স্ত্রী ২
সিনেমাটা দেখতে দেখতে আমার
একটা কথা মনে হচ্ছিল বারবার, আপনারাও একবার ভেবে দেখতে পারেন –
যতদিন মনুষ্য প্রজাতি জীবিত থাকবে, ধর্ম, সমাজ, নীতি-নৈতিকতা,
বিজ্ঞান ইত্যাদি সমস্ত কিছুর উপরেও একটাই বিষয় নিজেদের মধ্যে লড়াই করবে। কোন একজন
কোনো এক সময়ে অপরজনের ওপর প্রাধান্য বিস্তার করে চলবে।
সেটা হল দ্বিজাতিতত্ত্ব – খুব ভাল করে বললে, স্ত্রীজাতি এবং পুরুষজাতির
প্রাধান্য দ্বন্দ্ব।
এই মুহূর্তে সারা বিশ্ব জুড়ে, কোথাও আমার মনে হয়,
পুরুষপ্রাধান্যতা থেকে আস্তে আস্তে স্ত্রীপ্রাধান্যতার দিকে সমস্ত মানবসমাজ ‘শিফট্’
করছে। খুব ধীরে ধীরে হলেও করছে।
কীভাবে?
প্রথম
বিশ্বযুদ্ধের আগে, সমগ্র সমাজে, কর্মক্ষেত্রে স্ত্রীজাতির খুব একটা বিচরণ ছিল না।
কিন্তু প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরেই আস্তে আস্তে নারীরা কর্মক্ষেত্রে আসতে একরকম বাধ্য
হয়, এবং তাদের কর্মকুশলতা কিছু কিছু ক্ষেত্রে রীতিমতো প্রাধান্যতা পেয়ে যায়। সমগ্র
ইউরোপ এবং আমেরিকা যুদ্ধের কারণেই, মেয়েরা সংসার থেকে সরে এসে মূল সমাজে যোগদান
করতে শুরু করে। তার আগে, মেয়েদের কর্মকান্ডে তেমন করে দেখা গিয়েছিল কি?
ঠিক তেমনই, আমাদের এদিকে, মানে পশ্চিমবঙ্গে,
একাত্তরের পরে, এপার বাংলায় চলে আসা হতচ্ছিন্ন পরিবারের হাল ধরতে শুরু করে মেয়েরা
এবং সেখান থেকেই মেয়েদের বঙ্গসমাজে কর্মী হিসাবে মূলত দেখতে শুরু করি। তার আগে,
অন্তত কোন নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারেও, মেয়েরা চাকরী করবে, এ ভাবনাটার কোন জায়গাই
ছিল না। কয়েকটা বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্র বাদ দিয়ে, যার মধ্যে একটা হল চিকিৎসাক্ষেত্র।
আর আজ, যে কোন
মেয়েই, স্বাবলম্বী হওয়ার কথা ভাবে, হতে চায়।
মেয়েদের ওপর
পিতৃতান্ত্রিক উন্মাদনার প্রতিঘাতেই এই সিনেমাটার নির্মান। এ নিয়ে ভাবনার কোন
অবকাশই নেই। যেটা আমার সবচেয়ে বেশি ভাল লগেছে, তা হল, মেয়েরা নিজেরাই নিজেদের
মুক্তির পথ বেছে নিচ্ছে। মনে করে দেখুন, সিনেমার এক পর্যায়ে মেয়েরা রাজকুমার
রাও-কে নিজেদের ত্রাতা মনে করে। অর্থাৎ, তখনও নিজেদের ওপর পূর্ণ বিশ্বাস তাদের আসে
নি। তাদের বারংবার মনে হয়েছে যে, একজন রক্ষাকর্তার প্রয়োজন। এবং সেই রক্ষাকর্তা
একজন পুরুষ। কিন্তু, যখন গ্রামের সমস্ত মেয়েদেরকেই আগল দেওয়া হল, সমাজ নিজে ঠিক
করতে শুরু করল যে, মেয়েদের ঠিক কোথায় কতটা ‘ছুট’ দিতে হবে, এবং যখন মেয়েরা বুঝতে
পারল তাদের ত্রাতা তারা নিজেই, তখন যেভাবে নিজেদের নিজেরা একত্রিত করে নিজেরাই
সমাজের মুল স্রোতে ফিরে আসল স্বমর্যাদায়, সেখানেই তাদের জিত। সেখানেই তাদের
নারীত্বের সার্থকতা।
নারীর
সার্থকতা পুরুষতন্ত্রের বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষণা করে নয়, নারীর সার্থকতা পুরুষদের
সাথে পাশাপাশি চলে নয়, নারীর সার্থকতা নিজেদের অধিকার আদায় করেও নয়। নারীর
সার্থকতা একজন ‘সার্থক নারী’ হয়ে। নারী, নিরক্ষর হয়েও, সংসারের মেরুদন্ড হতে পারে,
নারী স্বাক্ষর হয়ে গুগল চাকরী করতে পারে, নারী জ্ঞানী হয়ে মঙ্গলায়নের সার্থক
রূপকার হতে পারে এবং ঠিক সেইখানেই নারীর নারীত্ব। সেখানে, আমার বিশ্বাস, একজন
সার্থক পুরুষ, সেই জায়গায় সসন্মানে পথ ছেড়ে দেবে, কারন সমাজ চলে মনুষ্যত্বে।
এই ‘নারীত্ব’টা
ঠিক কি? তা একজন নারীকেই ঠিক করতে হবে। এবং সেটাকে প্রাপ্ত করা একটা সাধনাও। ঠিক
যেমন করে একজন পুরুষকেও পুরুষ হয়ে ওঠার সাধনা করতে হয়। না হতে পারলে সমাজ কি তাকে
সার্থক পুরুষ বলে মেনে নেয়? না তো! ঠিক সেইভাবেই, একজন নারী, ঠিক কিভাবে সমাজের
জন্য নিজের মনুষত্বকে প্রতিষ্ঠা করবে, তা একজন নারীকেই ঠিক করে নিতে হবে।
আমি
সার্থকতায় বিশ্বাসী, আদায় করায় বিশ্বাসী নই।
সিনেমাতে
কেউ কাউকে আদায় করে নি। এমনকি সবশেষে শ্রদ্ধা কাপুরের চরিত্রটিও রাজকুমার রাওয়ের
চরিত্রকে ত্যাগ করে ফিরে যায়। কারন, সে জানে, তার নারীত্ব রাজকুমার রাওয়ের ঘরণী
হয়ে নয়। তার নারীত্ব অন্য কোন বিপদের সামনে নিজেকে মুখোমুখি করে। এইখানেই চরিত্রগুলো
কি অসম্ভব সুন্দর হয়ে ওঠে।
সিনেমাটাতে
চরিত্রগুলো কোন অবস্থাতেই কাউকে ডমিনেট করে না। বরং একে অপরের জন্য ঝাপিয়ে পড়ে।
আমি কিন্তু নারী এবং পুরুষের মধ্যেকার কথা বলছি। এ পঙ্কজ ত্রিপাঠীর জন্য তামান্না
ভাটিয়ার ঝাঁপিয়ে পড়াই শুধু নয়, এ তামান্নার জন্যে পঙ্কজের বইয়ের মধ্যে বসে অন্তহীন
অপেক্ষারও। যে অপেক্ষার কোন সাক্ষী নেই, কোন শেষ নেই। কিন্তু পূর্ণতার স্বাদের
অস্তিত্ব আছে।
এই সিনেমা
নিয়ে অনেক প্রশংসা হয়েছে। রাজকুমার রাও, অপারশক্তি খুরানা, অভিষেক ব্যানার্জী এবং
পঙ্কজ ত্রিপাঠী – এই চারজনে একসাথে যতবার স্ক্রীন শেয়ার করেছে, কিম্বা তিনজনেও,
কাকে ছেড়ে কাকে দেখি, বুঝতে পারছিলাম না। সিনেমার কমিক টাইমিং অসাধারণ, বারবার
দেখার মতো। শ্রদ্ধা কাপুর যথাযথ।
কিন্তু এত
সব কিছুর পরেও, আমার মনে হয়, আসলেই যে কারনে সিনেমাটার নির্মান, সেই বিষয়টাকে আমরা
যেন না ভুলে যাই। এবং বারবার আমরা সেইটাকে নিয়েই ভাবি। এ এমন একটা বিষয়, যার
গভীরতায় যাওয়া আমাদের বড়ো প্রয়োজন। যা নিয়ে সুস্থ আলোচনা করা প্রয়োজন।
যা নিয়েই
আসলে আলোচনা করা প্রয়োজন, ভাবনা-চিন্তার একটা সার্থক রূপায়ন আমাদের নিজেদের মধ্যে
করা প্রয়োজন।
নিজের জন্য,
পাশের মানুষটির জন্য, নিজের পরিবারের জন্য, সর্বোপরি ভাবীকালের নির্মানের জন্য।
Comments
Post a Comment