের অন্ধভক্ত হলে আমি অবাক হব না। তার লেখায় তলস্তয়ের ছাপ স্পষ্ট। তলস্তয় উপন্যাসটিকে ছবার লিখেছিলেন। লেখক এই উপন্যাস কতবার লিখেছেন?

লেখক অতিরঞ্জনগুলোকে বাদ দিয়েছেন। সাহসের কাজ। সাধুবাদের কাজ। মানুষ রামপ্রসাদ নিজগুণেই সাধক এবং সিদ্ধ হয়েছেন। এটাই ছিল তার লেখার উদ্দেশ্য। তা গ্রহণ করতে এযুগের মন বিন্দুমাত্র কুন্ঠাবোধ করে না। আবার স্ত্রী-র সাথে যৌনতা রামপ্রসাদকে সত্যদ্রষ্টা কবি করে তুলেছে। সেই কারণেই তার বিদ্যাসুন্দর এত সার্থক।

এই লেখকের মধ্যে এক কবি অজ্ঞাতবাস করে। প্রতিটা পর্বের লাইনে লাইনে সেই ছন্দের দেখা পাওয়া যায়। বড়ো সুন্দর লাগে সেই ছন্দ। যে ছন্দে কবি একজন চরিত্রের মধ্যে ঢুকে পড়েন। যে চরিত্র, মজার ব্যাপার, একজন কবি। কবি হয়ে কবিজীবন যাপন সহজ কথা নয়। তিনি সেটা পেরেছেন।

কবির আরেক বৈশিষ্ট্য, উপমা। এক-একটা উপমা মনে দাগ কেটে যায় ---

১। রামপ্রসাদের মৃত্যু - “জৈষ্ঠের সাদা সূর্য এখন গঙ্গার বুকে তার সর্বস্ব ঢেলে দিচ্ছে। বাতাস অসহ্য ও নিষ্কম্প। মাথার উপরকার মেঘশূন্য নীলচে সাদা থেকে উত্তাপের একটা নিঃশব্দ ঝড় তরঙ্গায়িত নেমে আসছে। ধাতব বাষ্পের মতো হলেও সেই তাপ জলের মধ্যে যায় নি। জলের অভ্যন্তরভাগ বরং এখনও চমৎকার ঠান্ডা। এই বিস্তীর্ণ জলস্রোতে অবগাহনের মধ্যে অপরিসীম শান্তি আছে। একজন মানুষ তার সমস্ত জীবনজুড়ে যে-শান্তি চায়, তার ক্ষণিক আভাস দিতে পারে এই গঙ্গাজলের শীতলতা। এখান থেকেই নিশ্চই যুগযুগান্তরে পাপমুক্তির রূপকথা বয়ে এসেছে। এখান থেকেই নিশ্চয় আবহমান মানুষের পরিত্রাণের কিংবদন্তি প্রবাহিত হয়েছে।”

২। বর্গী আক্রমণ - “বাংলার নীল আকাশ আজ ত্রস্ত। দিগন্তে কাদের ঘর পুড়ে যাচ্ছে। আগুনের ফুলকি উড়ে আসতে পারে এদিকেও, যেকোন মুহূর্তে ঘরের চাল দাউদাউ করে জ্বলে উঠতে পারে, পল্লীর পর পল্লী ছাই হয়ে যেতে পারে। মাটিতে সবসময় ঘোড়ার খুরের আওয়াজ মিশে যাচ্ছে। কান পাতলেই শোনা যাবে। কান সবাই পেতেও আছে। ভাতের ফাঁকে ফাঁকে রক্তের আভাস। রাতের ঘুম আগের মতো নিরুপ্রদ্রব নয়। ঘুমন্ত মানুষের বুক চিরে কারা যেন তুলে আনতে পারে স্পন্দিত হৃদপিন্ড। বালিশের তলায় একটা ধাতব অস্ত্র রাখতে পারলে সোয়াস্তি হয়।”

৩। ছিয়াত্তরের মন্বন্তর - “প্রেতমুর্তিগুলো প্রতিদিন আসে। সকালে, দুপুরে, বিকালে, সন্ধ্যায়। প্রসাদের বাস্তু ঘিরে বসে। হাড় হিম করে দেওয়া গলায় সমস্বরে ফ্যান চায়। এঁটোকাঁটা চায়। এরা ভিখারি নয়, কারণ ভিখারিরা মানুষ। মনুষ্যত্বের সব পরিচয় মুছে গেছে এদের। পশুত্বের নিম্নত্ব স্তরে নেমে গেছে। পথের কুকুরের সঙ্গে এদের কোন পার্থক্য নেই। ছেড়ে এসেছে অবান্তর হয়ে যাওয়া ভিটামাটি, ধানের শূন্য গোলা, ফাঁকা গোয়াল, শুকনো পাতায় ছেয়ে যাওয়া পুকুরের ঘাট। ফেলে এসেছে চৌচির হয়ে যাওয়া চাষের জমি, ধুঁকতে থাকে গৃহপালিত জীব।”

এই উপমাগুলোই ব্যক্তি রামপ্রসাদের আলোকচ্ছটার এক-একটা আলোছায়ার মায়া। যে মায়ায় লেখক রামপ্রসাদকে নির্মাণ করেছেন। এই সমস্ত কিছুই তার গানে প্রতিফলিত হচ্ছে। তার গান আবার লোকের মধ্যে প্রবাহিত হচ্ছে। কিন্তু তার মধ্যেও রামপ্রসাদ জানেন, কি যেন একটা বাকি রয়ে গেল জীবনে। কি যেন একটা পাওয়া হল না। জগৎজননী তার কাছে কোন রূপে আসবে? সেই অপেক্ষাই করেছেন রামপ্রসাদ সারা জীবন জুড়ে অনুপমের উপন্যাসে, পঞ্চমুন্ডীর আসনে (অথচ তান্ত্রিক পদ্ধতিতে মা-কে খোঁজেন নি! অনুপমের কবি রামপ্রসাদ গান ছাড়া মা-কে চায় না মনে হয়, অথচ আকুলতা আছে!)। আমার মনে হয় এইখানেই তো উপন্যাসের সার্থকতা। উপন্যাস কিম্বা কাব্যোপন্যাস কি কেবলি তথ্যের ভারে এক নিরস নির্মাণ? না তো! লেখক যদি চরিত্রের মাধুর্যই না সৃষ্টি করতে পারলেন, তাহলে ঐতিহাসিক ব্যক্তিকে পুনরাবিস্কার করার প্রয়োজন কি? থিসিস পেপারের জন্যে হয়তো মানা যায়, কিন্তু চরিত্রের মাধুর্য অন্য কিছু দাবী করে। চরিত্রের মাধুর্য যেমন ‘রাধা’ নামে এক কল্পনাকে বাস্তব করে, তেমনি রামপ্রসাদকেও অতিলৌকিক থেকে মাটির সাধক করে।

মাধুর্যই শিল্পের শেষ কথা। মাধুর্যই রামপ্রসাদের শেষ কথা। এই মাধুর্যই আমি অনুপম-রামপ্রসাদে পেয়েছি।

 

================================

 

বিঃ দ্রঃ - যারা রামপ্রসাদের জীবনী পড়তে চান, তারা যোগেন্দ্রনাথ গুপ্তের ‘সাধক কবি রামপ্রসাদ’ পড়তে পারেন। সার্থক জীবনী কি না বলতে পারব না। তবে এই জীবনীটাই সবচেয়ে বেশি বিদ্বজ্জন মহলে আদর পেয়েছে।

 

================================

 

সাধক কবি রামপ্রসাদ

স্বামী বামদেবানন্দ

উদ্বোধন কার্যালয়

মুদ্রিত মূল্যঃ ২০/-

-----

রামপ্রসাদ

অনুপম মুখোপাধ্যায়

তবুও প্রয়াস

মুদ্রিত মূল্যঃ ৩৫০/-

-----

ছবি কৃতজ্ঞতাঃ সমর্পিতা

Comments

Popular posts from this blog

যে বুকে আগুন জ্বলে

শারদীয়া আনন্দবাজার পত্রিকা সম্পর্কে

জেরক্স কপির উন্নত ভার্সানে ‘আবার প্রলয়’ এসেছে