আর্থার সি ক্লার্ক গল্পসমগ্র ১

 


কল্পবিজ্ঞান – কল্পবিশ্ব – গল্পপাঠক

এই ত্রিবেণীতীর্থে আমি কোথায়? পাঠকের আসনে। বই পড়তে পড়তে, মানে যতটুকু পড়েছি আর কি, তাতে করে, কিছু কিছু পাবলিশিং হাউসের প্রতি আমার একটা বিশ্বাসবোধ অবচেতনেই জন্মে গেছে। মনে হয়েছে, অন্তত, এ আমাকে ঠকাবে না। দামে বেশি মানে ভাল হলে আমার কোন আপত্তি নেই। কল্পবিজ্ঞানের কোন গল্পের অনুবাদ যদি কল্পবিশ্ব করে থাকে, তাহলে, আমি ঠিক জানি, সার্থক অনুবাদ না হলেও, গছানোর মতো অনুবাদ তারা করবেন না। সার্থক অনুবাদ নিয়ে বিতর্ক অনেক থাকে। ফলে সেই জায়গায় পৌছচ্ছে কি না, তা নিয়ে অনুবাদ বিশেষজ্ঞরা কথা বলবেন। আমরা, সাধারণ পাঠক-পাঠিকারা, অনুবাদের ভাষা যদি আমাদের সাথে ‘কমিউনিকেট’ করতে পারে অতি সহজে, তাহলেই বর্তে যাই।

কল্পবিশ্বের অনুবাদকেরা আমাকে কখনই হতাশ করে নি। করে নি বলেই, দাম একটু বেশি দিয়ে হলেও আমি চোখ বন্ধ করে কিনি। যদিও, আমি এখনও সুলভ সংস্করণ, স্টুডেন্ট সংস্করণ কিম্বা পেপারব্যাকের কথা বলে যাব। অথবা কিন্ডল এডিশন, যেখানে দামটা একটু কম। আর আমাজনে বইগুলো পাওয়া গেলে সোনায় সোহাগা। পোস্টাল খরচ বাজারে আলু-বেগুনের দামের মতো বাড়ছে। সেটা কখনই কাম্য নয়। অন্তত আমাজনের জঙ্গলে থেকে...

আর্থার সি ক্লার্কের নাম আমি শুনেছি। কোনদিন পড়েছি কি? একটাই পড়েছিলাম দিনকয়েক আগে। সেখানে আমি লিখেছিলাম, “আর্থার সি ক্লার্কের স্পেস ওডিসিসিরিজ যখন পড়ব তখন না হয় বুঝে নেব কেন তিনি এত বিখ্যাত। কিন্তু এই উপন্যাস এত শান্ত, ধীর-স্থির, পড়তে পড়তে কখন যে নিজের চারপাশের সময়টাও ধীর-স্থির হতে শুরু করে খেয়াল হয় না। আস্তে আস্তে মনেই থাকে না, আমি পৃথিবীতেই আছি এবং তাদের কথা পড়ছি। এমনিভাবেই আস্তে আস্তে উপন্যাসটা শেষ হয়ে যায়।”

আমার থাকা না থাকাটার সাথে পৃথিবীর একটা যোগ থাকে। আর্থার সেটাকে অনেক সময় ভুলিয়ে দেন। অসম্ভব কল্পনা এত সুন্দর বাস্তব হতে পারে যাস্ট ভাবা যায় না। তাঁর লেখা ছোট ছোট গল্পগুলোর ক্ষেত্রেও এই একই কথা প্রযোজ্য। এই যেমন ‘দ্য ওয়াল অফ ডার্কনেস’ গল্পটার কথাই ধরুন না। দুটো সম্পূর্ন আলাদা তলকে (টু ডায়মেনশান) মাত্র একটা তলে (ওয়ান ডায়মেনশান) রূপান্তরিত করা যেতে পারে? পারে। আমরা তেমন বেশ কিছু স্থাপত্য ভাস্কর্য দেখতে পাই। কৌতুহলী পাঠকেরা একটু ভেবে দেখতে পারেন। কিন্তু একটা পাঁচিল, যা একটা দেশের সর্বশেষ সীমানা, যেখান থেকে চির অন্ধকার নেমে এসেছে, সেইটাই যখন একমাত্রিক তলের মতো ব্যবহার করে তখন কি ঘটতে পারে? এখানে অবশ্য তিনমাত্রার তলের ক্ষেত্রে ঘটছে, যা বোঝাটা, চিন্তায়, বেশ শক্ত। দ্বিমাত্রিক তল দিয়ে বুঝতে যাওয়াটা ব্যাপারটা বেশি সুবিধাজনক। সেই জায়গা থেকে গল্পটার নির্মান। এই গল্পসমগ্রে এই গল্পটা আমার সবথেকে ভালো লেগেছে।

মানুষ হিংস্র। কতটা হিংস্র? একটা উদাহরণ দেখুন---

“তারপর রাগনের দিকে ঘুরে মজা করে সে বলল, “ভয়-ভয় লাগছে বুঝলে? ভীষণ জেদি জাত। এদের সঙ্গে আমাদের খুব সাবধানে ভদ্র ব্যবহার করা উচিত। আর ধরো, ওরা আমাদের এই আন্তর্গ্রহ যুক্তরাষ্ট্রীয় বন্দোবস্তটা পছন্দ করল না! তখন?” বলতে বলতে সে বাইরের ছড়িয়ে-থাকা অগুনতি নক্ষত্রের দিকে চুপ করে গেল।

রাগন তাঁর ক্যাপটেনের কথায় মজা পেয়ে প্রাণ ভরে হাসল কিছুক্ষণ।

* * *

এর কুড়ি বছরের মধ্যে আলভেরনের কথাটা আর রসিকতা থাকেনি।”

আমি ‘দ্য রেসকিউ পার্টি’ পড়তে পড়তে শিউরে উঠি।

আমাদের পৃথিবীকে আমরা যেরকম দেখি তা কি আসলেই সেরকম? শব্দতরতঙ্গকে কাজে লাগিয়ে নিখুঁত ভূতাত্বিক কাজ করতে করতে এক বিজ্ঞানী নেমে যায় পনেরো মাইল নীচে। দেখা যায় সেখানে আছে আরেক সভ্যতা। একটা শহর --- “জালের মতো জিনিসটা এখনও হালকাভাবে জ্বলজ্বল করছে, যা দেখে আমাদের আক্কেল গুড়ুম হয়ে গিয়েছিল। আমি ওখানে রাস্তাঘাট আর বাড়ি কল্পনা করছিলাম, ভাবছিলাম, মাছের সাঁতার কেটে যাওয়ার মতো জীবগুলো দ্যুতিময় গলন্ত পাথরের মধ্যে দিয়ে যাতায়াত করছে, কী বিচিত্র... আর তারপর মনে পড়ল, কী দারুন অল্প তাপমাত্রা ও চাপে আমাদের মানবজাতি বেঁচে আছে।” ‘দ্য ফায়ার উইদিন’ গল্পের এখানেই শেষ নয়। নীচের জগতের প্রাণীরা একসময় ওপরে উঠে আসে। ওদের উঠে আসার ফলে তখন পৃথিবীপৃষ্ঠে মানবজাতির অস্তিত্বই বিলুপ্ত। সেই উন্নত প্রাণীরা কি ভাবছে?

“হঠাৎ ভীষণ অস্বস্তি হচ্ছিল আমার, ও কি বলছিল, আমি ভালো করে শুনছিলামই না। বিরাট ক্যালান্থিয়ান শহরের নীচে যে হাজার হাজার মাইল পাথর আছে তাঁর কথা ভাবছিলাম আমি। সেই পাথর আরও গরম হয়ে উঠছে, আরও ঘন হয়ে উঠছে পৃথিবীর অজানা কেন্দ্রস্থলে। আমি তাই কার্নের দিকে ফিরে তাকালাম। শান্তভাবে বললাম, “ব্যাপারটা কিন্তু মজার নয়। এরপর হয়তো আমাদের পালা।”

ঠিক এইখানেই আর্থার হয়ে ওঠেন জাদুকর।

 

এরকম ছোট ছোট গল্পের কোলাজ নিয়ে আর্থার সি ক্লার্কের ছোটগল্পসমগ্রের প্রথম খন্ড। পড়তে পড়তে কখন যে শেষ হয়ে যায় খেয়াল থাকে না। কেবল একটা অতৃপ্তি মনে রয়ে যায়। দ্বিতীয় খন্ড কবে হাতে পাব। কল্পবিশ্ব জানাতে পারবে কি?

ও, আরেকটা কথা। ছাপাখানার ভূত কল্পবিশ্বকেও আক্রমণ করেছে প্রবলভাবে। এটা একটু খেয়াল রেখে পড়তে হবে।

===============================

গল্পসমগ্র ১

আর্থার সি ক্লার্ক

কল্পবিশ্ব পাবলিকেশান

মুদ্রিত মূল্যঃ ৮০০টাকা

ছবি কৃতজ্ঞতাঃ সমর্পিতা


Comments

Popular posts from this blog

যে বুকে আগুন জ্বলে

জেরক্স কপির উন্নত ভার্সানে ‘আবার প্রলয়’ এসেছে

শারদীয়া আনন্দবাজার পত্রিকা সম্পর্কে